জাফর ইকবাল
প্রকাশ : ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৩:০২ এএম
আপডেট : ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:০৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

চুক্তি করে মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়াই তার পেশা!

বহুরূপী প্রতারক জন
চুক্তি করে মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়াই তার পেশা!

আয়ের দৃশ্যমান কোনো উৎস নেই তার। তবু চালচলনে ও দিনযাপনে বিলাসিতার ছাপ। ঘোরেন দামি গাড়িতে। রাস্তায় বের হলে তার গাড়ি ঘিরে থাকে অনুগতদের মোটরসাইকেলের বহর। কেউ তাকে চেনেন ডিবি কর্মকর্তা হিসেবে, কারও কাছে তার পরিচয় পুলিশ অফিসার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সোর্স হিসেবেও পরিচিতি আছে তার। কখনো কখনো নিজেকে জাহির করেন বিরাট ক্রাইম রিপোর্টার হিসেবেও। বহুরূপী এই প্রতারকের নাম এবিএম মাহমুদুল বশ্রী ওরফে জন। প্রতারণার মাধ্যমে যাকে তাকে মামলায় ফাঁসিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেওয়াই তার মূল পেশা। এ ছাড়া নারীদের দিয়ে আপত্তিকর ভিডিও ধারণ করেও ফাঁদে ফেলেছেন অনেককে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিবিড় সখ্য রয়েছে জনের। সেই সখ্য পুঁজি করে চুক্তিতে বিভিন্নজনকে মামলায় ফাঁসিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন মোটা অঙ্কের টাকা।

চলতি বছরের ১৯ মার্চ বেসরকারি আশা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতির পদ বাগিয়ে নেন জন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বহুরূপী এই প্রতারক হাজির হয়েছেন নতুন রূপে। বনে গেছেন বিএনপির একনিষ্ঠ সমর্থক। বিএনপির বড় বড় নেতার সঙ্গে তোলা ছবি আজকাল শেয়ার করছেন সামাজিক মাধ্যমে। এ নিয়ে চলছে মুখরোচক আলোচনা।

কে এই জন শেরপুর জেলার ধোবারচর গ্রামের আ. বারেক ও মমতাজ বেগম দম্পতির সন্তান এবিএম মাহমুদুল বশ্রী ওরফে জন। উচ্চশিক্ষার লক্ষ্য নিয়ে এসেছিলেন ঢাকায়। ভর্তি হয়েছিলেন শ্যামলীর আশা ইউনিভাসির্টির আইন বিভাগে। এরপর মাদকে জড়িয়ে শিকেয় ওঠে পড়াশোনা, পা রাখেন অপরাধ জগতে। শুরুতে পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করেছেন। সেই সূত্রে পুলিশের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। সেই সখ্য পুঁজি করে হয়ে ওঠেন বেপরোয়া। র‌্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থার সোর্স পরিচয় দিয়ে করতে থাকেন একের পর এক প্রতারণা। একপর্যায়ে শিহাবুল ইসলাম সয়ন ও আল কাইয়ুম নামে দুজনকে নিয়ে গড়ে তোলেন প্রতারক চক্র। একপক্ষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে অন্যপক্ষের লোকজনকে অস্ত্র কিংবা মাদকের মামলায় ফাঁসিয়ে দিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়াই এই চক্রের প্রধান কাজ। এ ছাড়া নারী দিয়ে ফাঁসিয়ে ধর্ষণ মামলার আসামি করার ভয়

দেখিয়েও টাকা নিয়েছেন অনেকের কাছ থেকে। এসব কাজে শেরেবাংলা নগর থানা আওয়ামী লীগের এক নেতার কাছ থেকেও প্রশ্রয় পেয়েছেন জন।

যেভাবে ফাঁসাতেন জন:

চলতি বছরের ৩০ মার্চ রাজধানীর আগারগাঁওয়ের ইসলামিক ফাউন্ডেশন ভবন সংলগ্ন মসজিদের সামনে থেকে খালি হাতে মো. রহিম সুলতান ওরফে বায়েজিদ ও মো. বেল্লাল হোসেনকে আটক করে র্যাবের একটি দল। এরপর ঘটনাস্থল থেকে চার কিলোমিটার দূরে পীরেরবাগ এলাকা থেকে অস্ত্রসহ আটক দেখানো হয়। ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দৈনিক কালবেলায় গত ১৭ এপ্রিল ‘খালি হাতে আটক দুই যুবককে ফাঁসানো হলো অস্ত্র মামলায়’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটি আদালতের নজরে আনা হলে ওই দুই যুবককে জামিন দেন আদালত।

