সুশোভন অর্ক
প্রকাশ : ২৩ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২৩ জুলাই ২০২৫, ০৮:৩০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বার্ন ইনস্টিটিউটের বারান্দায় উদ্বিগ্ন স্বজনেরা

২১ জনের মরদেহ হস্তান্তর
বার্ন ইনস্টিটিউটের বারান্দায় উদ্বিগ্ন স্বজনেরা

প্রতিদিন সকালে ছেলেকে আদর করে সাজিয়ে স্কুলে নিয়ে যেতেন মা, রিকশায় পাশে বসিয়ে, হাত ধরে। কোনোদিনই এ রুটিনে ছেদ পড়েনি। মঙ্গলবার সকালেও ছেলেকে সুন্দর করে সাজিয়ে বেরিয়েছিলেন তিনি, তবে এবার গন্তব্য ছিল না স্কুল, ছিল কবরস্থান। শিশুপুত্র শায়ানকে চিরবিদায় জানাতে কাফনের কাপড়ে মোড়া ছেলেকে নিয়ে গিয়েছিলেন কবরে।

মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের রসায়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এফএম ইউসুফ এবং তার স্ত্রী শাম্মী আক্তার একই প্রতিষ্ঠানের স্কুল শাখার রসায়ন বিভাগের শিক্ষিকা। দুজনই শিক্ষানুরাগী। সাজানো-গোছানো পরিবারে ছিল ফুটফুটে এক ছেলে ও এক মেয়ে। সেই সংসারে হঠাৎ নেমে এলো অন্ধকার। রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনায় দগ্ধ হয়ে প্রাণ হারায় তাদের প্রিয় সন্তান, ছোট্ট শায়ান।

বাবা-মা যে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, সেই প্রতিষ্ঠানেরই সপ্তম শ্রেণির ছাত্র, ১৪ বছর বয়সী শায়ান ইউসুফ। প্রতিদিন মা আর ছেলে এক রিকশায় আর বাবা আরেক রিকশায় করে স্কুলের যেতেন। প্রতিদিনের মতো সোমবার সকালে মায়ের সঙ্গে স্কুলে গিয়েছিল শায়ান ভবিষ্যতের হাজারো স্বপ্ন নিয়ে। সহপাঠীদের সঙ্গে শিক্ষা প্রাঙ্গণে হাসিমুখে কাটিয়েছিল শেষ সময়টুকু। কিন্তু সেই হাসিমুখ আর কখনো দেখা যাবে না। ক্যাম্পাসে ক্লাসে থাকা অবস্থায় বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে অন্য অনেকের মতো দগ্ধ হয় শায়ান। শরীরের প্রায় ৯৫ শতাংশ দগ্ধ হয়েছিল তার। সোমবার রাত ৩টা ৫০ মিনিটে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে সে। এরপর মঙ্গলবার দুপুর পৌনে ১টার দিকে শায়ানের মরদেহ লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার বশিকপুরের গ্রামের বাড়িতে নেওয়া হয়। বিকেল ৩টায় বশিকপুরের গ্রামের বাড়িতে জানাজা শেষে দাফন করা হয়।

মঙ্গলবার ভোরে বার্ন ইনস্টিটিউটজুড়ে ছিল শায়ানের স্বজনদের আহাজারি। কেউ চোখ মুছছেন, কেউ বুক চাপড়াচ্ছেন, কেউ বা নির্বাক তাকিয়ে আছেন। শায়ানের দাদি কামরুন নাহার বার্ন ইউনিটের সামনে আকুতি করে কাঁদছিলেন, ‘আল্লাহ তোমার কাছে এটা আশা করি নাই, আল্লাহ তোমার কাছে এটা আশা করি নাই। আল্লাহ তুমি ওইদিন বৃষ্টি দিলা না কেন, তুমি এইটা কেন করলা? তোমার লীলাখেলা কেউ বোঝে না।’

হাসপাতালে শায়ানের নিথর দেহের পাশে দাঁড়িয়ে বাবার কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল ভগ্ন হৃদয়ের ধ্বনি, ‘আমি আর এ দেশে থাকব না। এ দেশের পলিটিশিয়ানরা দেশটাকে পলিউট করে ফেলছেন। আমরা থাকব না এই দেশে। জনবহুল এমন এক জায়গায় কীভাবে বিমান প্রশিক্ষণ করা হয়, আমি বুঝি না। আমার ছেলেটা কী স্মার্ট ছিল, সুন্দর ছিল। ক্লাসে ফার্স্ট হতো আমার ছেলে। সব শেষ হয়ে গেল।’

