দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন চট্টগ্রামের দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপ। এই সন্দ্বীপেরই ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন একটি ইউনিয়নের নাম উড়িরচর। প্রায় ৪০ হাজার জনগোষ্ঠীর এই জনপদে কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই। নেই কোনো চিকিৎসকও। সর্বরোগের জন্য কয়েকটা ফার্মেসিই ভরসা। আর ফার্মেসি যারা পরিচালনা করেন, তাদের বেশিরভাগেরই কোনো প্রশিক্ষণ বা ডিগ্রি নেই। ফলে প্রায়ই বিনা চিকিৎসায় মারা যান রোগীরা। সর্বশেষ গত সপ্তাহে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হয় এক প্রসূতির।
এই তো কেবল স্বাস্থ্যসেবার চিত্র। এই জনপদের অন্যান্য নাগরিক সেবার চিত্রও একই। কলেজ তো দূরের কথা, নেই কোনো এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও। নাগরিক সুবিধার ছিটেফোঁটাও নেই এই জনপদে। আছে কেবল বঞ্চনা আর হাহাকার। নদীভাঙন এখানকার প্রত্যেক ব্যক্তিরই যেন নিয়তি। সূর্য ডোবার আগেই বন্ধ হয়ে যায় মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগ। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় দিনের পর দিনও থাকতে হয় বিচ্ছিন্ন অবস্থায়।
নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জ আর চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের মাঝামাঝিতে উড়ির চরের অবস্থান। ১৯৭০-৭১ সালে সন্দ্বীপের উত্তর-দক্ষিণ ও মেঘনার মোহনায় চরটি জেগে ওঠে। চারদিকে মেঘনা নদীবেষ্টিত চরে জেগে ওঠা ঘাস বা উড়ি থেকে স্থানীয়রা চরটির নাম দেন উড়িরচর। তখন থেকেই ভূমিহীন মানুষ সেখানে বসবাস শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৮০ সালে সন্দ্বীপের ভাঙনকবলিত জনগোষ্ঠীকে নিয়ে গঠিত হয় উড়িরচর ইউনিয়ন। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে তারা উড়িরচরে বসবাস করছেন।
উপজেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, এই ইউনিয়নের বর্তমান আয়তন ১০৫ দশমিক ২ বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা ১১ হাজার ২৬৫ জন। ভোটার সংখ্যা ৭ হাজার ২৩২ জন। তবে স্থানীয়রা বলছেন, জনসংখ্যার তথ্যটি সঠিক নয়। উড়িরচরের বর্তমান জনসংখ্যা ৪০ হাজার ছাড়িয়েছে।
ইউপি নির্বাচন হচ্ছে না ২২ বছর: ২০০৩ সালে সর্বশেষ এই ইউনিয়নে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে জয়ী হন খাইরুল আলম। ২০০৫ সালে দুর্ঘটনাজনিত কারণে তার মৃত্যু হলে আর কোনো নির্বাচন দেখেননি এ এলাকার জনগণ। পরবর্তী সময়ে নোয়াখালী ও সন্দ্বীপের সীমানা জটিলতা নিয়ে স্থানীয় রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে মামলা গড়ায় আদালতে। ২২ বছর ধরে একজন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করে এলেও সম্প্রতি তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। বর্তমানে এই ইউনিয়নের সবকিছু দেখভাল করছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)।
নেই চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে থাকে পুলিশ: চরের এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য মোটামুটি মানেরও কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই। একটি কমিউনিটি ক্লিনিক থাকলেও নেই কোনো চিকিৎসক। কারও কোনো অসুখ হলে স্থানীয় ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে খেতে হয়। আর অবস্থা গুরুতর হলে নিয়ে যেতে হয় চট্টগ্রাম শহর কিংবা নোয়াখালীতে। এতে সময় লাগে ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা। প্রায়শই সাপের কামড় ও বিভিন্ন অসুখে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে। সর্বশেষ গত সপ্তাহে নোয়াখালী নেওয়ার পথে প্রসব-পরবর্তী জটিলতায় মৃত্যু হয় এক মায়ের।
পরিবার কল্যাণকেন্দ্রের তিনতলা বিশিষ্ট ভবন থাকলেও সেখানে সরেজমিনে গিয়ে স্বাস্থ্যসেবার কোনো কার্যক্রম দেখা যায়নি। প্রতিটি কক্ষ ধুলায়ধুসরিত। সেখানে পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরা অবস্থান করেন।
