ডিজিটাল যুগেও নারায়ণগঞ্জের কাঞ্চন সেতুর টোল আদায় হচ্ছে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে। টোলঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে বিনা স্লিপে চালকদের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছে নিরাপত্তাপ্রহরীরা। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অসাধু ব্যক্তিদের যোগসাজশে মাসিক হারে প্রতিদিন গোপন লেনদেন করে চলছে স্থানীয় পাঁচ শতাধিক পরিবহন। এতে করে সরকারের প্রতিদিন খোয়া যাচ্ছে ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা। এ টাকার ভাগ সরকারদলীয় স্থানীয় কিছু নেতার পকেটেও যাচ্ছে।
জানা গেছে, সড়ক বিভাগের হাতে টোল প্লাজা থাকতে সরকার প্রতিদিন ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা পেত। পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) হাতে যাওয়ার পর সরকার পাচ্ছে মাত্র ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা। এতে এক বছরে সরকারকে গচ্চা দিতে হচ্ছে প্রায় ২০ কোটি টাকা। টোল বুথের সামনের ব্যারিয়ার, যানবাহনের শ্রেণি অনুযায়ী নির্ধারিত ফি প্রদর্শন মেশিনগুলো অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে। এতে টোল আদায়ে বিলম্ব হচ্ছে। সেতু ও সেতু-সংলগ্ন রাস্তাঘাট মেরামতে নেই যথাযথ উদ্যোগ। ২৪ ঘণ্টাই লেগে থাকে যানজট। টোল প্লাজাwর উভয় পাশে ৮-১০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই যানজটে আটকে দুর্ভোগ পোহাতে হয় দূরপাল্লার যাত্রীবাহী ও মালামালবাহী পরিবহনের। সবচেয়ে দুর্ভোগে পড়তে হয় অ্যাম্বুলেন্স, স্কুলগামী পরিবহন ও জরুরি কাজে বের হওয়া মানুষদের।
এসব অনিয়মের ব্যাপারে কোনো মন্তব্য না করে নারায়ণগঞ্জ সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহানা ফেরদৌস বলেন, এই সেতু এখন ঢাকা বাইপাস এক্সপ্রেসওয়ে এশিয়ান হাইওয়ে-১ প্রকল্পের আওতাধীন। পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) প্রকল্পের আওতায় তাদের লোকবল দিয়ে টোল আদায় করা হচ্ছে। আদায় করা টোল সরকারের রাজস্ব বিভাগে জমা হচ্ছে। এর বেশি আর আমি কিছু বলতে পারব না। আমি এখানে নতুন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জ সড়ক বিভাগের কাছ থেকে গত ২১ জুন এই সেতুসহ ৪৮ কিলোমিটার সড়ক ঢাকা বাইপাস প্রকল্পের দায়িত্ব দেওয়া হয় তিন কোম্পানিকে। পিপিপিতে নিয়োজিত কোম্পানিগুলো হলো ইউডিসি কনস্ট্রাকশন লিমিটেড, শামীস এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড ও চায়নার এস আর বিজি। টোল প্লাজার টোল আদায়ের দায়িত্বে আছে ইউডিসি কনস্ট্রাকশন লিমিটেড। এই কোম্পানির ডাইরেক্টর অপূর্ব সাহা প্রতিদিন গড়ে সরকারের ঘরে ৫ লাখ টাকা কম জমা দেওয়া প্রসঙ্গে বলেন, শুনেছি টোল আদায়ের দায়িত্ব সড়ক বিভাগের হাতে থাকায় সরকার প্রতিদিন ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা পেত। তখন গাড়ির চাপ বেশি ছিল। এখন আগের মতো আর গাড়ির চাপ নেই। আবার যানজট এড়াতে প্রতিদিন কিছু গাড়ির টোল আদায় না করেই ছেড়ে দেওয়া হয়।
কাঞ্চন সেতুটি নির্মাণ করা হয় ২০০৬ সালের অক্টোবরে। স্থানীয়রা জানান, উদ্বোধনের সময় ১০ বছর পর্যন্ত টোল আদায় করার কথা ছিল। সেই হিসাব অনুযায়ী, ২০১৬ সালে টোল আদায়ের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। রূপগঞ্জে শীতলক্ষ্যা নদীর ওপর কাঞ্চন সেতুর কাছাকাছি রয়েছে কাঁচপুর সেতু, ডেমরা-তারাব সেতু, মুড়াপাড়া-ইছাখালী সেতু ও কাঞ্চন সেতু। এসব সেতুর মধ্যে শুধু কাঞ্চন সেতুতেই মেয়াদ চলে যাওয়ার পরও আদায় করা হচ্ছে টোল। বাকি তিনটি সেতুতে কোনো টোল আদায় করা হয় না।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০০৯ সালের অক্টোবরে সড়ক ও জনপথ থেকে উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে তিন বছরের জন্য টোল আদায়ে ইজারা পায় মেসার্স এসইএল-ইউডিসি-জেভি নামক যৌথ মালিকানার একটি প্রতিষ্ঠান। ২০১২ সালের অক্টোবরে প্রতিষ্ঠানটি আরও পাঁচ বছরের জন্য টোল আদায় ইজারা করে। এভাবে ইজারানামীয় কখনো আউটসোর্সিং কখনো মৌখিক মেয়াদ বাড়িয়ে এ টোল আদায় প্রক্রিয়ায় যুক্ত রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
টোল প্লাজার শ্রমিকরা জানান, ২৪ ঘণ্টায় অন্তত ২০ হাজার যানবাহন এই সড়কে চলাচল করে। এর মধ্যে হাইট্রলি, বড় ট্রেইলর, কাভার্ডভ্যান ও ট্রাকের সংখ্যাই বেশি। যানজট এড়াতে সম্প্রতি প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাস থেকে ইচ্ছা করে না দিলে তাদের কাছ থেকে কোনো টোল আদায় করা হয় না। এই টোল প্লাজায় রয়েছে পাঁচটি বুথ। প্রতিদিন বড় ট্রেইলর থেকে ৩২৫, ট্রাক থেকে ১৩০, বাস থেকে ১২৫ টাকা হারে ১১টি ক্যাটাগরির পরিবহন থেকে টোল আদায় করা হয়।
চট্টগ্রাম থেকে আসা গাজীপুরগামী পণ্যবাহী ট্রেইলর চালক মাহমুদ আলীম বলেন, টোল প্লাজা থেকে বের হতে ২-৩ ঘণ্টা লেগে যায়। মাঝেমধ্যে ভাংতি না থাকলে আরও বেশি সময় লাগে। ট্রাকচালক মিলন সরকার বলেন, টোল প্লাজার শ্রমিকরা এখানে লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রায়ই তারা উত্তেজিত হয়ে আমাদের ওপর আক্রমণ করে। এতে করে যানজট আরও বেড়ে যায়। কাঞ্চন এলাকার রিকশাচালক এরফান মিয়া বলেন, রাস্তার এ পাড় থেকে ও পাড়ে যেতে টোল প্লাজার জ্যামের কারণে দুই আড়াই ঘণ্টা লেগে যায়। একই কথা বলেছেন স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।
ঢাকা বাইপাসের প্রকল্প পরিচালক এবং সড়ক ও জনপথের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল ওয়াহিদ বলেন, যারা টোল আদায় করে, সরকার থেকে তাদের কোনো পারিশ্রমিক দেওয়া হয় না। তারা প্রকল্পের আওতাধীন। বিষয়টি নারায়ণগঞ্জের সড়ক বিভাগের নির্বাহী কর্মকর্তা ভালো বলতে পারবেন।