ব্যাংকের পাশাপাশি ডলারের দাম বেশ কিছুটা বেড়েছে খোলাবাজারে (কার্ব মার্কেট)। ফলে দীর্ঘদিন স্থিতিশীল থাকার পর আবারও উত্তাল ডলারের বাজার। ব্যাংকগুলোর ঘোষিত দর অনুযায়ী, প্রতি ডলারের বিনিময় হার সর্বোচ্চ হওয়ার কথা ১২০ টাকা। কিন্তু চাহিদার কারণে ব্যাংকগুলোয় ডলারের দাম বেড়ে গেছে। কোনো কোনো ব্যাংক এখন রেমিট্যান্সের ডলার কিনছে ১২৫ টাকায়। আর কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলার কেনাবেচা হচ্ছে সর্বোচ্চ ১২৬ টাকায়।
গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশে অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকে রেমিট্যান্স প্রবাহ। সেইসঙ্গে রপ্তানি আয়ও অনেকাংশে বেড়েছে। আর অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে আমদানিতে ধীরগতি দেখা গেছে। এ অবস্থায় ডলারের বাজার অনেকটাই স্থিতিশীল হয়ে এসেছিল। ব্যাংকের পাশাপাশি কার্ব মার্কেটেও ডলারের দর ছিল নিম্নমুখী। চাহিদা কমে যাওয়ায় কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলারের বিনিময় হার নেমেছিল ১২১ টাকায়। কিন্তু চাহিদা বৃদ্ধির কারণে নভেম্বর থেকে ডলারের দর বাড়তে শুরু করেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত তিনটি কারণে ডলারের দর বাড়ছে। প্রথমত, রমজান কেন্দ্র করে ভোগ্যপণ্য আমদানিতে গতি বেড়েছে। এতে আমদানি দায় পরিশোধের চাহিদাও বেড়েছে। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএফএফ) শর্ত অনুযায়ী বছর শেষে নির্ধারিত পরিমাণে রিজার্ভ সংরক্ষণে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ডলার কেনা বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তৃতীয়ত, বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ওভারডিউ (বকেয়া) হয়ে যাওয়া সব ঋণপত্রের (এলসি) দায় ডিসেম্বরের মধ্যে পরিশোধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ কারণে কিছু ব্যাংক বেশি দামে ডলার কিনে হলেও এলসি দায় সমন্বয় করছে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ব্যাংকগুলোয় এখন ডলারের চাহিদা বেশ বেড়েছে। ফলে অনেক ব্যাংক বাড়তি প্রণোদনা দিয়ে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করছে। এ ছাড়া, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বকেয়া এলসি দায়গুলো ডিসেম্বরের মধ্যে পরিশোধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ কারণে কিছু ব্যাংক বেশি দামে ডলার কিনে হলেও এলসি দায় সমন্বয় করছে। পাশাপাশি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় বেশকিছু বড় এলসি খোলা হয়েছে। এ ছাড়া, বিদেশি রেমিট্যান্স হাউসগুলোর সিন্ডিকেটের কারণে বাধ্য হয়ে বেশি দামে ডলার কিনতে হচ্ছে। গতকাল প্রতি ডলারের দর সর্বোচ্চ ১২৫ টাকা ৫০ পয়সায় উঠেছে। আবার রমজান ঘিরে ভোগ্যপণ্যের এলসি খোলা বেড়েছে। এসব কারণে ডলারের দর ঊর্ধ্বমুখী।
খোলা বাজারেও বেড়েছে ডলারের দর। গতকাল সরেজমিন দেখা গেছে, ১২৬ টাকা দরে ডলার বিক্রি করেছে বেশিরভাগ মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান। মানি চেঞ্জার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশর সভাপতি এম এস জামান কালবেলাকে বলেন, চাহিদা অনুযায়ী ডলারের সরবরাহ কম। ফলে দাম কিছুটা বেড়েছে। মানি এক্সচেঞ্জগুলো মূলত বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের কাছ থেকে ডলার সংগ্রহ করে। বর্তমানে এই সংখ্যাটা অনেক কমে গেছে। তবে রমজান সামনে রেখে দু-এক মাস পর রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়লে তখন দামও কমে আসবে।
