বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) দায়দেনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। পাওনা পরিশোধে নানাভাবে তাগিদ দিচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো। অন্যদিকে ভতুর্কির অর্থ ছাড়ের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে সঙ্গে বারবার আলোচনা করেও কোনো সুরাহা হচ্ছে না। দেশের সার্বিক বিদ্যুৎ পরিস্থিতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
দেশে সরকারি-বেসরকারি খাতে যত বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় এবং আমদানি করা হয়, এর একক ক্রেতা পিডিবি। পিডিবি এসব বিদ্যুৎ কিনে বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছে বিক্রি করে। আইপিপি (ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রোডিউসার), রেন্টালসহ জ্বালানির ধরন এবং কেন্দ্র ভেদে যে দামে পিডিবিকে বিদ্যুৎ কিনতে হয়, তার চেয়ে কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। বেশি দামে কিনে কম দামে বিক্রির কারণে যে লোকসান হয়, তা সরকার ভতুর্কির মাধ্যমে সমন্বয় করে। কম দামে বিক্রি ও ভতুর্কির টাকা না পাওয়ার কারণে চরম অর্থ সংকটে পড়েছে সরকারি এই সংস্থাটি। পিডিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
এ বিষয়ে পিডিবির সদস্য অর্থ (যুগ্ম সচিব) সেখ আকতার হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘বিদ্যুৎ উৎপাদকদের বিল পরিশোধ করতে না পারায় দিন দিন দেনা বাড়ছে। আমরা বিষয়টি নিয়মিত মন্ত্রণালয়কে জানাচ্ছি। বেশি দামে কিনে কম দামে বিক্রি করার কারণে অর্থ সংকট হচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ডলার সংকট। সব মিলিয়ে যে সংকট তৈরি হয়েছে বিশেষ বন্ড ছেড়ে তা সমাধানের জোর চেষ্টা চলছে।’
সংশ্লিষ্টরা জানান, দুই অর্থবছর ধরেই বড় অঙ্কের লোকসান গুনছে পিডিবি। ২০২১-২২ অর্থবছরের ভতুর্কির অর্থ গেল বছর ছাড় করে। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরের অর্থের আংশিক ছাড় করেছে চলতি অর্থবছরে। চাহিদার তুলনায় কম অর্থ পাওয়ায় গেল অর্থবছরের বকেয়া এখনো রয়ে গেছে। এর সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগ হচ্ছে চলতি অর্থবছরের বকেয়া।
সম্প্রতি বিদ্যুৎ খাতের বকেয়া পরিশোধ করতে বিশেষ বন্ড ইস্যু করা হয়েছে। গত বুধবার বেসরকারি সিটি ব্যাংক ও পূবালী ব্যাংকের মোট ২ হাজার ৬২ কোটি টাকার বিশেষ বন্ড ছাড়ার বহুপক্ষীয় চুক্তি হয়েছে। এর মধ্যে সিটি ব্যাংকের মাধ্যমে ১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা এবং পূবালী ব্যাংকের মাধ্যমে ৭৭ কোটি ৫০ লাখ টাকার বন্ড ছাড়া হেব। বন্ডের কুপন রেট বা সুদ হার নির্ধারণ করা হয়েছে ৮ শতাংশ। এর আগে টাকার অভাবে সারের ভর্তুকি বাবদ সরকার ৩ হাজার ১৬ কোটি টাকা পরিশোধ করেছিল বিশেষ বন্ড ছেড়ে। এবার একই পন্থায় বিশেষ বন্ড ছাড়া হয়েছে বিদ্যুতের দেনা পরিশোধ করতে।
জানা গেছে, বিশেষ বন্ড ছাড়ার উদ্যোগ নেওয়ার পর সম্প্রতি বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর বকেয়ার হিসাব করেছে পিডিবি। গত বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই হিসাব করা হয়। এই সময়ের মধ্যে পিডিবির বকেয়ার পরিমাণ ৩৬ হাজার ৭৫০ কোটি ৫৩ লাখ টাকা।
জানা গেছে, ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের বকেয়া সবচেয়ে বেশি। যার পরিমাণ ৪ হাজার ১১১ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। এই বকেয়ার মধ্যে আদানির বকেয়াই ২ হাজার ৮১২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা।
