শাওন সোলায়মান
প্রকাশ : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৩:৩৯ এএম
আপডেট : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৮:১৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

টেলিটকে থমকে যায় বিটিআরসির নিরীক্ষা!

দুই দশকে হয়নি একবারও
টেলিটকে থমকে যায় বিটিআরসির নিরীক্ষা!

বেসরকারি মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলোর সার্বিক কার্যক্রম প্রায় নিয়মিত অডিট বা নিরীক্ষা করে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। তবে প্রতিষ্ঠার ২০ বছর পার হলেও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন মোবাইল কোম্পানি টেলিটকের কোনো নিরীক্ষা করেনি নিয়ন্ত্রণ সংস্থা। বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও আমলাতান্ত্রিক মারপ্যাঁচে থমকে গেছে সেই প্রক্রিয়া। সরকারি ও বেসরকারি কোম্পানির ক্ষেতে বিটিআরসির এমন দ্বিমুখী আচরণ টেলিকম খাতে অসমতা তৈরি করছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

পক্ষপাতের অভিযোগ: বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০০১-এর ৩১ (২) (জ) ধারায় টেলিযোগাযোগ এবং বেতার অপারেটরদের পরিচালন পদ্ধতি (অপারেটরদের প্রক্রিয়া ও সিস্টেম) নিরীক্ষা করানো, অপারেটরগুলোর প্রতিবেদন পদ্ধতির সঠিকতা যাচাই এবং এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়ার আইনি ক্ষমতা রয়েছে বিটিআরসির। অর্থাৎ বিটিআরসি চাইলে বাহ্যিক ও স্বাধীন নিরীক্ষকের মাধ্যমে অপারেটরদের কার্যক্রম অডিট বা নিরীক্ষা করাতে পারে। একই ধারার (ছ) উপধারায় অপারেটরগুলোর যে কোনো কর্মকাণ্ড সম্পর্কে প্রতিবেদন দাখিলেরও ক্ষমতা রয়েছে বিটিআরসির। (ঝ) উপধারা অনুযায়ী, কমিশনের কার্যাবলি সম্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সব নথিপত্র এবং বহি পরিদর্শন ও পরীক্ষণের সুযোগও রয়েছে। এই ক্ষমতা প্রয়োগ করে বিভিন্ন সময়ে বেসরকারি অপারেটরদের কার্যক্রম নিরীক্ষা করে বিটিআরসি; কিন্তু টেলিটকের বেলায় যেন থমকে যায় সব কিছু।

জানা গেছে, গ্রামীণফোন এবং রবির ১৯৯৭ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সময়ের বিভিন্ন কার্যক্রম নিরীক্ষা করিয়েছে বিটিআরসি। বাংলালিংকের অডিট হয়েছে ১৯৯৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত। শুধু এই তিনটি প্রতিষ্ঠানেই বিটিআরসির অডিট আপত্তি রয়েছে ১৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। তবে ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে যাত্রা শুরু করা টেলিটকে এখনও বিটিআরসির অডিট হয়নি। এ বিষয়ে টেলিকম বিশেষজ্ঞ ও লার্ন এশিয়ার সিনিয়র পলিসি আবু সাঈদ খান কালবেলাকে বলেন, ‘নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বিটিআরসির কাছে নিরপেক্ষ ও সকল অপারেটরের প্রতি সমান আচরণ কাম্য; কিন্তু দেখা যাচ্ছে, তারা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বেলায় একরকম, আর সরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ভিন্নরকম আচরণ করছে।’

টেলিকম খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একটি মোবাইল অপারেটর থেকে লাইসেন্সিং ফি, স্পেকট্রাম ফি, সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিল এবং রেভিনিউ শেয়ারিংয়ের মতো খাত থেকে অর্থ পায় বিটিআরসি। ফলে অপারেটরগুলো থেকে এসব অর্থ সঠিক পরিমাণে আসছে কি না এবং কারও কাছে কোনো পাওনা বাকি আছে কি না—তা নির্ধারণে অডিট খুব গুরুত্বপূর্ণ।

তবে বিটিআরসি না করলে টেলিটকে অভ্যন্তরীণ ও বাইরের অডিট ফার্ম দিয়ে নিয়মিত অডিট হচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এম হাবিবুর রহমান। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘বিটিআরসি অডিট করলে সব ধরনের সহযোগিতা থাকবে। কেন অডিট করছে না, তারাই ভালো বলতে পারবে। তবে নিয়মিতভাবেই অভ্যন্তরীণ ও বাইরের অডিট ফার্ম দিয়ে অডিট করানো হচ্ছে। এ ছাড়া সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশের মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (সিএজি) দপ্তরও অডিট করে থাকে।

জানা গেছে, টেলিটকের কাছে বিটিআরসির বর্তমান পাওনা প্রায় ১ হাজার ৮৪৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। বিটিআরসি অডিট করলে এই অঙ্ক আরও বাড়বে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটির লোকসানের পেছনে কারা দায়ী—অডিট হলেও তাও বেরিয়ে আসতে পারে বলে অনেকের ধারণা।

বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘নিরপেক্ষ অডিটে কারও থলের বেড়াল বের হওয়ার আশঙ্কা থাকতে পারে। এ কারণেই টেলিটকের অডিট বাধাগ্রস্ত হচ্ছে কি না—সেটাও একটা প্রশ্ন।’

বাধাগ্রস্ত অডিট প্রক্রিয়া: কমিশনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় বারংবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও বিভিন্ন অজুহাতে টেলিটকে অডিটের প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়েছে। কমিশনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালবেলাকে জানান, সর্বশেষ গত বছরের দ্বিতীয়ার্ধে দুই দফা অডিটের প্রস্তাব দেওয়া হয়। প্রথমবার মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের চাপে আর দ্বিতীয়বার নির্বাচনের অজুহাতে তৎকালীন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার অডিট প্রক্রিয়া পিছিয়ে দেন।

