প্রস্তাবিত বাজেটটি প্রাথমিকভাবে দেখে একে বাস্তবতার প্রতি অনেকটাই সংবেদনশীলই মনে হচ্ছে। একই সঙ্গে এ বাজেটটিতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আরেকটু কল্যাণমুখী হওয়ার সুযোগ যে ছিল সেটিও মানতে হবে। ২০১৯-২০-এ বাংলাদেশের প্রস্তাবিত বাজেট ছিল ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা, যা ২০২৩-২৪-এ এসে বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৭ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকার বেশিতে। অর্থাৎ এ সময়কালে গড়ে বছরে বাজেটের আকার বেড়েছে ৭.৬ শতাংশ হারে। আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরেও চলতি বছরের প্রস্তাবিত চেয়ে বাজেট বেড়েছে। তবে আগের হারে বাড়েনি। মাত্র ৪.৬ শতাংশ বেড়ে ৭ লাখ ৯৭ হাজার টাকা হয়েছে। ফলে বাস্তবতার প্রতি সংবেদনশীল বাজেট-প্রণেতারা সংকোচনের পথেই এগোতে চাইছেন, তা দৃশ্যমান।
মুদ্রানীতির সঙ্গে সমন্বয় করে রাজস্বনীতিকে সংযত রাখার অংশ হিসেবে বাজেট ঘাটতি ৪.৫ শতাংশ রাখার আকাঙ্ক্ষাটিও বাস্তবতার নিরিখে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য। তবে ৬.৭৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা উচ্চাভিলাষী। মূল্যস্ফীতির হার সাড়ে ৩ শতাংশের মতো কমিয়ে সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা মোটেও সহজ হবে না। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য বাজেট ঘাটতি আরও কমিয়ে ব্যাংক খাত থেকে ঋণের পরিমাণ কমানোর কোনো বিকল্প নেই।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো সামাজিক খাতে বরাদ্দ, কৃষির জন্য বরাদ্দ এবং বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে সহায়ক খাতে/কর্মসূচিতে/প্রকল্পে বরাদ্দে এ কাটছাঁটের প্রভাব যতটা সম্ভব কম ফেলা যায় ততই কল্যাণকর। প্রায় এক দশক ধরেই আমাদের মোট জাতীয় বাজেটের ১৫-১৭ শতাংশ যাচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাবদ। বরাদ্দের এ ধারাবাহিকতার প্রভাবেই দারিদ্র্য ও অতিদারিদ্র্য হার নাটকীয় মাত্রায় কমিয়ে আনা গেছে। এবারও বাজেটের ১৭ শতাংশের বেশি বরাদ্দ রাখা হয়েছে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাবদ। তবে লাগামহীন মূল্যস্ফীতির হাত থেকে নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে এখানেও বরাদ্দের ক্ষেত্রে কিছুটা প্রবৃদ্ধি আশা করেছিলাম। মূল্যস্ফীতি যেহেতু ১০ শতাংশের আশপাশে, তাই সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির জন্য বরাদ্দ অন্তত ১০ শতাংশ বাড়ালে কার্যক্রমটির উপকারভোগীরা মূল্যস্ফীতি মোকাবিলার জন্য যথেষ্ট জোর পেত।
মোট রাজস্ব আদায়ে ৫ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকার যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটি সময়োচিত মনে করলেও এ লক্ষ্য বাস্তবায়ন খুবই চ্যালেঞ্জিং হবে। সব মিলিয়ে প্রাথমিক বিচারে এবারের বাজেটটি অনেকটাই বাস্তবমুখী ও সময়োচিত হিসেবেই দেখতে হবে। তবে যেহেতু অনেকখানি কাটছাঁট করতে হয়েছে, তাই এ সংকুচিত বাজেট বাস্তবায়নে আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি দক্ষতা ও নিষ্ঠার পরিচয় দিতে হবে।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, উন্নয়ন সমন্বয়; সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক