শেখ হারুন
প্রকাশ : ২৭ জুন ২০২৪, ০২:৫৪ এএম
আপডেট : ২৭ জুন ২০২৪, ০৮:২৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ব্যর্থতার নতুন রেকর্ড এডিপি বাস্তবায়নে

১১ মাসে বাস্তবায়ন হার মাত্র ৫৭.৫৪%
ব্যর্থতার নতুন রেকর্ড এডিপি বাস্তবায়নে

চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে চলছে খরা। নানা উদ্যোগের কথা বলা হলেও কোনো উন্নতির লক্ষণ নেই। বরং প্রকল্পে ধীরগতির কারণে অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে এডিপি বাস্তবায়ন হার নেমে এসেছে সর্বনিম্ন পর্যায়ে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে ৫৭ দশমিক ৫৪ শতাংশ। অর্থবছর শেষ হতে বাকি আর মাত্র এক মাস। এই সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে হবে ৪৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ। এমনকি করোনার সময় ছাড়া এর আগে কখনো এত কম এডিপি বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে চলতি অর্থবছর শেষে ইতিহাসে সর্বনিম্ন এডিপি বাস্তবায়নের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলতি অর্থবছর এডিপির শতভাগ বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। কয়েক বছর ধরে একই চিত্র দেখা গেলেও বাস্তবায়নের দিকে কোনো পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে না।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ১১ মাসের এডিপি বাস্তবায়নের অগ্রগতি প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে। গতকাল বুধবার এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আইএমইডি। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বরাদ্দের হিসাবে কয়েকটি মন্ত্রণালয় ছাড়া বেশিরভাগই তাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারছে না।

বিশ্লেষকরা বলছেন, অর্থবছরের ১১ মাসে যেখানে এডিপি কর্মসূচির অর্ধেক বাস্তবায়ন হয়েছে, সেখানে মাত্র এক মাসে কী করে পুরো বাস্তবায়ন করা সম্ভব। প্রতি বছরই শেষ সময়ে তাড়াহুড়া করে বাস্তবায়ন হার বাড়ানো হয়। এতে কাজের মান ঠিক থাকে না। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে জবাবদিহির আওতায় না আনলে শতভাগ এডিপি বাস্তবায়ন কোনো অর্থবছরেই সম্ভব নয়।

বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. এমকে মুজেরী কালবেলাকে বলেন, ‘প্রতি বছর বড় আকারের এডিপি নেওয়া হয়; কিন্তু দেখা বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয় না। এতে প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি দেখা দেয় এবং লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী সুফল পাওয়া যায় না। এ ছাড়া প্রথম দিকে কম থাকলেও শেষ দিকে তড়িঘড়ি করে বাস্তবায়ন হার বাড়ানো হয়। এতে গুণগত মান ঠিক থাকে না। এডিপি বাস্তবায়ন হার বাড়াতে সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হলেও বাস্তবায়নের কোনো পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে না। এজন্য এডিপির আকার বড় করা চেয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের দক্ষতা বাড়ানো জরুরি।’

ধীরগতির এডিপির বিষয়ে আইএমইডি সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন কালবেলাকে বলেন, ‘গত অর্থবছরের তুলনায় এবার এডিপি বাস্তবায়ন কম হয়েছে, এটা ঠিক। আমরা আশা করেছিলাম গত অর্থবছরের তুলনায় বেশি হবে। কিন্তু শেষ সময়ে এসে মনে হচ্ছে এবার এডিপি বাস্তবায়ন হার কম হবে। তিনি বলেন, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে বাস্তবায়ন হার কম হতে পারে। তবে বাস্তবায়ন হার বাড়ানোর বিষয়ে জোর দেওয়া হচ্ছে। দ্রুত প্রকল্প বাস্তবায়নেও জোর দিতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর পরও কেন কম হচ্ছে, সেটা বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে।’

পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের এডিপিতে ১ হাজার ৬৪৭ প্রকল্পের বিপরীতে বরাদ্দ রয়েছে ২ লাখ ৫৪ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। প্রথম ১১ মাসে ৫৮ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের তত্ত্বাবধানে থাকা এসব প্রকল্পের বিপরীতে খরচ হয়েছে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৭৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা, যা বরাদ্দের ৫৭ দশমিক ৫৪ শতাংশ।

গত ২০ অর্থবছরের ১১ মাসের এডিপি বাস্তবায়নের চিত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, করোনার সময় ছাড়া চলতি অর্থবছরের মতো এত কম এডিপি বাস্তবায়ন আর কখনো হয়নি। ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছিল ২০১৯-২০ এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে। ওই অর্থবছর একই সময়ে বাস্তবায়ন হার ছিল ৫৭ দশমিক ৩৭ শতাংশ। আর ২০২০-২১ অর্থবছরে ছিল ৫৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ, যা চলতি অর্থবছরের চেয়েও প্রায় ১ শতাংশ বেশি। অর্থবছরের ১১ মাসে কখনো ৬০ শতাংশের নিচে নামেনি এডিপি বাস্তবায়নের হার। এমনকি গত অর্থবছরেও বাস্তবায়ন হার ছিল ৬১.৭৩ শতাংশ।

এমনকি অর্থবছর শেষে আগের বছরগুলোর অধিকাংশ সময় এডিপি বাস্তবায়ন হার ছিল ৯০ শতাংশের ওপর। শুধু করোনার সময়সহ মাত্র ৫ অর্থবছরে বাস্তবায়ন হার ছিল ৮০ শতাংশের কাছাকাছি। সেই হিসাবে চলতি অর্থবছরের ১১ মাসে এডিপি বাস্তবায়ন হার যেখানে মাত্র ৫৭ শতাংশ, সেখানে বাকি এক মাসে আগের অর্থবছরগুলোর মতো বাস্তবায়ন করা অসম্ভব। অর্থাৎ অর্থবছরের শেষে শতভাগ বাস্তবায়ন তো দূরের কথা, ইতিহাসে সর্বনিম্ন এডিপি বাস্তবায়ন হতে পারে চলতি অর্থবছরে।

আইএমইডির প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত ২০ অর্থবছর শেষে সবচেয়ে বেশি এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছিল ২০১৭-১৮ এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে। এই দুই অর্থবছরের বাস্তবায়ন হার ছিল যথাক্রমে ৯৪ দশমিক ১১ এবং ৯৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ। বাকি অর্থবছরগুলোর মধ্যে পাঁচটি ছাড়া অন্যগুলোতে বাস্তবায়ন হার ছিল শতাংশের ওপরে। এমনকি অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও গত অর্থবছরে এডিপি বাস্তবায়ন হার ছিল ৮৫ শতাংশের ওপরে।

এদিকে সামগ্রিকভাবে এডিপি বাস্তবায়ন হারের সঙ্গে মাসের হিসাবে চলতি অর্থবছরের মে মাসে গতবারের তুলনায় কম বাস্তবায়ন হয়েছে। তথ্যানুযায়ী, শুধু মে মাসে এডিপি বাস্তবায়নে খরচ হয়েছে ২১ হাজার ৫৯ কোটি ৮২ লাখ টাকা। অর্থাৎ এ সময় বাস্তবায়নের হার ৮ দশমিক ২৮ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরের মে মাসে খরচ হয় ২৬ হাজার ৯৫৭ কোটি ৫১ লাখ টাকা, যা বরাদ্দের ১১ দশমিক ৪০ শতাংশ। অর্থাৎ মাসের হিসাবে বাস্তবায়ন ৩ শতাংশেরও কম হয়েছে।

আইএমইডির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাস্তবায়ন হারে সবচেয়ে পিছিয়ে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবেশ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, পরিসংখ্যান ও সরকারি কর্মকমিশনের বাস্তবায়ন হার। এ ছাড়া কয়েকটি বাদে অন্য মন্ত্রণালয় এবং বিভাগগুলোও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ৪৩ দশমিক শূন্য ৩ এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ ৪৭.৩৭ শতাংশ বাস্তবায়ন করেছে। কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ ৪৫.৭৬ শতাংশ এডিপি বাস্তবায়ন করেছে।

এ ছাড়া ১১ মাসে ৪০ শতাংশও এডিপি বাস্তবায়ন করতে পারেনি সাতটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। এর মধ্যে সবচেয়ে কম এডিপি বাস্তবায়ন করেছে পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ, বাস্তবায়ন করেছে ২৭ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ করেছে ২৮.৪৮ শতাংশ, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় ৩০ দশমিক শূন্য ৩, বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন ৩২ দশমিক ৯৬ শতাংশ, পরিবেশ ও জলবায়ু মন্ত্রণালয় ৩৩.৭২ এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ ৩৪.৭৬ শতাংশ এডিপি বাস্তবায়ন করেছে।

চলতি অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি এডিপি বাস্তবায়ন করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থাটি ১১ মাসে বাস্তবায়ন করেছে মোট বরাদ্দের ৯৬ দশমিক ৮৫ শতাংশ। এ ছাড়া জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ ৯২ দশমিক ১৪, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ ৮৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ ৭৯ দশমিক শূন্য ৬, বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ ৭৬ দশমিক ৭৫ এবং সুরক্ষা ও সেবা বিভাগ ৭৩.০৯ শতাংশ এডিপি বাস্তবায়ন করেছে।

শতাংশের হিসাবে বাস্তবায়নে পিছিয়ে থাকলেও টাকা খরচে এগিয়ে রয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। বিভাগটির ২৬৩ প্রকল্পের বিপরীতে বরাদ্দ ছিল ৪২ হাজার ৯৫৬ কোটি ৭১ লাখ টাকা। ১০ মাসে ব্যয় হয়েছে ২৩ হাজার ৭৬২ কোটি ২৬ লাখ টাকা, যা ৫৫ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থান বিদ্যুৎ বিভাগের, খরচ করেছে ২০ হাজার ৭৬২ কোটি ২৬ লাখ টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৬৮ দশমিক ২৯ শতাংশ।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বাংলাদেশি পোশাক খাতে দুই মাসে ক্রয়াদেশ বেড়েছে ৩২ শতাংশ

গরম পানি পান করলে কি সত্যিই ওজন কমে?

অবশেষে বিচ্ছেদ নিয়ে মুখ খুললেন সোহেল খান

যৌবন ধরে রাখতে সার্জারি করেছেন রোনালদো, দাবি সার্জনের

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে জাতিসংঘের বিশেষ দূতের সাক্ষাৎ

ওয়ানডেতেও অধিনায়ক হচ্ছেন গিল!

যুক্তরাষ্ট্রে ‘বেস্ট হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাওয়ার্ড’ পেলেন মিলন

ড্রাগন ফল কারা খেতে পারবেন না জানালেন পুষ্টিবিদ

সুনামগঞ্জে ভুয়া এনএসআই সদস্য গ্রেপ্তার

সাবেক জিএস গোলাম রাব্বানীর পদ-ছাত্রত্ব বাতিলের দাবি রাশেদের

১০

ব্যক্তিগত মিলে মজুত করা ছিল সরকারি চাল

১১

অনূর্ধ্ব-১৭ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ / ভারতের বিপক্ষে বিকেলে মাঠে নামছে বাংলাদেশ

১২

সড়কে খানাখন্দ, দুর্ভোগ লাখো মানুষের

১৩

নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি মানসী

১৪

কলকাতায় টানা ৩ দিন দুর্যোগের সতর্কতা

১৫

২০২৭ ওয়ানডে বিশ্বকাপ : কোন দেশে কত ম্যাচ জানিয়ে দিল আইসিসি

১৬

সপ্তাহের সেরা সরকারি চাকরির বিজ্ঞপ্তি, পদ প্রায় ১৬০০

১৭

ঢাকায় বৃষ্টি নিয়ে আবহাওয়া অফিসের বার্তা

১৮

জুমার খুতবার সময় কি মোবাইল ব্যবহার করা যাবে?

১৯

দুপুরের মধ্যে ৭ জেলায় হতে পারে বজ্রবৃষ্টি

২০
X