ছাত্র-জনতার বিজয়ের আগ মুহূর্তে ৫ আগস্ট সকাল ৯টার দিকে নাশতা খেয়ে কাউকে কিছু না বলে রাজধানীর ডেমরার বাসা থেকে বেরিয়ে যান মিরাজ হোসেন পাপ্পু। যোগ দেন যাত্রাবাড়ীতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে। দুপুর ২টার পরপর যাত্রাবাড়ী থানার সামনে হানিফ ফ্লাইওভারের নিচে পুলিশের ছোড়া গুলি লাগে তার বুকের বাঁ পাশে। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। কয়েকজন পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালে নিলে তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।
বাসা থেকে বের হওয়ার মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে তপ্ত সিসার ছোট্ট একটি বুলেটে মুহূর্তেই নিভে যায় মিরাজ এবং তার পরিবারের সব স্বপ্ন। মিরাজদের বাসা ডেমরার পারডগাইরের মধুবাগে। গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার তিতাস থানার সরস্বতীচরে। বিবিএ ডিগ্রিধারী মিরাজ ছিলেন দুই ভাই, এক বোনের মধ্যে মেজো। বোন বড়। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছিলেন মিরাজ। তাকে হারিয়ে শোকাচ্ছন্ন পরিবার এখন দিশেহারা। যে ল্যাপটপ দিয়ে তিনি ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ করে সংসার চালাতেন, সেটি আজও রয়ে গেছে টেবিলের ওপর। তার রক্তমাখা শার্ট দুহাতে বুকে জড়িয়ে এখনো ছেলেকে খোঁজে ফেরেন মা ও বাবা।
মিরাজ কোটা সংস্কার আন্দোলনে আগে থেকেই অংশ নিয়েছিলেন জানিয়ে তার ছোট ভাই পাভেল হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘আমার ভাই আন্দোলনের শুরু থেকে ছিল এবং তিনি যখন আন্দোলনে যেতেন তার বন্ধুদেরও সঙ্গে নিয়ে যেতেন। তাদেরও আন্দোলনে যাওয়ার জন্য বলতেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় খুব সোচ্চার ছিলেন। ৫ আগস্ট সকালে তিনি আমার পাশ থেকে ঘুম থেকে উঠে আন্দোলনে গিয়েছিলেন এবং গণভবনের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন। ধীরে ধীরে বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান করে যাত্রাবাড়ী অতিক্রম করার সময় দুপুর পৌনে ৩টার দিকে পুলিশের গুলিতে নিহত হন।’
ক্যারিয়ার নিয়ে বড় ভাই মিরাজের স্বপ্নের কথা জানিয়ে পাভেল বলেন, ‘মিরাজ ভাইয়ার স্বপ্ন ছিল কানাডার একটি ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স কমপ্লিট করার, আবেদনও করেছিলেন। পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করতেন। আমার বাবা-মাও মিরাজ ভাইয়াকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতেন।’
কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি আরও বলেন, ‘আমার ভাইয়ের প্রতিটি স্মৃতি দেখে আমার মা, আমার বাবা, বোন প্রতি মুহূর্তে কান্নাকাটি করে। ভাইয়া যে শার্ট পরিহিত অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হন, সেই শার্টটা রক্তমাখা অবস্থায় এখনো আমাদের বাসায় আছে। সেই শার্ট থেকে আমার মা তার ছেলের রক্তের সুগন্ধ নিয়ে কান্না করেন। আমাদের পুরো পরিবার ভেঙে পড়েছে। মা ভাইয়ের মৃত্যুর কারণে অসুস্থ, আমাদের পরিবার আর কোনোদিনই আগের মতো স্বাভাবিক হবে না।’
বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পর কোনো সহযোগিতা পেয়েছেন কি না, জানতে চাইলে পাভেল বলেন, ‘কিছু অনুদানের টাকায় এবং আত্মীয়স্বজনের সহযোগিতায় আমাদের সংসারটা চলছে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায় থেকে কিছু অনুদান আমরা পেয়েছি, তবে যে রকম আশা করেছিলাম সেই ধরনের কোনো অনুদান আমরা পাইনি এখন পর্যন্ত।’
হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আমার ভাইয়েরা নতুন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তাদের জীবন দিয়েছে; কিন্তু আজ আমার ভাইদের রক্তের বিনিময়ে যারা মুক্ত হয়েছে, তারাই আমাদের খোঁজ নিচ্ছে না। প্রায় এক বছর হয়ে গেছে; কিন্তু এখন পর্যন্ত আমার ভাইয়ের হত্যায় জড়িতদের বিচারের অগ্রগতি বিন্দু পরিমাণও হয়নি। আমরা পুরোপুরি হতাশ, আমরা কি আদৌ বিচার পাব?’
সরকারের কাছে প্রত্যাশার কথা জানিয়ে পাভেল বলেন, ‘সরকারের কাছে আমাদের প্রধান চাওয়া হলো আমার ভাইদের যারা হত্যা করছে, তাদের বিচার চাই। যারা হত্যার নির্দেশ দিয়েছে, তাদের বিচারও আমরা চাই। এ ছাড়া নতুন এক দেশ চাই, যেখানে কোনো দুর্নীতি, কোনো চাঁদাবাজি থাকবে না।’
মন্তব্য করুন