পরে বায়েজিদের মা শাহনাজ সুলতানা বাদী হয়ে আদালতে একটি মামলা করেন। ওই মামলায় র্যাব-৪-এর কোম্পানি কমান্ডার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আক্তারুজ্জামান এবং জনসহ ছয়জনকে আসামি করা হয়। এ প্রসঙ্গে বায়েজিদ কালবেলাকে বলেন, ‘আমাকে আগারগাঁও থেকে তুলে নিয়ে পীরেরবাগ থেকে আটক দেখিয়ে মামলা দেয়। আমি দেখেছি মামলা লেখার সময় র্যাবের কর্মকর্তারা জনের সঙ্গে কথা বলেছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি স্থানীয় সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। আমি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। আমি সামাজিক কাজ করায় কেউ কেউ ভাবছে আমি কাউন্সিলর নির্বাচন করব। এ ছাড়া ডিশ ব্যবসা নিয়েও স্থানীয় এক নেতার সঙ্গে আমার বিরোধ ছিল। তারা যোগসাজশ করে জনকে দিয়ে আমাকে মামলায় ফাঁসিয়েছে।’

বায়েজিদ বলেন, ‘শুনেছি আমাকে ফের মামলায় ফাঁসাতে জন ডিবি অফিসে মিটিং করেছে। আমি এখন সবসময় আতঙ্কে থাকি। আমার সামনে কোনো মাইক্রোবাস থামলেই আমি আঁতকে উঠি।’

আরেক ভুক্তভোগী মো. আনোয়ার হোসেন। তিনি রাজধানীর আমার বাংলাদেশ হাসপাতালের পরিচালক। এই ব্যক্তিকে নারী দিয়ে ফাঁসানোর পর মীমাংসার কথা বলে তিন দফায় সাড়ে ৬ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন মোহাম্মদপুর থানার সাবেক উপপরিদর্শক দেলোয়ার, আল-কাইয়ুম ও জন। এরপর আরও টাকা চাইলে বাধ্য হয়ে আদালতে মামলা করেন আনোয়ার। এ অপরাধে তাকে ধরে নিয়ে বেধড়ক মারধর করে তার কাছ থেকে আরও ১ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন জন ও তার লোকজন। মারধর ও অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার সিসিটিভি ফুটেজ কালবেলার হাতে রয়েছে। এরপর তিন দিন মিরপুর মডেল থানায় গিয়ে ঘুরলেও এ ঘটনায় আনোয়ারের মামলা নেয়নি পুলিশ।

আনোয়ার হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘হাসপাতালের শেয়ার বিক্রির ১৫ লাখ টাকা বাসায় রেখেছি, বিষয়টি আমার কলিগ কাইয়ুম জানত। হাসপাতালে রোগী পাঠানোর কথা বলে আমাকে রয়েল হোটেলে ডেকে নিয়ে শারমিন আক্তার নামে এক নারী জোরাজুরি করে ভিডিও করে। এরপর আমাকে ধর্ষণ মামলার ভয় দেখিয়ে তিন ধাপে সাড়ে ৬ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। ওই সময় আমার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা থাকায় মানসম্মানের ভয়ে আমি তাদের টাকা দিই। পরে আবার টাকা চাইলে আদালতে মামলা করি। মামলাটি বর্তমানে সিআইডি তদন্ত করছে। মামলা করায় ফের আমাকে জন তার দলবল নিয়ে পিটিয়েছে। আমার সঙ্গে থাকা ১ লাখ টাকাও নিয়ে গেছে।’

জন ও তার চক্রের হাত থেকে রেহাই পাননি বেলাল হোসেন নামে এক বিকাশ এজেন্ট ব্যবসায়ীও। পাওনা ৫ হাজার টাকা দেওয়ার কথা বলে ঢেকে নিয়ে জিম্মি করে বেলালের কাছ থেকে ১ লাখ ১৮ হাজার টাকা ও দুটি মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয় প্রতারক চক্রটি। এ ঘটনায় বেলাল যাত্রাবাড়ী থানায় মামলা করলে জন ও তার সহযোগী কাইয়ুমকে আটক করে আদালতে পাঠায় পুলিশ।

কল রেকর্ডে ফাঁসানোর ফন্দি:

জন ও তার সহযোগীরা কীভাবে বিভিন্ন জনকে মামলায় ফাঁসানোর ফন্দি আঁটতেন, তা বোঝা যাবে তাদের কথোপকথন শুনলেই। এমন দুটি কল রেকর্ড এসেছে কালবেলার হাতে। এর মধ্যে একটি রেকর্ড জনের সহযোগী শিহাবুল ইসলাম সয়নের সঙ্গে সাইফুল ইসলাম মিঠু নামে এক ব্যক্তির। অন্য রেকর্ডটি জনের সঙ্গে এক স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতার কথোপকথনের।

