৯২ হাজার কোটি টাকার আর্থিক কেলেঙ্কারির মাধ্যমে সংঘটিত অর্থ পাচারে নীরব ভূমিকা এবং অনৈতিক সুবিধা নিয়ে এসব কাজে সহায়তার অভিযোগে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) সাবেক প্রধান মাসুদ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে তদন্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল বুধবার দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) মো. আখতারুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, বিএফআইইউর সাবেক প্রধান মাসুদ বিশ্বাস বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই পদে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন। তার অবৈধভাবে অর্জিত জ্ঞাত-আয়বহির্ভূত সম্পদ থাকার বিষয়টি গোয়েন্দা তথ্যানুসন্ধানে গোপন সূত্রের বরাতে প্রাথমিকভাবে সঠিক মনে হওয়ায় প্রকাশ্য অনুসন্ধানের জন্য কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
দুদকের গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, মাসুদ বিশ্বাস তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে স্কাই ক্যাপিটাল এয়ারলাইন্স লিমিটেডের বিমান ক্রয়ে সন্দেহজনক অনিয়মের অভিযোগ ঘুষের বিনিময়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে না পাঠিয়ে এর পরিসমাপ্তি করেছেন। এ ছাড়া এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের চেয়ারম্যান তমাল পারভেজের ব্যাংক থেকে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা লুটপাটসহ আর্থিক অনিয়মের রিপোর্টকে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিধিমালা, ২০১৯-এর আওতায় গোয়েন্দা প্রতিবেদন না পাঠিয়ে সাধারণ পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন হিসেবে প্রেরণের অনুমতি দেওয়া; অনিয়ম ও অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির কারণে শেয়ারবাজারের তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান হিমিদ্রী লিমিটেডের ব্যাংক হিসাবের লেনদেন স্থগিত করা হয়। এসব স্থতিগাদেশ তিনি আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে প্রত্যাহারের নির্দেশ প্রদান; তানাকা গ্রুপ, এস এ গ্রুপ এবং আনোয়ার গ্রুপের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং, অর্থ পাচার সংক্রান্ত সুনিশ্চিত তথ্য থাকা সত্ত্বেও এসব ঘটনা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে না পাঠিয়ে ব্যক্তিগত সুবিধা গ্রহণের মাধ্যমে নথিভুক্ত করা; এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম মাসুদের সঙ্গে যোগসাজশে ইসলামী ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকা ঋণ উত্তোলন-পূর্বক বিদেশে পাচার; আবদুল কাদির মোল্লার থার্মেক্স গ্রুপ থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে বিদেশে অর্থ পাচারসহ ঘুষের বিনিময়ে জিনাত এন্টারপ্রাইজের বিদেশে অর্থ পাচারের কেস ধামাচাপা দিয়ে মাসুদ বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জন করেছেন বলে জানতে পেরেছে দুদক।
এর আগে মাসুদ বিশ্বাসের দুর্নীতি তদন্তের আবেদন জানিয়ে অভিযোগ দেওয়া হয় দুদকে। দুদকে জমা দেওয়া অভিযোগে বলা হয়, বিএফআইইউর পদত্যাগ করা মাসুদ বিশ্বাস বিভিন্ন সময়ে শীর্ষ দুর্নীতিবাজদের থেকে ঘুষের মাধ্যমে অনিয়মে সহায়তা করেছেন। বিগত দিনে হলমার্ক, বিসমিল্লাহসহ ২৪টি বড় ঘটনায় ৯২ হাজার কোটি টাকার আর্থিক কেলেঙ্কারির মাধ্যমে অর্থ পাচারে নীরব ভূমিকা পালন করেছিল মাসুদ বিশ্বাসের বিএফআইইউ।
