বাংলাদেশে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট যেসব আইন ও বিধি রয়েছে, এর বেশিরভাগই সংস্কার চায় যুক্তরাষ্ট্র। তাদের এই আগ্রহের বিষয়টি স্পষ্ট করতে ইতোমধ্যে সে দেশের বাণিজ্য দপ্তর ইউনাইটেড স্টেট ট্রেড রিপ্রেজেনটেটিভ (ইউএসটিআর) থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি ওয়াশিংটন ডিসি থেকে পাঠানো ওই চিঠিতে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংশ্লিষ্ট ৬ গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনার জন্য সুনির্দিষ্ট ১৮টি বিষয়ে তাদের আগ্রহ ব্যক্ত করা হয়। যার মধ্যে ১২টি আলোচনায় রাখা হয়েছে—শ্রম ইস্যু, ডিজিটাল বাণিজ্য, মেধাস্বত্ব এবং কৃষি বাণিজ্য সম্পর্কিত আইন, বিধি ও প্রবিধানের সংস্কার-অগ্রগতি এবং মূল্যায়ন পর্যালোচনা বিষয়ে। বাকি দুটি ইস্যু হলো বিনিয়োগ সমস্যা সম্পর্কিত এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নোটিফিকেশন বিষয়ক।
এতে আরও উল্লেখ করা হয়, এসব বিষয় আসন্ন ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেশন ফোরাম অ্যাগ্রিমেন্টের (টিকফা) বৈঠকে তারা জোরালো আলোচনায় আনবেন। উল্লেখ্য, এই টিকফা হলো যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ইস্যুতে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার একমাত্র প্ল্যাটফর্ম। ২০১৩ সালে দুই দেশের মধ্যে অভিন্ন উদ্দেশ্যে টিকফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এরপর এই ফেরামের ৬টি বৈঠক পর্যায়ক্রমে ঢাকা-ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর সপ্তম বৈঠকটি আগামী ২০ সেপ্টেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত হবে। এতে বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেবেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ। এর আগে ষষ্ঠ বৈঠকটি ওয়াশিংটন ডিসিতে অনুষ্ঠিত হয়।
ইউএসটিআরের চিঠি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সম্ভাব্য টিকফা ফোরামের এবারের আলোচনায় ইউএসটিআর প্রতিনিধিরা শ্রম ইস্যুতে ৫ সুনির্দিষ্ট বিষয় জোরালোভাবে পর্যালোচনা করবেন। ক্ষেত্রবিশেষে একই সঙ্গে এর ব্যাখ্যাও চাইবেন। তবে উল্লিখিত তথ্যমতে, এবিষয়ক আলোচনায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাবে বাংলাদেশে শ্রমিক ইউনিয়নবিরোধী অপতৎপরতা বা শ্রমিকবিরোধী সহিংসতার বিষয়ে। এ ছাড়া ইউনিয়ন গঠন বা অনুমোদনের ক্ষেত্রে বৈষম্য হচ্ছে, অন্যান্য ক্ষেত্রেও অন্যায্য শ্রম অনুশীলন হচ্ছে—এমন অভিযোগ রয়েছে তাদের কাছে। এসবের ব্যাখ্যা চাওয়া হবে এবারের আলোচনায়। একই সঙ্গে বাংলাদেশের শ্রম আইনসহ স্পেশাল ইকোনমিক জোন (এসইজেড) এবং ইপিজেড শ্রম আইন সংশোধনের খুঁটিনাটি, শ্রমিক ইউনিয়নের নিবন্ধন, শ্রম পরিদর্শন ও বাস্তবায়ন ইস্যুগুলো তারা সুচারুভাবে পর্যালোচনা করবেন।
এদিকে টিকফা ফোরামের বৈঠকে ডিজিটাল বাণিজ্যবিষয়ক আলোচনায় খসড়া ডাটা সুরক্ষা আইন এবং ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া এবং ওভার দ্য টপ (ওটিটি) প্ল্যাটফর্মের খসড়া প্রবিধান ইস্যুতে জোর দেবেন ইউএসটিআর প্রতিনিধিরা। অন্যদিকে মেধাস্বত্ববিষয়ক আলোচনায় তাদের গুরুত্ব থাকবে এসব খাত সম্পর্কিত নকল পণ্য এবং মেধাস্বত্ব আইন সংশোধনের ওপর। এ ক্ষেত্রে কপি রাইট আইন সংশোধন, শিল্প নকশা আইন, পেটেন্ট বিল এবং বাস্তবায়ন প্রবিধান, আমদানি-রপ্তানি বিধি বাস্তবায়নের নানাদিক ইউএসটিআর প্রতিনিধিরা বৈঠকে পর্যালোচনা করবেন। এতে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষেত্র বিশেষে এসব আইন, বিধি ও প্রবিধির খসড়া এবং চূড়ান্ত কপি চাওয়া হতে পারে। এ ছাড়া কৃষি বাণিজ্যবিষয়ক আলোচনায় ঢাকার সঙ্গে কৃষি জৈব প্রযুক্তি সংলাপ চাইবে ওয়াশিংটন। একই ইস্যুতে তারা বাংলাদেশের বীজ আইন বিধিমালার সংশোধন অগ্রগতি পর্যালোচনা করবেন। ইউএসটিআরের তথ্যমতে, এই বৈঠকে বিনিয়োগের সমস্যা সম্পর্কিত আলোচনায় আমেরিকান কোম্পানিগুলোর পাওনা পরিশোধ এবং মুনাফা প্রত্যাবাসনে বিলম্ব বিড়ম্বনার সুরাহা চাইবে ওয়াশিংটন। পাশাপাশি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নোটিফিকেশন ইস্যুতে শুল্কস্তর এবং বিভিন্ন বিষয়ে চেকলিস্ট সমস্যা সমাধানে অগ্রগতিও মূল্যায়ন করবেন ইউএসটিআর প্রতিনিধিরা।
এদিকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ‘অনলাইন স্বাধীনতা এবং বাংলাদেশে ব্যবসা ও বিনিয়োগ’ শীর্ষক এক প্যানেল আলোচনায় যোগ দিয়ে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ের ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া এবং ওভার দ্য টপ প্ল্যাটফর্মগুলোর জন্য প্রণীত প্রবিধানগুলোর পাশাপাশি খসড়া ডাটা সুরক্ষা আইন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের কথা আগেই জানিয়েছেন।
রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেন, আমরা যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করা ও এখানে তাদের ব্যবসা বৃদ্ধির ইচ্ছার কথা জানতে পেরেছি। বাংলাদেশের বাজার খুবই আকর্ষণীয়। তবে একই সময়ে আমরা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে এই আশঙ্কার কথা শুনতে পাই যে, প্রস্তাবিত নতুন আইন ও প্রবিধানগুলো তাদের জন্য এখানে ব্যবসা করা আরও কঠিন করে তুলবে। বিশেষ করে আমরা উদ্বিগ্ন যে, ডাটা সুরক্ষা আইন যদি ডাটা স্থানীয়করণের প্রয়োজনীয়তাকে কঠোরভাবে অনুসরণ করার শর্ত দিয়ে অনুমোদন করা হয়, তাহলে বর্তমানে বাংলাদেশে কাজ করছে এমন কিছু আমেরিকান কোম্পানি বাংলাদেশের বাজার ছেড়ে যেতে বাধ্য হতে পারে।
এ ছাড়া বিভিন্ন সময় ঢাকায় সক্রিয় মার্কিন কোম্পানিগুলো তাদের মুনাফা প্রত্যাবাসনে জটিলতা এবং পাওনা বিলম্বে পরিশোধের বিষয়ে মার্কিন দূতাবাস, বাণিজ্য, অর্থ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ জানিয়ে আসছে। সম্প্রতি দেশে বীমা খাতের মার্কিন কোম্পানি মেটলাইফ গত ৫ বছরে (২০১৬, ২০১৭, ২০১৮, ২০১৯ এবং ২০২০ সালের) মোট ১৩০০ কোটি টাকা নিজ দেশে পাঠাতে পারছে না বলে বীমা নিয়ন্ত্রক কোম্পানি (আইডিআরএ) অভিযোগ জানিয়ে তার সুরাহা চেয়েছে। এরকম আরও বিভিন্ন মার্কিন কোম্পানির অভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। টিকফা ফেরামের আলোচনায় বাংলাদেশ প্রতিনিধিদের কাছে মার্কিন প্রতিনিধিরা এর সন্তোষজনক ব্যাখা চাইবেন।
এ বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে বেসরকারি আর্থিক গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর কালবেলাকে বলেন, ‘এমন একটি কঠিন সময়ে এই টিকফা আলোচনাটি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, যখন সামনে বাংলাদেশের ইলেকশন, এলসিসি উত্তরণ এবং এর সঙ্গে বাজার সুবিধা দেওয়া-নেওয়ার মতো উভয় দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট অনেক বিষয় জড়িত। যদিও অনেকদিন ধরে অনেক ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে কিছু টানাপোড়েন ছিল এবং সেটি এখনো আছে। বিশেষ করে শ্রম ইস্যু সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান এখনো হয়নি। এ ছাড়া আরও স্পর্শকাতর বিষয় রয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র যেসব আইন-কানুন ও বিধি-বিধানের কথা বলছে, সেগুলোকে দেশের বাণিজ, বিনিয়োগ, অর্থনীতি তথা আন্তর্জাতিক বাজার কূটনীতির স্বার্থে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ কম। এ বিষয়ে আমাদের আরও মনোযোগ দিতে হবে। জটিলতার মতো বিষয়গুলো দূর করা নিয়ে ভাবতে হবে। আর ভাবনার ক্ষেত্রগুলো আরও দূরদর্শী হতে হবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের পদ্ধতিগুলো আরও সহজ করার বিষয়েও কারও দ্বিমত থাকার কথা নয়, যা বাংলাদেশিদের পাশাপাশি বিদেশিরাও চায়। সরকারকে এসব বিষয় অবশ্যই আমলে নিতে হবে। একই সঙ্গে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে টিকফা ফোরামের আলোচনায় দরকষাকষির জন্য আরও দক্ষ লোকের সন্নিবেশ ঘটানোরও পরামর্শ রাখেন তিনি।
এদিকে বাংলাদেশ-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চলমান কূটনীতি ও রাজনৈতিক মেরূকরণের প্রেক্ষাপটে এই মুহূর্তে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তা টিকফা ফোরামের বৈঠকে ঢাকার কাছে যুক্তরাষ্ট্রের ১৮ চাওয়ার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
যোগাযোগ করা হলে আনঅফিসিয়ালি একাধিক কর্মকর্তা কালবেলাকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অবস্থান তুলে ধরে বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়াগুলো (এজেন্ডা) তাদের নজরে এসেছে। সে অনুযায়ী মন্ত্রণালয় এখন টিকফা ফোরামের বৈঠকের জন্য বাংলাদেশের অবস্থানপত্র চূড়ান্ত করার কাজ করছে। সেখানেই আমরা বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরব। অবশ্য এক প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তারা জানান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া অনেক হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ একটা স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ। এখানকার আইন-কানুন এখানকার স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ীই হবে। তবে যেখানে যে বিষয়গুলোতে আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড থাকা উচিত এবং যেগুলো অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ, অর্থনীতি ও কূটনীতিকে সহজ করতে ভূমিকা রাখে, সেগুলো আমরা নিজেদের স্বার্থেই মূল্যায়ন করছি। সে অনুযায়ী সংস্কারেরও চেষ্টা হয়েছে। তবে এটা চলমান প্রক্রিয়া। প্রয়োজনে আরও সংস্কার করা হবে।
জানা গেছে, একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক গন্তব্য হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষ করে তৈরি পোশাক রপ্তানির বড় বাজার তারা। প্রতিবছর গড়ে ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাণিজ্য হয় দেশটির সঙ্গে। মোট আমদানির মাত্র ৩ দশমিক ৭ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনা হয়। তবে আমদানি কম হলেও বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের (এফডিআই) শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, এখন পর্যন্ত দেশে মোট বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ২ হাজার ১১৬ কোটি ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ দাঁড়ায় (১০৬ টাকা দরে) ২ লাখ ২৪ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা। এই বিদেশি বিনিয়োগের ১৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ বা ৪১০ কোটি ডলার এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ ৪৩ হাজার ৪৬০ কোটি টাকারও বেশি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, দেশে বিদেশি বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি রয়েছে গ্যাস ও জ্বালানি খাতে। যার পরিমাণ ৩৮৭ কোটি ডলার। এর মধ্যে ২৯১ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র বীমা খাতে ২৭ কোটি ডলার, আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে ২৪ কোটি ডলার, ব্যাংকিং খাতে ২০ কোটি ডলার, বিদ্যুৎ খাতে ১৭ কোটি ডলার, টেক্সটাইল খাতে ১২ কোটি ডলার, ট্রেডিংয়ে ৮ কোটি ডলার, কেমিক্যাল এবং ফার্মাসিউটিক্যালসে ৯৬ লাখ ডলার, কৃষি ও মৎস্যে ৩০ লাখ ডলার, খাদ্যে ২২ লাখ ডলার, নির্মাণ খাতে ১৯ লাখ ডলার এবং অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ করেছে ৮ কোটি ডলার।
মন্তব্য করুন