যশোরের শিল্প ও বাণিজ্য নগরী নওয়াপাড়া ভৈরব সেতু পার হলেই দোয়াপাড়া। এখানে খোলা আকাশের নিচে পড়ে আছে সরকারের কোটি টাকা ভর্তুকির সার। মাসের পর মাস ধরে পড়ে থাকা এ সারের মান নিয়েও রয়েছে সংশয়। জানা গেছে, এ সার আমদানি করেছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)। গুদামে জায়গা সংকটের কারণে জাহাজ থেকে খালাসের পর বিএডিসিকে তা বুঝিয়ে দিতে পারছেন না পরিবহন ঠিকাদার। তাই বাধ্য হয়েই কোটি টাকার সার ফেলে রাখা হয়েছে খোলা আকাশের নিচে।
শুধু দোয়াপাড়াই নয়, নওয়াপাড়া মেইন রোড ও অলিতে-গলিতে ফেলে রাখা হয়েছে এমন অসংখ্য সারের বস্তা। এ ছাড়া ফুলতলা, খুলনা, শিরোমনি, আশুগঞ্জ, কালীগঞ্জ, মুক্তারপুর, নারায়ণগঞ্জের আলীগঞ্জ, আমিনবাজার ও গাবতলীর বিভিন্ন স্থানে প্রায় ৬ থেকে ৭ লাখ টন সার ফেলে রেখেছেন পরিবহন ঠিকাদাররা। গুদাম সংকটের কারণে এই বিপুল পরিমাণ সার গ্রহণ করতে পারছে না বিএডিসি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে বিএডিসির গুদামের ধারণক্ষমতা আড়াই লাখ টনের একটু বেশি। তবে এ মুহূর্তে তাদের মজুত ৯ লাখ টনের মতো। এর মধ্যে পশ্চিমাঞ্চলে ধারণক্ষমতা ১ লাখ ৩৪ হাজার মেট্রিক টন হলেও মজুত আছে প্রায় ৩ লাখ মেট্রিক টন; কিন্তু গত দুই অর্থবছরে ধারণক্ষমতার কয়েকগুণ সার আমদানি করে বিএডিসি। গুদামে জায়গা না থাকায় আমদানি করা এই বিপুল পরিমাণ ডিএপি, টিএসপি এবং এমওপি সার এখনো পরিবহন ঠিকাদারদের কাছ থেকে নিতে পারেনি সংস্থাটি। ফলে জনগণের কোটি টাকার আমদানি করা সার এখন পড়ে আছে খোলা আকাশের নিচে।
সঠিক পদক্ষেপের অভাবে সরকারের গচ্চা : বিশ্ববাজারে সারের দাম কমছে; কিন্তু উপযুক্ত সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তের অভাবে দ্বিগুণ দামে সার কিনছে বিএডিসি। পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে সারের মৌসুম হিসেবে ধরা হয় আগস্টের মাঝামাঝি থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। গত বোরো মৌসুম শেষেও বিএডিসির কাছে ২ লাখ মেট্রিক টনের বেশি এমওপি সার মজুত ছিল। অথচ প্রয়োজন না থাকলেও মার্চ থেকে জুন মাসে আরও ১ লাখ ৬৫ হাজার মেট্রিক টন আমদানি করা হয়। ওই সার ৬০০ ডলার মূল্যে কেনা হলেও বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে এর মূল্য ৩২০ ডলার।
এদিকে সারের জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছানোর পরও মূল্য পরিশোধ না করায় নির্ধারিত সময়ে আনলোড হচ্ছে না। এতে বড় অঙ্কের জরিমানা গুনতে হচ্ছে বিএডিসিকে। সর্বশেষ গত ১৫ জুন কানাডা থেকে প্রায় ৫৫ হাজার মেট্রিক টন এমওপি সার নিয়ে এমভি স্লিপার কোপ নামে একটি জাহাজ চট্টগ্রামের কুতুবদিয়ায় পৌঁছায়। নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিদিন ৩ হাজার মেট্রিক টন খালাস করে জাহাজ ছেড়ে দিতে হবে, এই নির্ধারিত সময়ের ব্যত্যয় ঘটলে প্রতিদিন ১২ হাজার ডলার করে ক্ষতিপূরণ গুনতে হবে। অথচ জাহাজটি দেশে আসার প্রায় এক মাস হতে চললেও এখনো আমদানির টাকা পরিশোধ না করায় খালাস শুরু হয়নি। চলতি বছরে আরও একাধিক জাহাজকে সময়মতো অর্থ পরিশোধ না করায় জরিমানা গুনতে হয়েছে। অন্যদিকে সময়মতো পরিবহন ঠিকাদারদের কাছ থেকে বুঝে না নেওয়ায় তারা শত শত কোটি টাকার সার কালোবাজারে বিক্রি করে বেকায়দায় ফেলেছে বিএডিসিকে।
ভাড়ায় খাটছে বিএডিসির সার ডিলারশিপ : তদারকি না থাকায় সারা দেশে বিএডিসির অসংখ্য কাগুজে ডিলার গড়ে উঠেছে। বাস্তবে অধিকাংশ ডিলারের দেওয়া ঠিকানায় কোনো দোকান বা গুদামের অস্তিত্ব নেই। মাসিক বরাদ্দের সার সিন্ডিকেটের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে তারা। ফলে সরকারের নির্ধারণ করা মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দামে সার কিনতে হচ্ছে প্রান্তিক কৃষকদের। আবার কখনো কখনো টাকা দিয়েও সার পান না কৃষকরা। গত বোরো মৌসুমে বিএডিসির কাছে পর্যাপ্ত এমওপি সার মজুত থাকলেও সারা দেশে কৃষক তা পাননি। অনেককেই বেশি দাম দিয়ে খোলা বাজার থেকে কিনতে হয়েছে।
বিএডিসি পশ্চিমাঞ্চলের দায়িত্বরত যুগ্ম পরিচালক (সার) লিয়াকত আলী বলেন, বিএডিসি আপৎকালীন সময়ে দায়িত্ব পালন করে। তাই চাহিদার চেয়ে বেশি সার মজুত থাকে। গত বছর আমাদের বরাদ্দ ছিল না, তারপরও আমদানি হওয়ায় গুদাম সংকটের কারণে সার পরিবহন ঠিকাদারের কাছে রয়েছে। এসব সার দ্রত গুদামে নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে বিএডিসির জেনারেল ম্যানেজার ওবায়দুল ইসলাম বলেন, এসব বিষয়ে আমি কোনো ধরনের বক্তব্য দিতে পারব না। সরকারি নিয়মে মিডিয়া সেলের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন তিনি।
মন্তব্য করুন