রায়হান রাসেল, নেপাল থেকে ফিরে
প্রকাশ : ২০ আগস্ট ২০২৩, ০২:৩৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
মানব পাচার

ইউরোপের কথা বলে নেপালে নিয়ে জিম্মি

ইউরোপের কথা বলে নেপালে নিয়ে জিম্মি

‘কী করমু, কোন মুখে দেশে ফিরমু? দেখি একটা কাজ জোগাড় করে এখানে থাকা যায় কি না’—কাঁদতে কাঁদতে মোবাইল ফোনে কথাগুলো বলছিলেন বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া এক নারী (ভুক্তভোগীর অনুরোধে নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না।) নিজ দেশের সাংবাদিক শুনে যেন কান্নার মাত্রাটা বেড়ে যায় আরও। চিৎকার দিয়ে বলে ওঠেন, ‘স্যার, আমাগো থাকার কথা দুবাই; কিন্তু নেপালে পইড়া আছি।’ পাশ থেকে পাচারের শিকার আরেক নারী বলেন, ‘দুজনের কাছ থেকে আড়াই লাখ করে মোট ৫ লাখ টাকা নিছে, দুবাই পাঠাইব কইয়া। অনেক কষ্টে টাকা জোগাড় করে দিছি। ওই টাকা এখন কেমনে ফেরত দিমু, কী খামু, বাঁচমু কেমনে, কিছুই জানি না।’

ঘটনার আড়ালের সত্যটা জানতে যেতে হবে ফ্লাশব্যাকে। গত ১৩ আগস্ট নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে গ্রেপ্তার হন পাঁচ বাংলাদেশি ও দুই নেপালি নাগরিক। তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশিদের নেপালে এনে জিম্মি করে চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে। মূলত তারা ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে কাজ দেওয়ার কথা বলে নেপালে নিয়ে জিম্মি করে নির্যাতন চালাত। পরে পরিবারে কাছে মোবাইলে ফোন দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করত।

গ্রেপ্তাররা হলো গাজীপুরের আমির হোসেন, বরিশালের মো. মশিউর, সেলিম মিয়া, জাহাঙ্গীর আলম ও তাহমিনা। দুই নেপালি নাগরিক হলেন রোশনি রাই ও এলম চুলাচুলি। তবে মানব পাচার ও জিম্মি করে অর্থ আদায়কারী চক্রের মূলহোতা মতিন মিয়া এবং রাজু ওরফে রিও রায়েন (বাড়ি শরীয়তপুর হলেও নিজেকে নেপালি বলে পরিচয় দেয়) অভিযানের সময় পালিয়ে যায়। ‘ব্রাভো কিলো’ নামে পরিচালিত ওই অপারেশনে দুই নারীসহ বাংলাদেশের আট নাগরিককে উদ্ধার করে দেশটির পুলিশ। চক্রটি তাদের বাংলাদেশ থেকে নেপালে নিয়ে যায় ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের উন্নত দেশে পাঠানোর কথা; কিন্তু তা না করে কাঠমান্ডুর বিভিন্ন হোটেল ও সেফ হাউসে জিম্মি করে পরিবারের কাছে টাকা দাবি করে এবং বিভিন্ন উপায়ে আদায়ও করে নেয়।

যেভাবে শুরু অপারেশন ব্রাভো কিলো অপারেশন ব্রাভো কিলোর সূত্রপাত বাংলাদেশ থেকেই। মিরপুর-৬-এর বাসিন্দা মো. শাহবুদ্দিনের (বর্তমানে পলাতক) প্রলোভনে পড়ে পোল্যান্ডে যাওয়ার কথা ছিল রাজন ও ফরহাদ হোসেনের; কিন্তু বিমানে ওঠার বেশ কিছুদিন পার হয়ে গেলেও কারোরই খোঁজ পাচ্ছিল না তাদের পরিবার। পরে পরিবার দুটির পক্ষ থেকে ঢাকা জর্জকোর্টের আইনজীবী আবু বকর সিদ্দিকের কাছে সহায়তা চান বিষ্ণু সাহা অভি। পরে আবু বকর সিদ্দিকের পরামর্শে ওই দুজনের সন্ধান চেয়ে ঢাকার মিরপুর মডেল থানা, শাহআলী থানা ও টাঙ্গাইলের বাশাইল থানায় প্রথমে মামলা এবং পরে সাধারণ ডায়েরি করার চেষ্টা করেন বিষ্ণু। ঘটনা বাংলাদেশের নয় উল্লেখ্য করে তাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হয় থানা থেকে। অভির দাবি, অনেক জোরাজুরির পর মিরপুর মডেল থানা শুধু সাধারণ ডায়েরি গ্রহণ করে। পরে অ্যাডভোকেট আবু বকর সিদ্দিককে নেপালে যাওয়ার অনুরোধ করেন রাজন ও ফরহাদ হোসেনের পরিবার। সেখানে গিয়ে স্থানীয় বন্ধু খাদকা বহরার সহায়তায় প্রথমে ট্যুরিস্ট পুলিশ পরে দেশটির গোয়েন্দা সংস্থার কাছে লিখিত অভিযোগ দেন তিনি। এর পরই অভিযানে নামে নেপালি গোয়েন্দা সংস্থা।

এ ব্যাপারে অ্যাডভোকেট আবু বকর কালবেলাকে বলেন, নেপালে যাওয়ার পর প্রথমে সেখানকার ট্যুরিস্ট পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা গোয়েন্দা সংস্থার কাছে নিয়ে যায়। লিখিত অভিযোগ করতে বলে। এরপর আমাকে নিয়ে দুদিন অভিযান পরিচালনা করে। পরে অসুস্থ হয়ে পড়লে দেশে ফিরে আসি। ভুক্তভোগীদের উদ্ধার করে নেপাল পুলিশ আমাকে একটি ধন্যবাদ মেসেজ দিয়েছে।

যেভাবে পরিচালিত অপারেশন ‘ব্রাভো কিলো’ :

কাঠমান্ডু ভ্যালি ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন অফিসের প্রধান মনোজ কেসি, অপারেশন ব্রাভো কিলোর বর্ণনা দেন। তিনি জানান, ‘১১ আগস্ট একটি অভিযোগ আসে। নেপালে দুজন বাংলাদেশিকে জিম্মি করে টাকা আদায় করা হচ্ছে এমন অভিযোগ পেয়ে অভিযানের পরিকল্পনা করি। যার নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন ব্রাভো কিলো’।

পাসপোর্ট নম্বর দিয়ে সার্চ করে জানতে পারি, ওই দুই বাংলাদেশি নেপালেই আছে। এরপর গোয়েন্দা তৎপরতা শুরু। এ সময় মনোজ কেসি আরও বলেন, টানা দুদিন আমরা বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালাই। শেষ দিন ১৩ আগস্ট বিশেষ তদন্ত দলটি কাঠমান্ডুর কালিমাটিডোরের মেমোরিয়াল গেস্ট হাউসে অভিযান চালিয়ে চক্রের অন্যতম সদস্য আমির হোসেনকে আটক এবং চার বাংলাদেশিকে উদ্ধার করা হয়।

পরে জিজ্ঞাসাবাদে আরেকটি আস্তানার কথা জানান গ্রেপ্তার আমির হোসেন। তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ললিতপুরের হরসিদ্ধি এলাকার একটি ভাড়া বাড়ি থেকে রাজন, ফরহাদ হোসেনসহ আরও দুই বাংলাদেশিকে উদ্ধার করা হয়। এ সময় মো. মশিউর, সেলিম মিয়া, জাহাঙ্গীর আলম ও তাহমিনা বেগমকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে পালিয়ে যায় মূলহোতা তাহমিনার স্বামী মতিন মিয়া ও রাজু ওরফে রিও রায়েন।

চক্রে কার কী দায়িত্ব :

কাঠমান্ডু ভ্যালি ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন অফিসের (গোয়েন্দা বিভাগ) দাবি চক্রের মূলহোতা মতিন মিয়া। বিবাহ সূত্রে সে নেপালেরও নাগরিক। অন্য সদস্যদের কাজ বুঝিয়ে দিত এবং নেপাল বিমানবন্দরে ভুক্তভোগীদের অভ্যর্থনা জানাত। টাকা-পয়সা লেনদেন করত জাহাঙ্গীর আলম। তার বিরুদ্ধে হুন্ডি ব্যবসারও অভিযোগ আছে। মো. মশিউরের কাজ ছিল জাল পাসপোর্ট তৈরি ও ভিসা প্রসেসিং করা। সেলিম মিয়া, তাহমিনা বেগম ও রাজু ভুক্তভোগীদের জিম্মি ও নির্যাতন করে পরিবারের কাছ থেকে টাকা আদায় করত।

সচেতনতা বৃদ্ধির দাবি নেপাল পুলিশের :

কাঠমান্ডু ভ্যালি ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন অফিস গ্রেপ্তারদের বিরুদ্ধে নেপালের সংঘটিত অপরাধ প্রতিরোধ আইনের অধীনে ফৌজদারি কার্যবিধি দুটি ধারায় মামলা করেছে। বর্তমানে তাদের কাঠমান্ডু পুলিশ কমপ্লেক্স কারাগারে রাখা হয়েছে। ট্যুরিস্ট পুলিশের পরিদর্শক সাগর থাপা বলেন, ঘটনাটি নেপালে ঘটলেও উদ্ধারকৃত এবং গ্রেপ্তার হওয়া প্রায় সবাই বাংলাদেশের। প্রায়ই খবরে দেখি বাংলাদেশিরা মানব পাচারের শিকার হচ্ছেন। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি বাংলাদেশ পুলিশকে আরও সজাগ থাকতে হবে।

হতভম্ব প্রবাসীরা :

জিম্মি ও টাকা আদায়ের এমন ঘটনায় হতভম্ব নেপালে বসবাসকারী প্রবাসীরা। তেমনই একজন আরিফ ইসলাম। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে নেপালে বসবাসকারী আরিফ বলেন, গ্রেপ্তার হওয়া প্রায় সবাইকে ভালোভাবে চিনি; কিন্তু তারা এসব কাজে জড়িত, তা কোনোভাবে টের পাইনি। শুধু জানতাম, বিভিন্ন নির্মাণ প্রকল্পের জন্য দেশ থেকে শ্রমিক আনত তারা।

এদিকে উদ্ধারকৃতদের দেশে পাঠাতে নেপালের অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের অসহযোগিতার অভিযোগ এনেছেন হারুন উর রশিদ। তিনি বাংলাদেশের বহুজাতিক কোম্পানি প্রাণের কান্ট্রি হেড হিসেবে বর্তমানে নেপালের কর্মরত। তিনি বলেন, দূতাবাসের সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন ছিল; কিন্তু ‘ট্রাভল পাস’ অজুহাতে উদ্ধারকৃতদের যেতে দেওয়া হচ্ছে না। এত মানুষের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করার কথাও তাদের; কিন্তু দূতাবাস তা করেনি। এসব ভুক্তভোগীর কাছ থেকে সব টাকা-পয়সাই দালালরা আগেই ছিনিয়ে নিয়েছে। এখন আমরা প্রবাসীরা তাদের হোটেলের খরচ বহন করছি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার, পদ ফিরে পেলেন বিএনপি নেতা

নীলফামারীতের অবাধে অতিথি পাখি নিধন

রাজধানীতে আজ কোথায় কী

ওয়াশিংটনে ট্রাম্পের সেনা মোতায়েন স্থগিতের নির্দেশ আদালতের

শুক্রবার রাজধানীর যেসব এলাকার মার্কেট বন্ধ

২১ নভেম্বর : আজকের নামাজের সময়সূচি

আজ ৬ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকবে না যেসব এলাকায়

কাপড়ের রং-গোখাদ্য দিয়ে তৈরি হচ্ছিল হলুদ-মরিচের গুঁড়া

নারীদের ৫ প্রতিশ্রুতি দিলেন তারেক রহমান

পাসপোর্ট জালিয়াতি, যে শাস্তি পেলেন সহকারী প্রোগ্রামার

১০

তারেক রহমানের জন্মদিনে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ

১১

ব্রাজিলে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড

১২

রাফিয়ার বাড়িতে ককটেল-অগ্নিসংযোগ, ঢাবি শিক্ষক মোনামির প্রশ্ন

১৩

ঢাকার খাবারের ঝালে মজেছেন ইরানি ফাকরি

১৪

শেখ হাসিনা-কামালকে ফেরাতে সরকারের নতুন কৌশল

১৫

পুনরায় দুঃসংবাদ পেলেন বিএনপির এক নেতা

১৬

সেই বিচারকের মোবাইল ফোন ও চশমা উদ্ধার

১৭

তারেক রহমানের জন্মদিনে শীতবস্ত্র বিতরণ

১৮

নিউমুরিং টার্মিনালের চুক্তির সব কার্যক্রম স্থগিতের নির্দেশ

১৯

সিলেটের যেসব এলাকায় বিদ্যুৎ থাকবে না শুক্রবার 

২০
X