রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব মোড়ে পুলিশ বক্সের পাশে কালো রঙের একটি ব্যানার। এতে লেখা ‘শহীদ মো. শুভ’। এখানেই ফুটপাতে রিকশা মেরামতের কাজ করতেন ১৯ বছরের তরুণ শুভ। বাড়তি আয়ের আশায় ফ্লাক্সে করে চাও বিক্রি করতেন। বাবা ওদের ছেড়ে যাওয়ায় ছোটবেলা থেকেই মা ও ভাইবোনদের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন শুভ। গত ১৮ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে গিয়ে মাথায় গুলিবিদ্ধ হন তিনি। পরদিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ভোর ৪টায় মারা যান। ১৮ জুলাই। দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। সেদিনও দোকান খোলে শুভ। পরে মা নিষেধ করলে দোকান বন্ধ করে দেন। কিন্তু মায়ের কাছে শুভ বায়না ধরেন ছাত্রদের আন্দোলনে যাবে। শুভ মাকে বলেছিলেন, ‘এই ছাত্রদের মতো আমিও তো দেশের একজন নাগরিক। মা, আমিও ওদের সঙ্গে মিছিলে যাব।’ সেদিন বিকেল ৪টায় হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া একটি গুলি শুভর ডান দিকের কপাল ঘেঁষে মাথায় বিদ্ধ হয়। ১৯ বছরের ছেলেকে হারিয়ে মা রেনু বেগম এখন নিজেই রিকশা-সাইকেল মেকানিকের কাজ শুরু করেছেন। গতকাল শনিবার সায়েন্স ল্যাবের মোড়েই পাওয়া যায় তাকে। ছেলের কথা জিজ্ঞেস করতেই রেনু বেগমের চোখ ছলছল। সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, একটি হেলিকপ্টার ওপর দিয়ে উড়ে যায়। এর পরই দেখি একটি ছেলে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তখনো আমি জানি না, যে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে, সে আমারই ছেলে। আমি রাস্তার এপার থেকে এই দৃশ্য দেখে বলি, কার মায়ের ছেলে যেন পড়ে
গেছে, তোমরা একটু ধরো। দৌড়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি, সে আর কেউ নয়, আমারই ছেলে। কপাল ঘেঁষে মাথার ডান পাশে গুলি লাগায় রক্তে ভেসে যাচ্ছে রাস্তা। ছেলেকে ওভাবে পড়ে থাকতে দেখে চিৎকার করে তার বুকে পড়ি। ছাত্ররা ভয়ে ওর কাছে আসেনি প্রথম। আমার কান্না দেখে কয়েকজন ছাত্র ওকে ধরে পপুলার হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে চিকিৎসকরা কোনো সেবাই দেননি। তারা বলেন, ‘এই চিকিৎসা এখানে করা সম্ভব না। এখানে অনেক টাকা লাগবে।’ তারা ওকে ভর্তি না করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে বারান্দার মেঝেতে ফেলে রাখে আমার ছেলেকে। রক্তে ভেসে যায় মেঝে। রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে ডাক্তারের হাতে-পায়ে ধরি। আকুতি-মিনতি করি ছেলেটাকে দেখার জন্য। ডাক্তাররা আমারে ঠেইল্যা বাইর কইরা দেয়। এই চলল কিছুক্ষণ, ডাক্তারের হাতে-পায়ে ধরা। বড় মেয়ে শেষমেশ অনুনয়-বিনয় করে, আপনারা আমার ভাইয়ারে একটু চিকিৎসা দেন। ডাক্তাররা মেয়ে আর আমাকে ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দেয়। এক ডাক্তার বলেন, আপনারা এখান থেকে যান। এই রোগীর কোনো চিকিৎসা হবে না। অনেক কান্নাকাটির পর অবশেষে বেডে নিয়ে শোওয়ায়। তখনো রক্ত ঝরছে। বিকেল ৪টায় গুলি লাগছে। শেষমেশ ডাক্তারের পা ধরে বলি, আপনি আমার ধর্মের মা লাগেন। আমার ছেলেটারে বাঁচান। ডাক্তার আমারে বলেন, ‘আমাদের করার কিছুই নেই। আমাদের ওপর থেকে নির্দেশ রয়েছে কোনো রোগী না ধরার। আমারে মাফ করে দাও। অনুনয়বিনয় করায় তারা ওকে রাত ১০টার দিকে আইসিইউতে নিয়ে যায়। রেনু বেগম বলেন, সেখানে নিয়েও কোনো চিকিৎসা নেই, রক্ত ঝরছে। আমাকে কিছু ওষুধ লিখে দেয় নিয়ে আসার জন্য। ওষুধ এনে দিই। রক্ত এনে দিতে বলে। এক ব্যাগ রক্ত এনে দিই। রক্ত ওর শরীরে ঢোকে। পরদিন ভোর ৪টা ১০ মিনিটে জানায়, আপনার ছেলে নাই। আমি বললাম, ছেলে মারা গেছে! ওর শরীরে তো রক্ত গেছে। ও মারা গেলে রক্ত গেল কীভাবে! এ কথা বলায় ডাক্তার ওই ঘর থেকে ঠেইল্যা বের করে দেয় আমারে। ছেলের মৃত্যু সংবাদে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। আমার মেয়েরা ধানমন্ডি থানায় আসে। দারোগা হাসপাতাল থেকে লাশ আনার জন্য সই দেয় নাই। ছোট মেয়েটা মানুষের কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা উঠিয়ে নিউমার্কেট থানার দারোগাকে ৫ হাজার টাকা দেয়। এরপর দারোগা জিডি নিয়ে সই দিলে আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে পরদিন রাত ১০টায় লাশ বের করতে পারি। আজিমপুর কবরস্থানে ছেলেকে দাফন করি। ডাক্তার সঠিক সময়ে চিকিৎসা করলে ছেলেটাকে বাঁচাতে পারতাম।