রাজধানীর শাহবাগে সড়কগুলোর বদলে যাওয়া দৃশ্য দেখা গেল গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে। দেখে বোঝার উপায় নেই, এটি নগরীর অন্যতম ব্যস্ততম এলাকা। উল্টোপথে যানবাহনের চলাচল কিংবা যানজট কোনোটাই নেই। মোটরসাইকেলে হেলমেট ছাড়া বের হলেই দিতে হচ্ছে যৌক্তিক ব্যাখ্যা, শুনতে হচ্ছে ভর্ৎসনা। ট্রাফিক পুলিশের অনুপস্থিতিতে ঢাকার সব সড়কে শৃঙ্খলা রক্ষায় এভাবেই শক্তহাতে হাল ধরেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। গতকাল তৃতীয় দিনের মতো ট্রাফিক পুলিশের ভূমিকায় ছিলেন স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা। তাদের কর্মতৎপরতায় সড়ক হয়ে ওঠে প্রত্যাশিত সুশৃঙ্খল। এতদিন যেসব সড়কে দীর্ঘক্ষণ যানজট লেগে থাকত সেখানেও ফিরেছে গতি। পাশাপাশি বেড়েছে আইন মানার প্রবণতাও। যদিও গতকাল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় যুক্ত হন আনসার ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরাও। শুধু সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতেই নয় রাস্তাঘাট, দেয়ালসহ শহীদ মিনার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজেও ব্যস্ত ছিলেন শিক্ষার্থীরা। নেমে পড়েন বাজার মনিটরিংয়েও।
মহান মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের জন্য সব গণআন্দোলনেই সামনের সারিতে থেকে লড়াই করেন শিক্ষার্থীরা। এবারের গণঅভ্যুত্থানেও নেতৃত্ব দিয়েছেন তারাই। বিজয়ের পর শিক্ষার্থীরা যেন ফিরেছেন বীরের বেশে। পরিবর্তন আনতে এবং নতুন দেশ গড়ার প্রত্যাশায় কর্মযজ্ঞ শুরু করেছেন তারা।
এই দুঃসাহসীরা দেশের মিনারে মিনারে পরিষ্কার করছেন রক্তের ফোঁটা, দেয়াল লিখন, হিংস্র গল্পের দাগ। নতুন করে রাঙানো হচ্ছে দেয়াল। এক শিক্ষার্থী বলেন, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সবাই মিলে কাজ করছি। বলতে গেলে দেশ নতুন করে স্বাধীন হয়েছে, তাই দেশকে সুন্দর করে রাখার দায়িত্ব আমাদের।
গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, টানা কয়েকদিনের অস্থিতিশীলতার পর স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে জনজীবন। খুলেছে দোকানপাট। সড়কগুলোয় বেড়েছে যান চলাচল। কিছু মূল সড়কে গাড়ির চাপও ছিল। মাথায় জাতীয় পতাকা এবং গলায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আইডি কার্ড নিয়ে ট্রাফিক সিগন্যালে ঘাম ঝরাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। তাদের বাঁশি আর হাতের ইশারায় চলছে নগরের সব যানবাহন। সড়ক পারাপারের ক্ষেত্রে পথচারীদের অনুরোধ জানাচ্ছেন ওভারব্রিজ ব্যবহারের। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললেও রাজধানীতে উপস্থিতি একেবারেই কম। গতকালও যে শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন, তাদের স্বল্প সময় ক্লাস করিয়ে ছুটি দেওয়া হয়। যদিও এখনো অভিভাবকরা নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকায় সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে সাহস পাচ্ছেন না।