চিকিৎসক না থাকার বিষয়টি জানিয়ে সন্দ্বীপ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মানস বিশ্বাস কালবেলাকে বলেন, উড়িরচরে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক আছে। সেখানে একজন মাধ্যমিক পাস কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার আছেন। পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র একজন ডাক্তার ছিলেন, তিনি বর্তমানে ডেপুটেশনে ঢাকায় আছে। আমরা কর্তৃপক্ষকে নিয়মিত জানাচ্ছি।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে হাতেগোনা: উড়িরচরে শিক্ষার অবস্থাও শোচনীয়। এই ইউনিয়নে প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে মাত্র ৪টি। এর মধ্যে তিনটিরই প্রধান শিক্ষক নেই। অন্যদিকে মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে মাত্র একটি। দাখিল মাদ্রাসা তিনটি, ইবতেদায়ি মাদ্রাসা আছে দুটি। এ ছাড়া বেশ কিছু কওমি মাদ্রাসা রয়েছে। এই জনপদে স্কুলের চেয়ে মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা তুলনামূলক বেশি।
৪০ হাজার মানুষের নিরাপত্তায় মাত্র ১২ পুলিশ: মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় এই জনপদে প্রায়ই আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে। জমি দখল, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে মারামারিতে লিপ্ত হয় এখানকার মানুষ। এ সময় অস্ত্রের মহড়া দিতেও দেখা যায় বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। প্রায় ৪০ হাজার জনগোষ্ঠীর এই জনপদের নিরাপত্তায় আছে মাত্র ১২ জন পুলিশ। একটি পুলিশফাঁড়ি থাকলেও নেই কোনো স্থায়ী ভবন। বিচ্ছিন্ন এই জনপদে ১২ জন পুলিশ মোটেও পর্যাপ্ত নয় বলছেন স্থানীয়রা।
নদীভাঙনে দিশেহারা সবাই: উড়িরচরের বর্তমান প্রধান সমস্যা নদীভাঙন। প্রমত্ত মেঘনা প্রতিনিয়ত গিলে খাচ্ছে এই জনপদের মানুষের ভিটেবাড়ি ও চাষাবাদের জমি। কৃষিনির্ভর এই চরের মানুষজন নদীভাঙনে নিঃস্ব হওয়ার পথে। এক প্রান্ত থেকে নদীভাঙনের শিকার হয়ে অন্য প্রান্তে গিয়ে কোনোমতে দাঁড়ানোর আগেই ভেঙে যায় ভিটেবাড়ি। বর্তমানে চরের দক্ষিণ অংশ অর্থাৎ সন্দ্বীপের দিকে তীব্রভাবে নদী ভাঙছে।
প্রতিকার চেয়ে রাস্তায় হাজারও মানুষ: উড়িরচরের নদী ভাঙনরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতসহ নাগরিক সুবিধার দাবিতে সোমবার স্থানীয় বাংলা বাজার জিরো পয়েন্ট মোড়ে মানববন্ধন করেছেন চরবাসী। সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত এই মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় প্রখর রোদ উপেক্ষা করে স্থানীয় বিদ্যালয় ও মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক, কৃষক, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশার হাজারও মানুষ উপস্থিত হয়ে বৈষম্য ও জবরদখলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেন।
মানববন্ধনে তারা চরের সীমানা জটিলতা নিরসন, কোম্পানীগঞ্জ ক্রসড্যাম দ্রুত বাস্তবায়ন, সন্ত্রাস নির্মূলসহ নানা দাবিতে স্লোগান ও প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেন।
স্থানীয় দোকানদার ও কৃষক খোকন সওদাগর কালবেলাকে বলেন, ১৯৮৫ থেকে এই পর্যন্ত আমি চারবার নদীভাঙনের শিকার হয়েছি। আরেক জায়গায় গিয়ে মাথা তুলে দাঁড়ানোর আগে আবারও ভাঙে। সর্বশেষ চার বছর আগে নদীভাঙনে অনেককিছু হারিয়েছি। নদীভাঙন ছাড়াও বেড়িবাঁধ না থাকায় জোয়ার, জলোচ্ছ্বাসে ফসল নষ্ট হয়ে যায়।
উড়িরচর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ হাছান কালবেলাকে বলেন, নদীভাঙনে সবাই দিশেহারা। নদীভাঙন রোধে আমরা কার্যকর পদক্ষেপ চাই।
উড়িরচরের সন্তান ও গণমাধ্যমকর্মী নুর নবী রবিন কালবেলাকে বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার বয়স আর উড়িরচরের বয়স কাছাকাছি। স্বাধীনতার পর দেশের চেহারা অনেকটা পাল্টে গেলেও উড়িরচরের অবস্থা জন্মলগ্নের মতোই থেকে গেছে। এই জনপদের মানুষ মৌলিক অধিকারগুলো থেকেও বঞ্চিত। নদীভাঙনে নিঃস্ব হওয়ার পথে প্রতিটি মানুষ। আমাদের এখানে কোনো হাসপাতাল নেই, ডাক্তার নেই। যোগাযোগের ভালো কোনো ব্যবস্থা নেই। নেই বলতে কিছুই নেই। নাগরিক হিসেবে আমরা আমাদের মৌলিক অধিকারগুলো চাচ্ছি। এটা কি রাষ্ট্রের কাছে খুব বেশি চাওয়া—প্রশ্ন রাখেন রবিন।
ইউনিয়ন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম জাবেদ বলেন, আমরা চরবাসী সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছি। জানতে চাইলে ইউএনও রিগ্যান চাকমা কালবেলাকে বলেন, চর উন্নয়ন ও বন্দোবস্ত প্রকল্পের আওতায় উড়িরচরে কিছু রাস্তাঘাট করে দেওয়া হয়েছে। প্রায় ২ হাজার পরিবারকে দেড় একর করে ভূমি দেওয়া হয়েছে। সীমানা জটিলতা সংক্রান্ত একটি বিষয় নিয়ে রিট থাকায় দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচন হচ্ছে না। সীমানা বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য কাজ চলছে। বিরোধ নিষ্পত্তি হলে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আর জনবলসহ অন্যান্য বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হচ্ছে।
মন্তব্য করুন