রাশেদ রাব্বি
প্রকাশ : ০৮ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০৮ মে ২০২৫, ০৭:৫৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

স্বাস্থ্য কমিশনের বেশিরভাগ প্রস্তাব বাস্তবায়নে সংশয়

সংস্কার প্রতিবেদন
স্বাস্থ্য কমিশনের বেশিরভাগ প্রস্তাব বাস্তবায়নে সংশয়

২০১১ সালের জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়নের ১৪ বছর পর আবারও দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সংস্কারে একটি প্রস্তাবনা এসেছে। বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর দেশের বিভিন্ন খাতের মতো স্বাস্থ্য খাত সংস্কারে একটি কমিশন গঠন করে। দুই দফা মেয়াদ বাড়িয়ে গত ৫ মে এই কমিশন প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন পেশ করে। ৩২২ পৃষ্ঠার বিশাল এই প্রতিবেদনে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সংস্কারে বিপুলসংখ্যক সুপারিশ থাকলেও জনস্বাস্থ্য বিষয়টি উপেক্ষিত বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা বিষয়ে একাধিক সুপারিশ থাকলেও প্রতিবেদনে রোগ প্রতিরোধের বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশ করা হলেও স্বাস্থ্য সংস্কারে সুস্পষ্ট কোনো মডেল অনুসরণের কথা বলা হয়নি। অনেক আইন প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে, যা মোটেও বাস্তবসম্মত নয়।

এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়) অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, প্রতিবেদনে স্বাস্থ্য খাতের অনেক পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে, যা কল্যাণমুখী। আমরা প্রতিবেদন পেয়েছি, এর বাস্তবায়নযোগ্যতা দেখতে চাই। কিছু সুপারিশ সরকারি আদেশ জারি করে বাস্তবায়ন করা সম্ভব, কিছু সুপারিশ বাস্তবায়নে আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে, কিছু সুপারিশ বাস্তবায়নে আর্থিক সংগতি প্রয়োজন, আবার কিছু সুপারিশ আছে যেগুলো বাস্তবায়নে কাঠামোগত পরিবর্তন দরকার। আমরা রোডম্যাপ তৈরির উদ্যোগ নিয়েছি। রোডম্যাপ সম্পন্ন হলে সুপারিশগুলো ক্রমান্বয়ে বাস্তবায়নের দিকে যাওয়া হবে। বিশেষ করে যেগুলো বাস্তবায়নে আর্থিক সংগতি আছে এবং বর্তমান সরকারের সক্ষমতা রয়েছে।

সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে ‘মৌলিক অধিকার’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে দরিদ্রদের জন্য বিনামূল্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার প্রস্তাব করেছে সংস্কার কমিশন। এ ছাড়া স্বাস্থ্য সার্ভিস চালু, মেডিকেল পুলিশ গঠন, জাতীয় বাজেটের ১৫ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের সুপারিশও করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের প্রাক্তন চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. রুহুল ফুরকান সিদ্দিক বলেন, সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে ‘মৌলিক অধিকার’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে দরিদ্রদের জন্য বিনামূল্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে, যা অন্তর্বর্তী সরকরের পক্ষে সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন নির্বাচিত জনগণের সরকার। তা ছাড়া দরিদ্রের সংজ্ঞা কী হবে, দরিদ্র হিসেবে কারা এই সুবিধা প্রাপ্ত হবেন—সেটিও সুস্পষ্ট নয়। এর আগে এসএসকে (স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি)তে দরিদ্রদের স্বাস্থ্য কার্ড প্রদানের ক্ষেত্রে একই জটিলতা দেখা গেছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে জনস্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিতে হবে। কিন্তু এই প্রস্তাবনায় জনস্বাস্থ্য অনেকটা উপেক্ষিত। যদি প্রাথমিক চিকিৎসা নিশ্চিতের কথা বলা হয়, তাহলে প্রাথমিক চিকিৎসার মধ্যে কী কী থাকবে, সেটি স্পষ্ট করতে হবে। যদি জরুরি প্রাথমিক সেবা বা চিকিৎসার কথা বলা হয়, তাহলে সেটিও সুনির্দিষ্ট করতে হবে। স্বতন্ত্র সার্ভিস গঠনের কথা বলা হয়েছে, যা স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্তঃকোন্দল সৃষ্টি করবে। এটি বাস্তবায়নে বৃহত্তর পরিসরে স্বাস্থ্যসেবায় সম্পৃক্ত সব স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে আলোচনা, বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে ও পরবর্তী সময়ে জাতীয় সংসদে আলোচনা-পর্যালোচনার মধ্যেমে অনুমোদ হতে হবে। তিনি বলেন, একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, সিভিল ও পলিটিক্যাল রাইটস এবং ফান্ডামেন্টাল রাইটস এক নয়। তা ছাড়া জুডিশিয়ারি এনফোর্সমেন্টের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত পেশাজীবীদের রাজনৈতিক কারণে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। তাদের বিরাজনীতিকরণের বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি।

অধ্যাপক ফুরকান বলেন, তামাকজাত পণ্য, কোমল পানীয় এবং ট্রান্সফ্যাট জাতীয় খাদ্যপণ্যের ওপর অতিরিক্ত করারোপ করে সেই টাকা স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এটি কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, তার কোনো উল্লেখ নেই। সার্বোপরি সংস্কার কমিশনের সুপারিশে ১৯৭৮ সালের আলমা আটা সম্মেলনে স্বাস্থ্যকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এবং উন্নত দেশগুলোতে স্বাস্থ্যকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, তার প্রতিফলন নেই। এখানে স্বাস্থ্যকে চিকিৎসায় আবদ্ধ করা হয়েছে।

কমিশন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল আইন, মেডিকেল শিক্ষা অ্যাক্রেডিটেশন আইন, নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কাউন্সিল আইন, বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিল আইন, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন, পৌর ও সিটি কপোরেশন আইন সংশোধনের সুপারিশ করেছে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন বেশ বড়, অনেক কিছু এতে সন্নিবেশিত হয়েছে। কিন্তু যেসব বিষয়গুলো উপস্থাপন করা হয়েছে সেগুলোকে ফ্রেমওয়ার্কে আনতে পারলে ভালো হতো। আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত স্বল্পমূল্যে গুণগত সেবা প্রদান করা। এটা নিশ্চিতে কী কী পরিবর্তন প্রয়োজন, সেটা উল্লেখ করা প্রয়োজন ছিল। প্রতিবেদনে নতুন করে অনেক আইন প্রণয়ের কথা বলা হয়েছে, যা একপ্রকার অসম্ভব। এ ক্ষেত্রে বিষয়গুলোকে তিন থেকে চারটি আইনে সন্নিবেশিত করলে সেটি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সহজ ও বাস্তবসম্মত হতো। জাতীয় বাজেটের ১৫ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দে কথা বলে হয়েছে, যা বাস্তবসম্মত নয়। এটি সরকারের সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে। একই সঙ্গে ধনীদের প্রদেয় করের ৫ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের কথা বলা হয়েছে, ট্যাক্সের বড় অংশই আসে ধনীদের মধ্যেমে, যা রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে প্রয়োজন অনুসারে ব্যবহার করা হয়।