কারওয়ান বাজারে প্ল্যাকার্ড হাতে মিছিল করতে করতে কাঁচাবাজারের ভেতর দিয়ে যেতে দেখা যায় একদল শিক্ষার্থীকে। প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল—‘সিন্ডিকেট নিপাত যাক, কারওয়ান বাজার মুক্তি পাক’, ‘চাঁদাবাজির দিন শেষ, গড়ব সোনার বাংলাদেশ’ ইত্যাদি। কয়েকটি স্থানে মিছিল থামিয়ে তারা ব্যবসায়ীদের বলেন, ‘আপনারা আর কাউকে চাঁদা দেবেন না’, ‘সবাই মিলে সিন্ডিকেটমুক্ত বাজার গড়তে এগিয়ে আসুন’। এই তরুণদেরই আবার দেখা যায় রাত জেগে এলাকা পাহারা দিতে এবং সংসদ ভবন পরিষ্কার করতে। তারাই গণভবনের লুট হওয়া জিনিসপত্র সংগ্রহ করে সেনাবাহিনীকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। দেয়ালে, বিভিন্ন স্তম্ভে আঁকছেন নতুন দিনের রঙিন গ্রাফিতি।
সড়কে আড়াআড়ি দাঁড়িয়ে থাকা কিংবা যেখানে সেখানে রাস্তার মাঝখানে থামিয়ে বাসের যাত্রী তোলার দৃশ্যে অনেকটাই অভ্যস্ত হয়ে ছিল রাজধানীর সাধারণ মানুষ। প্রতিবাদ করলেও ফল মেলেনি। সেই পরিচিত দৃশ্য এবার বদলে দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। গতকাল শহরের কোথাও অকারণে দাঁড়াতে পারেনি কোনো গণপরিবহন। চলতে হয়েছে লেন মেনে। যত্রতত্র যাত্রীও তুলতে পারেননি চালকরা।
সড়কে দায়িত্ব পালন করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রিমন মাহমুদ কালবেলাকে বলেন, সবাই আমাদের সহযোগিতা করছেন। সেনাবাহিনীর সদস্যরাও স্যালুট দিচ্ছেন। অভিভাবকরা সাপোর্ট দিচ্ছেন। এ কাজের মাধ্যমে ভিন্নতর অভিজ্ঞতা অর্জনের পাশাপাশি নিজেদের ভেতরেও সচেতনতার ভিত তৈরি হচ্ছে।
বাসচালকদের এতদিনের অভ্যাস রাতারাতি বদলে যেতে দেখে অবাক বেসরকারি চাকরিজীবী লুৎফর রহমান। আগারগাঁও মোড়ে যখন তার সঙ্গে কথা হচ্ছিল, কথায় ঝরে পড়ছিল বিস্ময়। সাভার থেকে আগারগাঁও আসার পথে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের মিলেমিশে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করতে দেখেছেন। তিনি জানান, চাকরির প্রয়োজনে রোজ তাকে এ পথে আসতে হয়। কিন্তু বাসচালকদের স্বেচ্ছাচারিতার সবসময় ভুগতে হতো। মাঝরাস্তায় যাত্রী তোলার কারণে পড়তে হতো যানজটে।
লুৎফর বলেন, চালকরা আড়াআড়িভাবে রাস্তার মাঝখানে বাস দাঁড় করিয়ে পুরো সড়ক বন্ধ করে বসে থাকত। ট্রাফিক পুলিশ থাকলেও এগুলো দেখার যেন কেউ ছিল না; কিন্তু এখন কী সুন্দর রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে যাত্রী তুলছে তারা। তাদের আজীবনের বদঅভ্যাস একদিনেই বদলে দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
আগারগাঁওয়ে সড়কের শৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করছিল শেরেবাংলা নগর সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো. জিহাদ। ষষ্ঠ শ্রেণির এই শিক্ষার্থী ইউনিফর্ম পরেই দাঁড়িয়ে পড়েছে দায়িত্ব পালনে। দুপুর ২টার দিকে রোদ আর গরম উপেক্ষা করেই কাজ করতে দেখা গেল ছোট্ট জিহাদকে। সে জানায়, সকাল ১১টায় এসেছে। আরও কিছুক্ষণ থাকবে। কেউ আসতে বলেনি তারপরও আসছি। সবার সঙ্গে মিলেমিশে ভালো কাজ করতে পেরে আমি গর্বিত।