তবে বিটিআরসিকে অডিটের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল—এমন দাবি করে মোস্তাফা জব্বার কালবেলাকে বলেন, ‘বিটিআরসিকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল, তারা যেন অডিট করে। তারা সেটা করেনি। এই কাজ তো আমার করার কথা না।’

আমলাতন্ত্রের ভূমিকার কারণে অডিট বন্ধ হয়েছে কি না—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রশাসন তো আমলাতন্ত্র দিয়েই চলে, সাধারণ মানুষ দিয়ে তো আর চলে না। আমলাতন্ত্র যেভাবে চিন্তা করার সেভাবেই চিন্তা করে আর প্রশাসন সেভাবেই বাস্তবায়ন করে।’

কেন এই অনীহা?: টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনের ধারা ৬(২) অনুযায়ী, কার্যত ‘সংবিধিবদ্ধ সংস্থা’ হলেও নানা বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তা অনুমোদনের জন্য ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের ওপর নির্ভরশীল বিটিআরসি। অন্যদিকে এই মন্ত্রণালয়ের সচিব পদাধিকার বলে টেলিটকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান। এ কারণে অভিযোগ উঠেছে, টেলিটকের অডিট নিয়ে উদ্যোগী হলে সচিবের বিরাগভাজন হওয়ার শঙ্কায় থাকেন বিটিআরসির কর্মকর্তারা।

এ বিষয়ে টেলিকম বিশেষজ্ঞ আবু সাঈদ খান বলেন, ‘এখন যে কাঠামোগত ব্যবস্থা তাতে বিটিআরসির মাধ্যমে টেলিটকের অডিট করানোর অর্থ হচ্ছে, অভিযুক্তকেই অভিযোগের তদন্ত করতে দেওয়া। কারণ বিদ্যমান ব্যবস্থায় এক শ্রেণির প্রকৌশলী এবং মন্ত্রণালয়ের আমলাদের মধ্যে অসাধু যোগসাজশের একটি অশুভ চক্র বিরাজমান।’

ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব এবং টেলিটকের চেয়ারম্যান একই কর্মকর্তা হওয়ায় অডিট বাধাগ্রস্ত হচ্ছে কি না এমন প্রশ্নের লিখিত জবাবে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, ‘স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির প্রশ্নে সরকার ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিতে বিশ্বাসী। আশা করি, আগামীতে টেলিকম সেক্টরকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠান করতে সক্ষম হবো।’

১৫ বছরে পারেননি ৬ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী: আওয়ামী লীগের গত ১৫ বছরের শাসনামলে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন ছয় জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী। তবে তারা কেউই নিজ দায়িত্বকালে টেলিটকে বিটিআরসির অডিট করাতে পারেননি। বিষয়টিকে অনভিপ্রেত উল্লেখ করে বর্তমান প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, ‘অন্যান্য অপারেটরদের মতো ইতোপূর্বেই টেলিটকেরও বিটিআরসির পাওনা নিয়ে নিরীক্ষা হওয়া উচিত ছিল। নিরীক্ষার জন্য বিটিআরসিকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছি। অল্প সময়ের মধ্যে বিটিআরসির পাওনা নিয়ে টেলিটকে নিরীক্ষা সম্পন্ন হবে।’

সার্বিক বিষয়ে বিটিআরসির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো মহিউদ্দিন আহমেদ কালবেলাকে বলেন, ‘এতদিন যেটা হয়নি, সেটা কী কারণে হয়নি, বলতে পারব না। তবে টেলিটকে অডিটের কার্যক্রম হাতে নিয়েছি, শিগগিরই শুরু হবে। পর্যায়ক্রমে সবারই অডিট করছি।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আজ থেকে নতুন দামে স্বর্ণ বিক্রি শুরু, ভরি কত

আফগানমন্ত্রীর ভারত সফর ঘিরে কৌতূহল

বাংলাদেশের উন্নয়নে প্রধান সমস্যা সন্ত্রাস ও দুর্নীতি : রহমাতুল্লাহ

বায়ুদূষণের শীর্ষে দিল্লি, ঢাকার অবস্থান কত

আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবস

প্রকৃতির অলংকার অনিন্দ্যসুন্দর সাতডোরা 

৫ অক্টোবর : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

পুলিশের ওপর হামলা করে আ.লীগ নেতাকে ছিনিয়ে নিলেন স্বজনরা

গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহারে রাজি ইসরায়েল : ট্রাম্প

রূপায়ণ গ্রুপে চাকরির সুযোগ, পাবেন একাধিক সুবিধা

১০

প্রেমিকার উপস্থিতিতে প্রেমিকের কাণ্ড

১১

রাজধানীতে আজ কোথায় কী

১২

বাংলাদেশের ম্যাচসহ টিভিতে আজকের যত খেলা

১৩

ঢাকায় কখন হতে পারে বজ্রবৃষ্টি, জানাল আবহাওয়া অফিস

১৪

রোববার রাজধানীর যেসব মার্কেট বন্ধ

১৫

৫ অক্টোবর : আজকের নামাজের সময়সূচি

১৬

মহাসড়কে গাড়ি থামিয়ে ডাকাতি, ক্লু পাচ্ছে না পুলিশ

১৭

পাতানো জালে আটকা নিখোঁজ বৃদ্ধের লাশ

১৮

ভারত বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা চায় না : মুশফিকুর রহমান

১৯

সিলেটে যানজট মোকাবিলায় এনসিপির ২৭ প্রস্তাবনা

২০
X