১৬ বছরে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন মা, বোন, বোনের স্বামী, ভাগ্নিসহ ২৬ স্বজন। তাদের কাউকে শেষ বিদায় জানাতে পারেননি ল্যান্স নায়েক আলতাফ হোসেন। মমতাময়ী মায়ের মৃত্যুর খবর জানালেও কারা কর্তৃপক্ষ তাকে নিয়ে আসা সম্ভব না বলে জানায়। অশ্রুসিক্ত চোখে কালবেলাকে কথাগুলো বলেন বিডিআর সদস্য ল্যান্স নায়েক আলতাফ হোসেন।
আলতাফ হোসেনের বাড়ি বরগুনা সদর উপজেলার বাওয়ালকার গ্রামে। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি সংঘটিত পিলখানা হত্যাকাণ্ড মামলার আসামি হয়ে দীর্ঘ ১৬ বছর জেলে ছিলেন এই বিডিআর জওয়ান।
দেশপ্রেমের টানে ১৯৯২ সালে তৎকালীন বাংলাদেশ বিডিআর বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন টগবগে যুবক আলতাফ। পিলখানার ১৩ নম্বর ব্যাটালিয়নে কর্মরত থাকার সময় পিলখানা ট্র্যাজেডির হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হন তিনি।
পরবর্তী সময়ে আলতাফ হোসেনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলাসহ হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে মামলা করা হয়। বিভাগীয় মামলায় সাত বছরের কারাদণ্ড ও হত্যা মামলার দায় থেকে আগেই অব্যাহতি দেওয়া হলেও বিস্ফোরক আইনের মামলায় গত ১৯ জানুয়ারি জামিনে মুক্তি দেওয়া হয় আলতাফ হোসেনকে। আইনি প্রক্রিয়া শেষে ২৩ জানুয়ারি কারামুক্ত হয়ে বরগুনার বাড়িতে ফেরেন তিনি। গ্রেপ্তারের সময় ২ বছর বয়সী ছেলে ও ৪ বছর বয়সী মেয়েকে রেখে যান আলতাফ।
কারাগারে যাওয়ার প্রথম ছয় মাস অতিবাহিত হওয়ার পরই ভাগ্নির মৃত্যু দিয়ে শুরু হয় আলতাফের স্বজন বিয়োগ। একে একে বোন, বোনের স্বামী, চাচা, সর্বশেষ ২০২২ সালে মৃত্যু হয় মা আমেনা বেগমের। স্বজনদের চিরবিদায়ে একটিবারের জন্যও তাকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হয়নি।
দীর্ঘ ১৬ বছর পর কারামুক্ত হয়ে বাড়িতে ফেরায় আনন্দের ঢল নেমেছে আলতাফ হোসেনের বাড়িতে। তাকে ঘিরে স্বজনদের উচ্ছ্বাস, স্ত্রী-সন্তানদের আবেগঘন মুহূর্ত আর সবার চোখে আনন্দের অশ্রু স্পষ্ট। স্বজনরা ছুটে আসছেন আলতাফকে দেখতে। ছেলেকে নিয়ে স্মৃতিবিজড়িত স্থানসহ বিভিন্ন স্বজন ও মায়ের কবর ঘুরে ঘুরে দেখছেন তিনি। সন্তানদের ছোটবেলার স্মৃতি হাতড়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ছেন।
দীর্ঘ বছর পর বাবাকে কাছে পেয়ে আকিব হোসেন রাফি বলেন, বাবা হলো পরিবারের বটগাছের মতো, সেই বাবা ছোটবেলা থেকে আমাদের কাছে ছিল না। ছোটবেলায় মায়ের কাছে শুনেছি বাবা দূরে কোথাও আছেন। বুঝতে শেখার পরে জেনেছি পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মামলায় বাবা কারাগারে আছেন। দীর্ঘ বছর বাবাকে ছাড়া পথ চলটা খুব কষ্টের ছিল। মা একা আমাদের মানুষ করেছেন।
স্বামীকে ফিরে পেয়ে শিরীন সুলতানা বলেন, দুই সন্তানের লেখাপড়া, খাবার, মামলা চালানোর খরচ সবকিছু সামলাতে সীমাহীন কষ্ট করতে হয়েছে। দীর্ঘ ১৬ বছর স্বামী থাকতেও তাকে ছাড়া থাকতে হয়েছে। মেয়েকে ডাক্তারি পড়ানোর ইচ্ছা থাকলেও অর্থাভাবে সম্ভব হয়নি।
তিনি আরও বলেন, যখন ছেলেমেয়েকে নিয়ে স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে যেতাম, তখন ছেলে তার বাবাকে চিনতে পারত না। বাবা তার মেয়েকে চিনতে পারত না। আমরাও এই দেশের জনগণ, কিন্তু সাবেক ফ্যাসিস্ট সরকার কখনো কোনো বিডিআর সদস্যের পরিবারের খোঁজখবর নেয়নি।
এখন পিলখানা ট্র্যাজেডির ঘটনায় স্বামীসহ সব চাকরিচ্যুত বিডিআর সদস্যদের চাকরি ফেরত ও ক্ষতিপূরণসহ বেতন-ভাতা পরিশোধের দাবি জানান তিনি।
পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে আলতাফ হোসেন বলেন, পিলখানা একটি বড় এলাকা, সবকিছু আমরা জানি না। কী ঘটেছিল তা বলতে পারব না। নতুন করে তদন্ত করা হচ্ছে। আমাদের বিশ্বাস, এখন সবকিছুরই সঠিক তথ্য বের হয়ে আসবে।
ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি বলেন, বিডিআর সদস্যদের জন্য বিডিআর কল্যাণ পরিষদ নামে একটি গ্রুপ আছে। ওই পরিষদের মাধ্যমে আমাদের চাকরি পুনর্বহল, আর্থিক ক্ষতিপূরণ পাওয়াসহ যে সিদ্ধান্ত আসবে সেই সিদ্ধান্তে আমি একমত। সর্বোচ্চ আদালত থেকে কয়েকবার আমি হত্যা মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছি। কিন্তু বারবার আপিল করে আমাদের আটকে রাখা হয়েছে। যেহেতু হত্যা মামলায় নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছি, তাই চাকরি পুনর্বহাল ও ক্ষতিপূরণের বিষয়ে কোনো বাধা থাকা উচিত নয়।