পুরান ঢাকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বাহাদুর শাহ পার্ক, সদরঘাট, লক্ষ্মীবাজার, ধোলাই খাল এলাকার বিভিন্ন মোড়ে ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায় শিক্ষার্থীদের। একরামুল নামে একজন বলেন, অনেক কষ্ট ও ত্যাগের বিনিময়ে আন্দোলনে সফলতা পেয়েছি। যতটুকু পারি দেশের ভালোর জন্য কাজ করতে চাই। সড়কে শৃঙ্খলা মানলে সবারই লাভ। কাউকেই যানজটে আটকে থাকতে হবে না। তাই সাধারণ মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করছি।
সড়ক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করা শিক্ষার্থীদের কাছে পানিসহ শুকনো খাবার পৌঁছে দিচ্ছিলেন শেরেবাংলা নগর সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র রিয়াদুল ইসলাম। কেউ পানি বা খাবার চাইলেই সড়কের পাশে স্তূপ করে রাখা বোতল-প্যাকেট হাতে দৌড়ে যাচ্ছিলেন। রিয়াদুল বলেন, আজ সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অসাধারণ ভালোবাসা পাচ্ছি। সড়কে শিক্ষার্থীদের দেখে ব্যক্তি উদ্যোগে অনেকে পানি ও খাবার দিয়ে গেছেন। অনেকে গাড়ি থামিয়ে খোঁজখবর নিচ্ছেন, অনেকে সাধুবাদ জানাচ্ছেন। এসব দেখে পরিশ্রমের কথা ভুলে গেছি।
মোহাম্মদপুরের সড়কে শৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করতে দেখা গেল স্থানীয় মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের। সাতমসজিদ মাদ্রাসার শিক্ষার্থী হাসিবুল ইসলাম জানান, ট্রাফিক পুলিশ না থাকায় জ্যাম লেগে সবাই কষ্ট পাচ্ছিল। মানুষের সেই কষ্ট লাঘবে সবার সঙ্গে আমরা মাদ্রাসার ছাত্ররাও সড়কে নেমেছি।
শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে খুশি অনেক বাসচালক। মোহাম্মদপুর থেকে আব্দুল্লাহপুর রুটে চলাচলকারী প্রজাপতি পরিবহনের চালক মো. হাসেম কালবেলাকে বলেন, ট্রাফিক পুলিশও কোনো সময় মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডের জ্যাম কমাইতে পারেনি। প্রতিদিন এই এলাকা পার হইতে ঘণ্টাখানেক লাগত; কিন্তু ছাত্ররা জ্যাম লাগার সুযোগই দেয়নি। এখন বুঝলাম সবাই নিয়ম মানলে রাস্তা ক্লিয়ার রাখা সম্ভব।
মহাখালী বাস টার্মিনাল এলাকায় সড়কের শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে কাজ করছিলেন সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী আবু সিয়াম। তিনি বলেন, কোনো যানবাহনকেই উল্টোপথে চলতে দিচ্ছি না। যারা চেষ্টা করছে তাদেরও বুঝিয়ে সঠিক পথে পাঠাচ্ছি।
এদিকে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে বাজার মনিটর করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। ভোক্তার ডিজি এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘ছাত্রদের বাজার মনিটরকে সাধুবাদ জানাই। এরপর তাদের নিয়ে আমরাও বাজার মনিটর করতে চাই।
সে সময় ভোক্তার ডিজি শ্যামবাজারের কয়েকটি আড়ত ঘুরে দেখেন এবং ট্রাক চালকদের সঙ্গে কথা বলেন। তখন অভিযোগ করে চালকরা জানান, শ্যামবাজার থেকে কারওয়ান বাজারে যেতে সিটি করপোরেশনকে ১০০ টাকা করে মোট ৩০০ টাকা দিতে হয়। উত্তরে ভোক্তা ডিজি জানান, শ্যামবাজার থেকে যত ট্রাক যেত, এখন থেকে প্রতি বস্তায় ১ টাকা করে কম রাখা হবে। আগে ১১ টাকা দিতে হতো। এটা সরকারি আদেশ।