দেশি বহুজাতিক কোম্পানি সামিট গ্রুপের আটটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল বকেয়া পড়েছে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩ হাজার ৬১১ কোটি ২৭ লাখ টাকা। আর বাংলাদেশ-চীন বিদ্যুৎ কোম্পানির পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাওনা দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ২৮১ কোটি ৪১ লাখ টাকা। অন্য দেশি কোম্পানি ইউনাইটেড গ্রুপের সাত বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাওনার পরিমাণ ২ হাজার ৫৫৩ কোটি ৬৬ লাখ টাকা।
সরকারি কোম্পানির নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির সাত কেন্দ্রের বকেয়া ২ হাজার ২৮৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। ইলেকট্রিক জেনারেশন কোম্পানির (ইজিসিবি) তিন কেন্দ্রের বকেয়া ২ হাজার ২৮৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা এবং আশুগঞ্জ পাওয়ার সাপ্লাই কোম্পানির ছয় কেন্দ্রের বকেয়া ২ হাজার ১৯৪ কোটি ২৬ লাখ টাকা।
বিদেশি মালিকানাধীন সিডিসি মালয়েশিয়ার দুই কেন্দ্রের বকেয়া ১ হাজার ৫৮৯ কোটি ৮৫ লাখ টাকা, ওরিয়ন গ্রুপের ছয় বিদ্যুৎকেন্দ্রের বকেয়া ১ হাজার ৩৭৮ কোটি ১৪ লাখ টাকা, রুরাল পাওয়ার কোম্পানি (আরপিসিএল) ও আরইবির বিভিন্ন পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মালিকানাধীন চার কেন্দ্রের বকেয়া ১ হাজার ৩৫৫ কোটি ১০ লাখ টাকা।
বেসরকারি খাতের ডরিন গ্রুপের সাত বিদ্যুৎকেন্দ্রের বকেয়া ১ হাজার ২৫৭ কোটি ২১ লাখ টাকা, কনফিডেন্স গ্রুপের চার বিদ্যুৎকেন্দ্রের বকেয়ার পরিমাণ ১ হাজার ১৫৪ কোটি ৭২ লাখ টাকা। অ্যাক্রন গ্রুপের (বাংলাক্যাট) পাঁচ বিদ্যুৎকেন্দ্রের বকেয়া ১ হাজার ১৩ কোটি ৭৪ লাখ টাকা।
এ ছাড়া বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানির রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বকেয়া ৯৫৯ কোটি ২২ লাখ টাকা, বারাকা গ্রুপের চার কেন্দ্রের বকেয়া ৭৯০ কোটি ৯০ লাখ টাকা, সিঙ্গাপুর-বাংলাদেশ যৌথ মালিকানার সেম্বকর্প-এনডব্লিউপিজিসির বকেয়া ৭৪৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা, ইয়ুথ গ্রুপের তিন কেন্দ্রের বকেয়া ৫৮৪ কোটি ৬৩ লাখ টাকা এবং দেশ গ্রুপের তিন কেন্দ্রের ৫৪২ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।
সরকারি কোম্পানি বি-আর পাওয়ারজেনের বকেয়া ৪৯১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা, শ্রীলঙ্কার লঙ্কা গ্রুপের বকেয়া ৪১৯ কোটি ১৩ লাখ, এসএস পাওয়ারের ৩৬৯ কোটি ১৪ লাখ, আনলিমা গ্রুপের ৩৪৬ কোটি ৩৭ লাখ, প্যারামাউন্ট গ্রুপের ৩৪২ কোটি ৬০ লাখ, বরিশাল ইলেকট্রিকের ৩৩৬ কোটি ৩০ লাখ, বিদেশি মালিকানাধীন নতুন বিদ্যুৎ কোম্পানির ৩৩১ কোটি ৬২ লাখ এবং ইনডেক্স গ্রুপের ৩১৫ কোটি ১৬ লাখ টাকা। এ ছাড়া পিজিসিবির হুইলিং চার্জ বকেয়া রয়েছে ৩০৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকা।
পাশাপাশি বেসরকারি খাতের সৌরবিদ্যুতের ছয়টি কোম্পানির বকেয়া ২৮১ কোটি ৮৯ লাখ টাকা, ইপিভি গ্রুপের ২৬৪ কোটি ১৮ লাখ, সামিট ও ইউনাইটেড গ্রুপের যৌথ মালিকানাধীন কেপিসিএলের ২৫৬ কোটি ৯৪ লাখ, হোসাফ গ্রুপের ২৫৫ কোটি ৩০ লাখ, যুক্তরাজ্যের অ্যাগ্রিকোর ১৩৩ কোটি ৪৬ লাখ, দেশীয় ম্যাক্স গ্রুপের পাওনা ১২২ কোটি ৮৩ লাখ, সিনহা গ্রুপের ১১৬ কোটি ৭০ লাখ, রিজেন্ট গ্রুপের ৯৬ কোটি ৯৯ লাখ, সিকদার গ্রুপের ৮৪ কোটি ২৭ লাখ, নর্দান পাওয়ারের ৬৬ কোটি ২৪ লাখ এবং যুক্তরাষ্ট্রের এপিআর এনার্জির ৭৪ কোটি ৭৭ লাখ এবং দেশীয় জিবিবি পাওয়ারের ৩৩ কোটি ৪১ লাখ টাকা।