এদিকে, আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, ৩১ ডিসেম্বর বাংলাদেশের নিট রিজার্ভ থাকতে হবে ন্যূনতম ১ হাজার ৫৩২ কোটি বা ১৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। এ শর্ত পূরণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার কেনা বাড়ানোর বিষয়টিও মার্কিন মুদ্রাটির বিনিময় হার ঊর্ধ্বমুখী করে তোলার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, গত জুলাই থেকে গতকাল পর্যন্ত প্রায় ৩৬ কোটি ডলার কিনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, টানা দুই অর্থবছর আমদানি ঋণাত্মক থাকার পর চলতি অর্থবছর প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) দেশের আমদানি ব্যয় হয়েছে ২২ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২১ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলার। সে হিসেবে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে আমদানিতে প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। নভেম্বর ও চলতি মাসে আমদানির এলসি খোলাও বেড়েছে।
দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রিজার্ভ উঠেছিল ২০২১ সালের আগস্টে, তখন ছিল ৪৮ দশমিক শূন্য ৪ বিলিয়ন ডলার। তবে করোনা-পরবর্তী অর্থনীতিতে বাড়তি চাহিদা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দোহাই দিয়ে রিজার্ভ থেকে প্রচুর ডলার বিক্রি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই সময় ডলার বিক্রি করলেও দর ঠেকানো যায়নি। আবার অনেক ধরনের বকেয়া পরিশোধ না করে মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। বাজার স্থিতিশীল রাখার কথা বলে টানা তিন অর্থবছর রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০২১-২২ অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে বিক্রি করা হয় ৭৬২ কোটি বা ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছর তা আরও বেড়ে পৌঁছে ১৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়নে। আর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে বিক্রি করা হয় আরও ১২ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার। টানা তিন অর্থবছর ডলার বিক্রির কারণে রিজার্ভে বড় ক্ষয় হয়েছে। ২০২১ সালের আগস্টে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসাবায়নে)। সে রিজার্ভ এখন ২৪ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে এসেছে। তবে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী (বিপিএম৬) গত ১১ ডিসেম্বর রিজার্ভ ছিল মাত্র ১৯ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে নিট রিজার্ভ প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার। আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী, ৩১ ডিসেম্বর নিট রিজার্ভ ১৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার রাখতে হবে। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর ড. আহসান এইচ মনসুর গভর্নরের দায়িত্ব নিয়ে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি বন্ধ করেছেন। সেইসঙ্গে আইএমএফের শর্ত পূরণে বাজার থেকে ডলার কিনছেন।
চলতি অর্থবছরে দেশের ব্যাংক খাতে ডলারের প্রবাহ বাড়াতে বড় ভূমিকা রেখেছে রেমিট্যান্স। জুলাই থেকে নভেম্বর—পাঁচ মাসে প্রবাসীরা ১১ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ বেশি। আর জুলাই থেকে অক্টোবর—এ চার মাসে রপ্তানিতে ৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, এতদিন রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে আমদানি দায় ও বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমান গভর্নর রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছেন। এখন রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের ডলার দিয়ে আমদানি দায় ও বিদেশি ঋণ পরিশোধ করা হচ্ছে। পাশাপাশি ওভারডিউ হয়ে যাওয়া এলসি দায় ও জ্বালানি খাতসহ অন্যান্য খাতে বিদেশি কোম্পানিগুলোর পাওনাও পরিশোধ করতে হচ্ছে। তবে ডলারের দর স্থিতিশীল রাখতেও তৎপরতা বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ডলারের দর বৃদ্ধির প্রকৃত কারণ জানতে বেশি দরে রেমিট্যান্সের ডলার কিনছে, এমন কয়েকটি ব্যাংকের এমডিকে বাংলাদেশ ব্যাংকে তলব করা হয়েছে।