একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে আমৃত্যু দণ্ডপ্রাপ্ত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুর পর গায়েবানা জানাজা নিয়ে কক্সবাজারের চকরিয়ায় মুখোশধারীদের গুলিতে একজন নিহত ও অন্তত ৭ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। রাজধানীর শাহবাগ ও বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ এলাকায় পুলিশের সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ ও গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। এ ছাড়া চট্টগ্রামেও পুলিশের সঙ্গে জামায়াত-শিবির কর্মীদের সংঘর্ষ হয়েছে। বাঁশখালীতে ১৪৪ ধারা জারি করেছে প্রশাসন। গতকাল মঙ্গলবার দিনব্যাপী এসব ঘটনা ঘটে।
কালবেলার চকরিয়া (কক্সবাজার) প্রতিনিধি জানান, গতকাল বিকেলে চকরিয়া পৌরসভার বাইতুর শরফ এলাকায় অনুমতি ছাড়া গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠানের চেষ্টা চালায় জামায়াত সমর্থকরা। ওই ঘটনার জেরে সংঘর্ষ ও গোলাগুলি হয়। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে একজন নিহত ও সাতজন আহত হন। নিহত ফোরকান ইসলাম চকরিয়া পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের আবদুল বারী পাড়ার বাসিন্দা বলে জানান চকরিয়া থানার ওসি জাবেদ মাহমুদ।
পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, চকরিয়া সরকারি হাই স্কুল মাঠে সাঈদীর গায়েবানা জানাজার ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু প্রশাসনের অনুমতি না থাকায় পুলিশ সেখানে জানাজা পড়তে দেয়নি। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে কয়েক হাজার লোক পৌরসভার লামার চিরিংগা এলাকায় জমায়েত হয়ে জানাজা শুরু করে। ওই সময় ৫০ জনের মতো মুখোশধারী লোক গিয়ে সেখানে গুলি চালায়। এতে জানাজা পণ্ড হয়ে যায়। কয়েকজনকে লাঠি দিয়ে পেটায়ও মুখোশধারীরা। পরে জানাজায় আসা লোকজন ইটপাটকেল ছোড়ে। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগেই হামলাকারীরা পালিয়ে যায়।
চকরিয়া থানার ওসি জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে পুলিশের পাঁচ সদস্য আহত হয়েছেন। তবে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাউকে আটক করা যায়নি।
শাহবাগ এলাকায় সংঘর্ষ, ভাঙচুর ও গাড়িতে অগ্নিসংযোগ:
এদিকে গতকাল ভোরে শাহবাগে মরদেহবাহী অ্যাম্বুলেন্স ঘিরে তাণ্ডব চালিয়েছে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা। এর আগে রাতে সাংবাদিকদের মারধর, গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে তারা। এ সময় বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে পুলিশ। এরপর ভোরে সাঈদীর মরদেহবাহী অ্যাম্বুলেন্স পুলিশের পাহারায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) থেকে পিরোজপুরের উদ্দেশে রওনা হয়। প্রায় ৬ ঘণ্টার বিক্ষোভে আতঙ্কে পড়েন বিএসএমএমইউ ও বারডেমে ভর্তি থাকা রোগী এবং স্বজনরা।
পুলিশ সূত্র জানায়, হাসপাতালের ভেতরে ময়নাতদন্ত ও জানাজার নাম করে জামায়াত ও সাঈদীর পরিবার কালক্ষেপণ করছিলেন। এই সুযোগে হাসপাতালের বাইরে জমায়েত বাড়াতে থাকে দলটি। এটি ছিল তাদের কৌশল। উপস্থিত নেতাকর্মীরা শুরু থেকেই ঢাকায় জানাজা করে পিরোজপুরে মরদেহ নিয়ে যাওয়ার দাবি করে আসছিলেন। ময়নাতদন্ত ছাড়া মরদেহ নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হওয়ার পর রাত ২টার দিকে জানাজা পড়ার আহ্বান জানানো হয়। তখন নেতাকর্মীরা জানাজা না পড়ে মোনাজাত করেন। পরে গায়েবানা জানাজা পড়বেন বলে জানান।
তবে হাসপাতাল থেকে সাঈদীর মরদেহবাহী অ্যাম্বুলেন্স বের করার চেষ্টা করলে রাস্তা আটকে দেন হাজারো নেতাকর্মী। তখন বিপাকে পড়েন হাসপাতালের অন্য রোগী ও তাদের স্বজনরা। পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ার গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে এবং সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে। নেতাকর্মীরাও পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। তারা পুলিশের গাড়িসহ চার-পাঁচটি যানবাহন ভাঙচুর ও দুটি মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেন। আধাঘণ্টার বেশি সময় দুপক্ষের সংঘর্ষ চলার পর সাঈদীর মরদেহবাহী অ্যাম্বুলেন্স কঠোর পুলিশি পাহারায় হাসপাতাল থেকে বের করা হয়।
ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, ফজরের নামাজের পর জানাজার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল জামায়াতকে। কিন্তু তারা অফিসারদের বের করে দিয়ে বিএসএমএমইউ দখলে নেয়। মরদেহ পিরোজপুরে নিতে দেবে না বলেও জানায়। এর মধ্যে তারা ফেসবুকে সারা দেশ থেকে নেতাকর্মী ও সমর্থকদের শাহবাগে আসার জন্য আহ্বান জানায়। তখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আশঙ্কায় তাদের ওপর অত্যন্ত সীমিত আকারে শক্তি প্রয়োগ করি।
বায়তুল মোকাররমে হঠাৎ সাঈদীর গায়েবানা জানাজা ঘিরে সংঘর্ষ:
এদিকে গতকাল দুপুরে হঠাৎ বায়তুল মোকাররম মসজিদে সাঈদীর গায়েবানা জানাজা পড়তে দাঁড়িয়ে যান তার সমর্থকরা। এ নিয়ে সেখানে জামায়াত, আওয়ামী লীগ ও পুলিশের মধ্যে ত্রিমুখী সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনায় কয়েকজনকে আটক করেছে পুলিশ।
প্রত্যক্ষদর্শী ও মুসল্লিরা জানান, জোহরের নামাজ শেষে পূর্ব কর্মসূচি অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারে শাহাদাতবরণকারীদের রূহের মাগফিরাত কামনায় দোয়া মাহফিলের ঘোষণা দেন পেশ ইমাম। তখন সাঈদী অনুসারীরা এর প্রতিবাদ করে গায়েবানা জানাজা পড়তে চান। এ নিয়ে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়।
পুলিশের মতিঝিল বিভাগের ডিসি হায়াতুল ইসলাম খান বলেন, পুলিশ ধাওয়া দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনলেও মসজিদের ভেতরে ঢোকেনি। বেশ কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। যাচাই-বাছাই করে আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
চট্টগ্রামে গায়েবানা জানাজা পণ্ড, দফায় দফায় সংঘর্ষ:
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, সাঈদীর গায়েবানা জানাজা কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম নগরীতে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছে। এ সময় পথচারী বৃদ্ধ, শিশু, পুলিশসহ বেশ কয়েকজন আহত হন। ঘটনাস্থল থেকে জামায়াতের অন্তত ৩২ নেতাকর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। তা ছাড়া চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। বোয়ালখালী, সাতকানিয়া, লোহাগাড়াসহ চট্টগ্রামজুড়ে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে পুলিশ। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, জামায়াতের মিছিল থেকে ছোড়া ককটেল বিস্ফোরণে এক অটোরিকশা চালক আহত হয়েছেন।
পুলিশের কোতোয়ালি জোনের উপকমিশনার মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘সাঈদীর গায়েবানা জানাজা কেন্দ্র করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল জামায়াত-শিবির। এ বিষয়ে গোয়েন্দা তথ্য ছিল। তাই এখানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন ছিল। ফলে নাশকতার চেষ্টা চালালেও তা করতে পারেনি।’
বাঁশখালী-লোহাগাড়ায় উত্তেজনা:
সোমবার রাতে জামায়াত নেতা সাঈদীর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে চট্টগ্রামের বাঁশখালী, লোহাগাড়া, সাতকানিয়া, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে ‘ঝটিকা মিছিল’ বের করার চেষ্টা করে জামায়াত-শিবির। বিভিন্ন স্পটে এ সময় পুলিশের বাধার মুখে মিছিলটি পণ্ড হয়ে যায়। এসব এলাকায় জোরদার করা হয় পুলিশি টহল। বাঁশখালীর চাম্বল ইউনিয়নে ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন।
বাঁশখালীর ওসি মো. কামাল উদ্দিন জানান, গায়েবানা জানাজার প্রস্তুতি নেওয়ার খবরে পুলিশি টহল জোরদার করা হয়। পরে জামায়াতের সমর্থকরা সরে গেছে।
পেকুয়া (কক্সবাজার) প্রতিনিধি জানান, সাঈদীর গায়েবানা জানাজা কেন্দ্র করে পেকুয়ায় পুলিশের সঙ্গে মুসল্লিদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় পেকুয়া থানার ২০ পুলিশ সদস্য হয়েছেন। গতকাল বিকেল ৩টার দিকে বারবাকিয়া বাজারে সাঈদীর গায়েবানা জানাজা শেষে পেকুয়া থানা পুলিশের ওপর উসকানিমূলক স্লোগান দিয়ে অতর্কিত হামলা চালানো হয় বলে জানিয়েছে পুলিশ।
পেকুয়া থানার ওসি ওমর হায়দার জানিয়েছেন, পেকুয়ার বারবাকিয়া বাজারে সাঈদীর গায়েবানা জানাজা শেষে একদল লোক পুলিশের ওপর হামলা চালিয়েছে। এ ঘটনায় পুলিশ আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মন্তব্য করুন