বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) পাবনা অফিস যেন দালাল চক্রের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। ড্রাইভিং লাইসেন্স, নবায়ন, যানবাহনের রেজিস্ট্রেশন, রুট পারমিটসহ সংশ্লিষ্ট কাজ করিয়ে দেওয়ার নামে কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে যোগসাজশ করে সেবা গ্রহীতাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন এই দালালরা।
এখানে দালাল ধরলে ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য পরীক্ষাও দিতে হয় না। ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ির রেজিস্ট্রেশন না দেওয়ার বিধান থাকলেও উৎকোচের বিনিময়ে লার্নার (শিক্ষানবিশ) কার্ডধারীদের নিয়মিতই রেজিস্ট্রেশন দিয়ে যাচ্ছেন দালাল চক্রের সদস্যরা। ফটোকপির দোকানে ২০০ টাকার বিনিময়ে ডাক্তারি পরীক্ষার সার্টিফিকেটও পাওয়া যাচ্ছে। আবার কিছু নির্দিষ্ট ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সঙ্গে যোগসাজশ করে সেখানে সেবা গ্রহীতাদের পাঠানো হয়। বেশি টাকা দিলে দ্রুত ডাক্তারি পরীক্ষার সার্টিফিকেটও মিলছে।
গত সোম, মঙ্গল ও বুধবার বিআরটিএর অফিস ঘুরে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। তবে বিআরটিএ কর্মকর্তাদের দাবি, এই অফিসে কোনো দালাল নেই। এখানে নিয়মমাফিক কাজ হয়।
পাবনা বিআরটিএ অফিস সূত্রে জানা গেছে, প্রতি মাসে অফিসে তিনটি করে বোর্ড বসে। একেকটি বোর্ডের জন্য সর্বোচ্চ ২২০ জন ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে পারেন। এক একটি বোর্ডের আবেদনকৃত ২২০ জনের মধ্যে ১৫০ থেকে ১৫৫ জন করে মোট ৬০০ জন আবেদন করলে ৫০০ জনের মতো ড্রাইভিং লাইসেন্সের পরীক্ষা দিতে আসেন। পরীক্ষায় পাস করলে অনলাইনে টাকা জমা নেওয়ার অপশন শুরু হয়। তবে জেলায় কতটি বৈধ যানবাহন আর কতটি অবৈধ যানবাহন রয়েছে সেই তথ্য জানা যায়নি।
সদর উপজেলার গয়েশপুর এলাকার টিপু সুলতান বলেন, তিন বছর ধরে লাইসেন্সের জন্য ঘুরছি। আজ নয় কাল, কাল নয় পরশু হবে। দালাল ধরে ড্রাইভিং লাইসেন্স করলে ১০ থেকে ১৩ হাজার টাকা খরচ হয়। পরীক্ষায়ও অটোপাস করা যায়। তবে নিজে নিজে অনলাইনে আবেদন করা বেটার।
পরিচয় গোপন করে লিটন হোসেন নামে এক দালালের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, ১৩ হাজার টাকা দিলে ৩ থেকে ৪ মাসের মধ্যেই আপনি লাইসেন্স পেয়ে যাবেন। শুধু ফিঙ্গার দিতে হবে পরীক্ষাও দিতে হবে না। পেশাদার এবং অপেশাদার দুটি করতে একই খরচ। আমাদের কাছে দিলে দ্রুত পাবেন। ৬ হাজার টাকার রশিদ পাবেন। বাকি টাকা অফিসের বিভিন্ন জনকে দিতে হবে।
জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি ফিরোজ আলী খান বলেন, আগে তো হয়রানির শেষ ছিল না। এখন একটু ভালো হচ্ছে। ওখানে কিছু দালাল আছে ডাবল টাকা নেয় আর মানুষকে হয়রানি করে।
বিআরটিএর পাবনা অফিসের মোটরযান পরিদর্শক হাফিজুর রহমান বলেন, মানুষজন এখন ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে শুধু একবারই পাবনা বিআরটিএ কার্যালয়ে আসে। বাড়িতে বসে বা দোকান থেকে অনলাইনে ড্রাইভিং লাইসেন্সের আবেদন করে। অটোভাবে কোন দিন পরীক্ষা দিতে হবে তার মোবাইলের মেসেজ চলে যায়। তবে পাবনা অফিসে কোনো দালাল নেই বলে জানান তিনি। বিআরটিএর পাবনা অফিসের সহকারী পরিচালক আব্দুল হালিম বলেন, পাবনা অফিসে কোনো দালাল নেই। এখানে কোনো অনিয়ম হয় না। তবে পাবনায় কতটি বৈধ ও অবৈধ যানবাহন রয়েছে সেই তথ্য চাইলে তিনি তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
পুলিশ সুপার আকবর আলী মুন্সি বলেন, আসলে আমরা যখন কোনো গাড়ি ধরি তখন তার থেকে গাড়ির কাগজ ও ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখতে চাওয়া হয়। যখন কারও দেখি সে পাঁচ বছর আগে লার্নার করছে এরপর কোনো অগ্রগতি নেই তাকে আমরা সেভাবে মামলা বা জরিমানা করি। যদি কারও দেখি অল্প দিন আগে লার্নার করা তার কাগজপত্রের অগ্রগতি আছে তাকে আমরা সেভাবে কনসিডার করি।
বিআরটিএ অফিসে দালালদের দৌরাত্ম্যের বিষয়ে তিনি বলেন, ওই অফিস যদি সুনির্দিষ্ট তথ্য দেয় তাহলে পুলিশের পক্ষ থেকে দালালদের আটক করতে কোনো কার্পণ্য করা হবে না।
জেলা প্রশাসক মুহা. আসাদুজ্জামান বলেন, এ বিষয়ে খোঁজখবর নেব। দালাল চক্রের সিন্ডিকেট গড়ে ওঠার সুযোগ নেই। যদি অফিসের কর্মকর্তারা দালালদের সঙ্গে যোগসাজশ করে গ্রাহকদের হয়রানি করে থাকেন তাহলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।