অভিযোগে বলা হয়েছে, অর্থ পাচার ঠেকানোর দায়িত্ব বিএফআইইউর থাকলেও উল্টো বিএফআইইউর সদ্য পদত্যাগ করা প্রধান মাসুদ বিশ্বাস অনৈতিক সুবিধা নিয়ে অর্থ পাচারে সহায়তা করেছেন। তার বিরুদ্ধে ব্যাংকগুলোকে চাপ দিয়ে প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম, বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় ইভেন্ট আয়োজন ও বিদেশ সফরের মাধ্যমে অর্থ অপব্যয়ের অভিযোগ রয়েছে। গত কয়েক বছর বিএফআইইউর পক্ষ থেকে বছরে গড়ে ৮-১০টির মতো বড় তদন্ত দায়সারাভাবে করে সেসব পক্ষ থেকে আর্থিক সুবিধা নেওয়া হয়েছে। এস আলম গ্রুপ ও আবদুল কাদির মোল্লার থার্মেক্স গ্রুপ থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে বিদেশে অর্থ পাচারের বিষয়ে অবহিত থেকেও পাচার ঠেকাতে কোনো ব্যবস্থা নেননি মাসুদ বিশ্বাস। এমনকি জিনাত এন্টারপ্রাইজের পাচারের ঘটনায় ৫০ লাখ টাকা ঘুষের বিনিময়ে সেটি ধামাচাপা দিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি ইউসিবি ব্যাংকের বিভিন্ন শাখার মাধ্যমে থার্মেক্স গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে মঞ্জুরিকৃত ঋণের অর্থ ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের হিসাবে স্থানান্তর করার গুরুতর অনিয়ম বিএফআইইউর তদন্তে ধরা পড়লেও এ বিষয়ে উৎকোচ গ্রহণের মাধ্যমে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ ছাড়া একটি বেসরকারি ব্যাংকের অবজারভার থাকা অবস্থায় ওই ব্যাংকের কাছ থেকে নিয়মবহির্ভূতভাবে ২ হাজার স্কয়ার ফিটের একটি ফ্ল্যাট ঘুষ হিসেবে নিয়েছেন মাসুদ বিশ্বাস।
অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, রূপালী ব্যাংকের গ্রাহক ডলি কনস্ট্রাকশনের অনুকূলে একক গ্রাহক ঋণসীমা অতিক্রম করে ৪০০ কোটি টাকার আর্থিক সুবিধা দিয়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক। বিষয়টি বিএফআইইউর তদন্তে ধরা পড়লেও মাসুদ বিশ্বাস ঘুষ গ্রহণের মাধ্যমে যথাযথ ব্যবস্থা নেননি। পাশাপাশি ন্যাশনাল ব্যাংকের গ্রাহক সান্ত্বনা এন্টারপ্রাইজসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ব্যাংকটির চারটি শাখা থেকে প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা প্রধান কার্যালয়ের অনুমোদন ছাড়াই বিতরণ করা হয়। মাসুদ বিশ্বাস শাখা ব্যবস্থাপকদের থেকে অবৈধ সুবিধা নিয়ে ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দায়মুক্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।
এ ছাড়া সাদ-মুসা গ্রুপ একাধিক ব্যাংক থেকে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার গৃহীত ঋণের অনিয়ম যাচাইকালে বিভিন্ন ব্যাংকের গাফিলতি, দুর্নীতি ও অনিয়ম উদ্ঘাটিত হলেও মাসুদ বিশ্বাস দাপ্তরিক ক্ষমতাবলে অবৈধ সুবিধা নিয়ে কোনো ব্যবস্থা নেননি। ব্র্যাক ব্যাংকের গ্রাহক সাজিদা ফাউন্ডেশনের চুয়া ডেবিট ইন্সট্রাকশনের বিপরীতে ২০২১ সালে ৮২ হাজার ৪১৬ ডলার আইএনজি ব্যাংকের গ্রাহক এফএমও এনভি আইএনএল এমএএসএসআইএফের অনুকূলে পাঠানোর মাধ্যমে পাচার করে। মাসুদ বিশ্বাস ব্যাংকটির কাছ থেকে অবৈধ সুবিধা গ্রহণের বিনিময়ে অনিয়মটি ধামাচাপা দিয়েছেন। এ ছাড়া যমুনা ব্যাংকের ধানমন্ডি শাখার গ্রাহক শিরিন স্পিনিং মিলসের অনুকূলে ১০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স প্রেরণ এবং এনআরবিসি ব্যাংকের গ্রাহক বিশ্বব্যাংকের কালো তালিকাভুক্ত কোম্পানি টাইগার আইটির নামে ১ হাজার কোটি টাকার ব্যাংক গ্যারান্টি প্রদানে অনুমোদনের জন্য মাসুদ বিশ্বাস অবৈধভাবে প্রভাব বিস্তার করেন। এ ছাড়া তিনি মার্কেট সিস্টেমস ও নগদের আর্থিক কেলেঙ্কারি ধামাচাপা দিতে ইতালিতে বিদেশ সফরের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে অর্থ গ্রহণ করেছেন বলে দুদকে জমা দেওয়া অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে কালবেলার পক্ষ থেকে অভিযুক্ত বিএফআইইউর সাবেক প্রধান মাসুদ বিশ্বাসের ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে কল করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। পরে প্রশ্ন লিখে ওই নম্বরে পাঠালেও তিনি জবাব দেননি। এ ছাড়া তার হোয়াটসঅ্যাপে কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি।