রোমানিয়ায় বাংলাদেশের শ্রমবাজার সম্প্রসারণ এবং শ্রমিকদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেখার দায়িত্ব দূতাবাসের শ্রম উইংয়ের প্রথম সচিব মহসিন মিয়ার; কিন্তু সেদিকে নজর না দিয়ে তিনি জড়াচ্ছেন নানারকম কেলেঙ্কারিতে। তার যৌন হয়রানির কারণে এক রোমানিয়ান নারী ছেড়েছেন চাকরি। অন্য নারী সহকর্মীরাও তার এমন ব্যবহারে বিরক্ত।
দূতাবাসের ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে উঠেছে সহকর্মী ও প্রবাসীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও টাকা চাওয়ার অভিযোগ। রোমানিয়ান কোম্পানির সঙ্গে খারাপ ব্যবহারেরও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এতে রোমানিয়ায় দেশের শ্রমবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি কূটনৈতিক কার্যকলাপেও বিরূপ প্রভাব পড়ছে। মহসিনের কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে দ্রুত দেশে ফেরত নেওয়ার আলটিমেটাম দিয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
অভিযোগের সূত্র ধরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মহসিন মিয়া রোমানিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম উইংয়ের প্রথম সচিব। বিসিএস ২৭ ব্যাচের এই কর্মকর্তা ২০২৩ সালে দূতাবাসের শ্রম উইংয়ে যোগ দেন। বর্তমানে রাষ্ট্রদূত না থাকায় মহসিন বাংলাদেশ দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। যোগদানের পর থেকেই তার বিরুদ্ধে অনৈতিক প্রস্তাবসহ নারী সহকর্মীদের সঙ্গে অসদাচরণের অভিযোগ ওঠে। সম্প্রতি বাংলাদেশ দূতাবাসে রিসিপশনিস্ট পদে কর্মরত সুজানা কাজমি নামের এক রোমানিয়ান নারী মহসিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে চাকরি ছেড়েছেন।
চাকরি ছাড়ার কারণ অনুসন্ধানে সুজানার একটি অডিও বার্তা এবং একটি চিঠি এসেছে কালবেলার হাতে। চিঠি এবং অডিও বার্তায় সুজানা জানান, মহসিন মিয়া তাকে দীর্ঘদিন ধরে উত্ত্যক্ত করতেন। রিসিপশনিস্ট পদে চাকরি করলেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকে মহসিনের রুমে বসিয়ে রেখে মানসিক নির্যাতন করতেন। তার বেকার স্বামীকে চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে অবৈধ সম্পর্কের অফারও দেন। এতে তার স্বামী ক্ষুব্ধ হন এবং মহসিনের সঙ্গে তর্ক-বিবাদে জড়ান। এ কারণে সুজানার স্বামীকে লেবার উইংয়ে চাকরি দিলেও সেখান থেকে অপসারণ করেন মহসিন।
এদিকে সুজানার স্বামীকে অপসারণ করার পর ওয়েলফেয়ার অ্যাসিন্ট্যান্ট হিসেবে ইনগ্রিদ নামে আরেক রোমানিয়ান নারীকে নিয়োগ দেন মহসিন। তাকেও মহসিন অনৈতিক প্রস্তাব দেন বলে অভিযোগ উঠেছে। দূতাবাস সূত্র এবং বাংলাদেশ কমিউনিটির একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ইনগ্রিদ দূতাবাসে কর্মরত তার রোমানিয়ার সহকর্মীদের কাছে বলেছেন, সম্প্রতি মহসিন তাকে বুলগেরিয়ায় সরকারি সফরে নিয়ে যান, সেখানে তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে অনৈতিক সম্পর্কের প্রস্তাব দেন। ইনগ্রিদ চিৎকার করলে ভয় পেয়ে মহসিন তাকে ছেড়ে দেন।
বিষয়টি নিয়ে ইনগ্রিদ যাতে দূতাবাসের অন্য কারও সঙ্গে কথা বলতে না পারেন, সেজন্য অফিস সময়ের পুরোটাই তার রুমে বসিয়ে রাখেন মহসিন। এতে সেবা নিতে আসা প্রবাসী এবং অন্য সহকর্মীরাও হচ্ছেন বিব্রত। এ ছাড়া মহসিন চীন থেকে এক নারীকে রোমানিয়ায় আনার জন্য ভিসা তদবির করছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
রোমানিয়ার চেম্বার অব কমার্সের আফ্রো-এশিয়া বিভাগের প্রধান প্রবাসী বাংলাদেশি মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ৩২ বছর ধরে রোমানিয়া বসবাস করছি, কখনো দূতাবাসের কারও বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ পাইনি; কিন্তু মহসিন মিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই।
দূতাবাসের এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দেশে লাশ পাঠানো এবং কাগজ বৈধ করার নামে টাকা চাওয়ার অভিযোগ করেছে সেখানকার প্রবাসী বাংলাদেশিরা। তারা জানান, রোমানিয়ান বিভিন্ন কোম্পানিকে মহসিন বলেছেন, বাংলাদেশি নিয়োগ করতে গেলে তাকে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ কোটা দিতে হবে, তাছাড়া তিনি ডিমান্ড লেটার সত্যায়ন করবেন না। মহসিনের এই অপতৎপরতার কারণে বর্তমানে বাংলাদেশ দূতাবাসে বৈধ ডিমান্ড লেটার আসা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে, যার ফলে রোমানিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
২০২১ ও ২০২২ সালে রোমানিয়ায় প্রবেশ করা বিদেশিদের মধ্যে বাংলাদেশিরা প্রথম ছিল। তবে ২০২৩ সাল থেকে পাল্টাতে থাকে পরিস্থিতি। দূতাবাসের শ্রম উইংয়ের ব্যর্থতায় বাংলাদেশিদের রোমানিয়া থেকে পালিয়ে যাওয়ার সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং বর্তমানে দেশটিতে খুব কম বাংলাদেশি শ্রমিক প্রবেশ করতে পারছেন। বাংলাদেশের পরিবর্তে সম্ভাবনাময় শ্রমবাজারটি বর্তমানে দখল করেছে নেপাল ও শ্রীলঙ্কা।
প্রবাসী রফিকুল ইসলাম বলেন, সারাক্ষণ প্রভুসুলভ আচরণ করা এ ব্যক্তি শ্রমিক-মালিকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও উচ্চ স্বরে চেঁচামেচি করেন। তিনি বলেন, ভেবেছিলাম এই ভদ্রলোক শ্রমিকদের সুযোগ সুবিধা দেখবেন; কিন্তু তার কারণে শ্রমবাজারের কোনো উন্নতি হয়নি। বরং তার বাজে ব্যবহারের কারণে বিভিন্ন কোম্পানি থেকে অনেক শ্রমিকের চাকরি চলে গেছে।
রোমানিয়া প্রবাসী আজিজ আহমেদ বলেন, এমনিতেই প্রবাসীরা অনেক কষ্ট করে রেমিট্যান্স দেশে টাকা পাঠান। একটি-দুটি লাশ যদি বাংলাদেশ সরকার না পাঠিয়ে আমাদের কাছে চাঁদা চায়, এর চেয়ে লজ্জার আর কি হতে পারে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রবাসী বলেন, আমার কাগজ রিনিউ করতে গেলে মহসিন স্যার ১ হাজার ইউরো চেয়েছিলেন। টাকা না দিতে পারায় তিনি আমার কাজ করে দেননি।
নাইম প্রধান নামে এক প্রবাসী বলেন, টেম্পোরারি রেসিডেন্স কার্ড না থাকায় দেড় বছর ধরে অবৈধভাবে রোমানিয়ায় বসবাস করছি। কার্ড করার জন্য বারবার দূতাবাসের মহসিন স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও কোনো হেল্প পায়নি। আমার মতো এমন অনেকে অবৈধ হয়ে আছেন, কিন্তু দূতাবাস থেকে কোনো সহযোগিতা করা হচ্ছে না। টাকা নিয়ে কাজ না করে দেওয়ারও অভিযোগ করেছেন কেউ কেউ।
এদিকে, মহসিনের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে গত ২৪ ডিসেম্বর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন প্রবাসীরা। অভিযোগে পত্রে মহসিনকে নারীলোভী, অর্থলোভী ও পতিত স্বৈরাচারের দোসর উল্লেখ করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি ১ সপ্তাহের মধ্যে দেশে ফেরত নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে মহসিনের বিরুদ্ধে দূতাবাসের সামনে মানবন্ধন করার হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
রোমানিয়া বাংলাদেশ কমিউনিটির সাধারণ সম্পাদক গিলমান কবির কালবেলাকে বলেন, সরকার তাকে পাঠিয়েছে রোমানিয়ায় শ্রমবাজার সম্প্রসারণের জন্য; কিন্তু উনি আসার পর শ্রমবাজার আরও সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে।
অভিযোগের বিষয় মন্তব্য জানতে চাইলে মহসিন মিয়া কালবেলাকে বলেন, অভিযোগগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সরকার আমাকে যে দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছে, আমি সেই দায়িত্ব পরিপূর্ণভাবে পালন করছি। একটি তথাকথিত কমিউনিটি গ্রুপ আমার বিরুদ্ধে এসব মিথ্যাচার করছে। তারা প্রায় প্রত্যেকে অসাধু আদম ব্যবসায়ী। আমার অপরাধ আমি দেশের জন্য কাজ করি আর অসাধুদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখি। এতে তাদের অবৈধ ব্যবসায় ক্ষতি হচ্ছে, তাই আমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ করছে।
নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, রাকিব হাসান নামে মৃত এক প্রবাসীর ক্ষতিপূরণের টাকা চুরি করে ধরা পরায় সুজানা অফিসে অনুপস্থিত, তার বিরুদ্ধে দাপ্তরিক ব্যবস্থা চলমান। আর ইনগ্রিদ নামে কেউ কখনো অভিযোগ করেনি। এগুলো ফরমায়েশি অভিযোগ। যদিও সুজানার মহসিনের কারণে চাকরি ছেড়েছেন বলে তথ্য রয়েছে কালবেলার হাতে।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মিশন ও কল্যাণ অনুবিভাগ অতিরিক্ত সচিব মো. শেখাবুর রহমান কালবেলাকে বলেন, এমন কোনো অভিযোগের বিষয়ে অবগত নই। তবে অভিযোগ পেলে অবশ্যই তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর আগেও এমন অভিযোগের কারণে এক কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।