কমিশনের প্রতিবেদন প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এমিনেন্স এর নির্বাহী পরিচালক ও জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. শামীম হায়দার তালুকদার বলেন, এটি ভালো উদ্যোগ। এটাকে বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। তবে কিছু বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়, যেমন জাতীয় বাজেটের ১৫ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই বিপুল অর্থ ব্যয়ের সক্ষমতা অর্জনের পরিকল্পনা করা হয়নি। স্বাস্থ্যের উন্নয়নে টাকার যেমন প্রয়োজন, তেমনি সেটি ব্যয়ে সক্ষমতাও অর্জন করতে হবে। ব্যবস্থাপত্রে ওষুধের জেনিরেক নাম লেখার সুপারিশ করা হয়েছে, কিন্তু সেটি কীভাবে মনিটরিং হবে, তার উল্লেখ নেই। যদি চিকিৎসক জেনেরিক নাম না লেখেন, তাহলে কী শাস্তি হবে, কোন পদ্ধতিতে হবে তারও উল্লেখ নেই। বিশাল প্রতিবেদনে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে আলোচনা হলেও জনস্বাস্থ্য নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। অর্থাৎ রোগ হলে চিকিৎসা দেওয়ার কথা বলা হলো, কিন্তু রোগ যেন না হয় সে বিষয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। এমনকি দেশের বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে ৬৪ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হয়। এগুলো নিয়ন্ত্রণ, মানোন্নয়নে কিছুই বলা হয়নি। তবুও এটা একটা শুরু।

প্রসঙ্গত, সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আর্থিক অনিয়মের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, বহু নিরীক্ষা আপত্তি অমীমাংসিত থেকে গেছে। বিশ্বব্যাংকের পাবলিক ফিন্যান্স ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে একটি গবেষণায় দেখা যায়, ৮ হাজারের বেশি নিরীক্ষা আপত্তি এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। এই আপত্তিগুলোর আর্থিক মূল্য ৬ লাখ ৬৩ হাজার ৫৯ কোটি টাকা এবং উন্নয়ন বাজেটে ৩ হাজার ৪৭০ কোটি টাকা। এর প্রায় ৯৫ শতাংশ আপত্তি রাজস্ব বাজেট সম্পর্কিত। তবে দুর্নীতি প্রতিরোধে কোনো সুস্পষ্ট সুপারিশ করা হয়নি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ভারতে হামলা করা ড্রোন তুরস্কের তৈরি, এরদোয়ানের দিকে অভিযোগের তীর

আ.লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে এক্সপ্রেসওয়ে ৫ ঘণ্টা ব্লকেড, চরম ভোগান্তি 

ভারতে শক্তিশালী ফাতাহ-১ ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে পাকিস্তান

পাকিস্তানি হামলার পরপরই সংবাদ সম্মেলন স্থগিত ভারতীয় বাহিনীর

ভারত-পাকিস্তানের ক্ষেপণাস্ত্র : কার জোর কতটুকু

পরিত্যক্ত বাড়িতে ককটেল বিস্ফোরণ, গ্রেপ্তার ৩

জুলাই যোদ্ধাদের তালিকায় আ.লীগ নেত্রীর মেয়ে, প্রতিবাদ করায় কুপিয়ে জখম

কেঁপে উঠল পাকিস্তান / তিন বিমানঘাঁটিতে বিস্ফোরণ, বন্ধ আকাশপথ

আজ যেমন থাকবে ঢাকার আবহাওয়া

ট্রাকের ধাক্কায় অটোরিকশায় থাকা মা-মেয়ে নিহত

১০

১০ মে : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১১

ভারতে পাল্টা হামলা শুরু করেছে পাকিস্তান

১২

শনিবার রাজধানীর যেসব মার্কেট বন্ধ

১৩

১০ মে : আজকের নামাজের সময়সূচি

১৪

এপ্রিলে সীমান্তে ১০১ কোটি টাকার চোরাচালান পণ্য জব্দ বিজিবির

১৫

আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধে সর্বদলীয় কনভেনশনের আহ্বান এবি পার্টির

১৬

আওয়ামী লীগসহ তাদের অঙ্গসংগঠনকে নিষিদ্ধ করতে হবে : সপু

১৭

সংখ্যাগুরু কিংবা সংখ্যালঘুর ওপর নিরাপত্তা নির্ভর করে না : তারেক রহমান

১৮

বিএনপি ক্ষমতায় গেলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান দলীয়করণ করা হবে না : আমিনুল হক

১৯

কেশবপুরে পূজা উদযাপন ফ্রন্টের কর্মীসভা

২০
X