প্রথম রেকর্ডে মিঠুকে বলতে শোনা যায়, ‘যদি কনফার্ম হয় তাইলে ওই ১ লাখ টাকা দিব ক্যাশ। ওই পোলার লগে ঝগড়া এক দোকানদারের, বুচ্ছেন ভাই। ওর লগে ব্যবসায়িক পারপাসে (উদ্দেশ্য) ঝগড়া। এহন ভাই, যেমনে হোক ওরে প্যাকেট করাইতে হইব।’ জবাবে শয়ন বলেন, ‘এখন এটা তো সাক্ষাতে আলোচনার বিষয় আছে। তুই কইছস, কইরা দিমুনে। সমস্যা নাই, ঠিক আছে, কইরা দিমুনে।’ তখন মিঠু বলেন, ‘যদি হয় ১ লাখ টাকা দিব। ওই লোক মনে হয় মালটাল খাইতে পারে, যদি মাল দিয়া অ্যারেস্ট করাই দেন ভাই। একদম সহজ ভাই।’

দ্বিতীয় কল রেকর্ডে জন ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতার কথোপকথনে উঠে আসে বায়েজিদকে মামলায় ফাঁসানোর বিষয়টি। প্রথমে ওই স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা বলেন, ‘বায়েজিদ জানে, ভালো করেই জানে ওরে কারা কারা ধরাই দিছে। তোর কথা আমাদেরকে বলতে হবে না। ও নিজেই জানে।’ উত্তরে জন বলেন, ‘ও তো বলছেই। সব জায়গায়েই বলতেছে।’ স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা বলেন, ‘এটা কি শুনছস। বায়েজিদ এই কথা বলছে কোন সময়, যে অফিসার ওরে ধরাই দিছে সেই অফিসার জনের খালাতো ভাই। এটা শুনছস? যদি এটা শুনতি তাহলে বুঝতি এই কথা আমিই বলছি। কারণ তুই আমার কাছেই বলছস যে ভাই, যে অফিসার ধরছে সে আমার খালাতো ভাই। আমিই বায়েজিদকে ধরাইছি। যদি এটা বায়েজিদের মুখ দিয়ে দুই কান হইত, তাইলে বুঝতি এইটা তুই আমারে কইছস আর আমিই বায়েজিদকে বইলা দিছি।’

যা বললেন জন:

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে এবিএম মাহমুদুল বশ্রী জন কালবেলাকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে একটাই অভিযোগ। বায়েজিদের, ওরা তো মামলা করছে।’ এরপর সুনির্দিষ্টভাবে একাধিক মামলার তথ্য উল্লেখ করে বিভিন্ন জনকে ফাঁসানোর বিষয়ে জানতে চাইলে জন বলেন, ‘আনোয়ারেরটা যে বললেন, ওটা তো প্রতিবেদন প্রকাশ পাইছে। আর বেলাল হোসেন নিজেই আপসনামা দিয়ে দিছে। মামলা শেষ হয়ে গেছে।’ এ ছাড়া অন্য সব অভিযোগ অস্বীকার করেন জন।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মাঝরাতে মিথিলার খুশির খবর

‘ডিপার্টমেন্ট অব ওয়ার’ করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র

সাব ব্রাঞ্চ ইনচার্জ পদে ইউসিবি ব্যাংকে চাকরির সুযোগ

রাজধানীতে আজ কোথায় কোন কর্মসূচি

এসএমসিতে চাকরির সুযোগ, আজই আবেদন করুন

সিদ্ধিরগঞ্জে বিস্ফোরণে নাতির পর নানির মৃত্যু

ঢাকায় বিজিবি-বিএসএফ সীমান্ত সম্মেলন আজ

আজ ঢাকার আবহাওয়া কেমন থাকবে, জানাল আবহাওয়া অফিস

২৬ আগস্ট : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

ডাকসু নির্বাচনে আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরু আজ

১০

তিন সহযোগীসহ ‘মাদক সম্রাট’ শাওন গ্রেপ্তার

১১

ফের সৈকতে ভেসে এলো মৃত ইরাবতী ডলফিন

১২

মঙ্গলবার রাজধানীর যেসব এলাকার মার্কেট বন্ধ

১৩

২৬ আগস্ট : আজকের নামাজের সময়সূচি

১৪

পাঁচ বাংলাদেশিকে ফেরত দিল বিএসএফ

১৫

ক্ষমতায় গেলে এক কোটি কর্মসংস্থান করবে বিএনপি : টুকু

১৬

ড. ইউনুস কি ভালো ভোট করতে পারবেন : মান্না

১৭

ষড়যন্ত্রকারীদের সতর্কবার্তা দিলেন আমিনুল হক

১৮

স্ত্রী-সন্তানসহ প্রবাসীর মৃত্যু, চাচাতো চাচা রফিকুল রিমান্ডে 

১৯

জবিতে ক্লাস ও পরীক্ষা মনিটরিং সিস্টেম চালু ১ সেপ্টেম্বর

২০
X