শুধু শায়ানের বাবা-মা নন, আজ অসংখ্য বাবা-মা কাঁদছেন, কেউ সন্তান হারিয়ে, কেউ বা স্বজন হারানোর ভয়ে। ঘটনার পর থেকেই বার্ন ইনস্টিটিউট এলাকা ভারি হয়ে উঠেছে দগ্ধদের স্বজনদের কান্না আর হাহাকারে। এই হাহাকারের বেদনা যেন ছড়িয়ে পড়েছে দেশের প্রত্যেক মানুষের হৃদয়ে। সোমবারের ঘটনার পর মঙ্গলবার সারা দিন বার্ন ইনস্টিটিউটে ছিল আহত এবং নিহতদের স্বজনদের আনাগোনা। কেউ বা এসেছিলেন খোঁজ না পাওয়া স্বজনকে খুঁজতে। সবার মুখেই ছিল কষ্ট আর আতঙ্কের ছাপ। সবার মুখেই ছিল একটি কথা, এমন জনবহুল এলাকায় কেন বিমান প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচন করতে হবে। কেন শত শত পরিবারের জীবন এবং স্বপ্ন এভাবে নষ্ট করে দেওয়া হলো। কিন্তু উত্তর মিলছিল না কোথাও থেকে।

বগুড়া থেকে আসা এক ব্যক্তি জানান, তার ভাতিজা দগ্ধ হয়ে ভর্তি। সোমবার আসতে চাইলেও পারেননি, তাই মঙ্গলবার এসেছেন। তার চোখে ছিল কান্না আর মুখজুড়ে আতঙ্ক। তিনি বলছিলেন, এমন একটি ঘটনা ঘটবে—এটা এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। তার সঙ্গে থাকা অন্য রোগীদের স্বজনেরও ছিল একই কথা। তারা একটাই দাবি জানিয়েছেন, ভবিষ্যতে যেন এমন কোনো ঘটনা না ঘটে; যার কারণে নিমেষেই ফুলের মতো কোনো প্রাণ ঝরে না যায়।

মঙ্গলবার হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রবেশপথে ছিল চোখে পড়ার মতো নিরাপত্তা ব্যবস্থা। প্রধান ফটকে আনসার সদস্যরা এবং অভ্যন্তরে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে সেনাসদস্যরা দায়িত্ব পালন করছিলেন। আগত স্বজন ও উৎসুক মানুষের ভিড় সামাল দিতে কঠোর হয়েছে কর্তৃপক্ষ।

ভেতরে প্রবেশে ছিল কঠিন শর্ত। কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দেখাতে হয়েছে অফিসিয়াল আইডি। রোগীর স্বজনদের দিতে হয়েছে বিস্তারিত তথ্য—রোগীর নাম, সম্পর্কের ধরন ও অবস্থান করা ওয়ার্ড। যাচাই-বাছাইয়ের পরই দেওয়া হয়েছে প্রবেশের অনুমতি। এর বাইরে কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।

বার্ন ইউনিটের প্রতিটি করিডর, ওয়ার্ড ও আইসিইউর সামনে উদ্বিগ্ন স্বজনের ভিড়। কেউ বারান্দায় বসে প্রিয়জনের খোঁজে অস্থির, কেউ কাচের দরজার ফাঁক দিয়ে একঝলক দেখার চেষ্টা করছেন। চারপাশে ছড়িয়ে আছে কান্নার শব্দ, আতঙ্কিত মুখ, আর্তচিৎকার।

হাসপাতালের বাইরেও একইরকম চিত্র—শত শত মানুষ অপেক্ষা করছেন কোনো খবরের আশায়। কেউ কাঁদছেন নিঃশব্দে, কেউ চোখের পানি মুছেই আবার ছুটছেন রক্তদানের বুথে। অনেকেই আবার বাধা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতে চাইছেন, কেউ আপনজনের হাতে হাত রাখার তাড়নায়, কেউ শেষবারের মতো দেখার ব্যাকুলতায়।

তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, দগ্ধ শিশুদের সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে স্বজনদের প্রবেশ সীমিত রাখা হয়েছে। কারণ, সামান্য একটি জীবাণুও মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে কোমল শরীরে। তাই নিরাপত্তা ও সুরক্ষার দিক বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে এ সিদ্ধান্ত।

বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের পরিচালক প্রফেসর ডা. নাসির উদ্দিন বলেন, চিকিৎসক থেকে নার্স, হাসপাতালের কর্মী—সবাই সর্বোচ্চ চেষ্টায় সেবা দিচ্ছেন। মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। বিশ্বমানের সাপোর্টও দেওয়া হচ্ছে। দগ্ধদের অনেকের অবস্থা ভয়াবহ। তাদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা বেশি। আমাদের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে।

২১ জনের মরদেহ হস্তান্তর: এ ভয়াবহ দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন ৩১ জন। মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ২১ জনের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তারা হলো তানভীর (১৪), আফনান ফাইয়াজ (১৪), মাহরিন (৪৬), বাপ্পী (৯), মাশুকা (৩৭), এবি শামীম (১৪), শায়ান ইউসুফ (১৪), এরিকসন (১৩), আরিয়ান (১৩), নাজিয়া (১৩), রজনী ইসলাম (৩৭), মো. সামিউল করিম (৯), ফাতেমা আক্তার (৯), মেহনাজ আফরিন হুমায়রা (৯), সারিয়া আক্তার (১৩), নুসরাত জাহান আনিকা (১০), সাদ সালাউদ্দিন (৯), সায়মা আক্তার (৯), ফ্লাইট লেফট্যানেন্ট মো. তৌকির ইসলাম (২৭), জুনায়েত (৯) ও ওমর নূর আশফিক (১১)।

দগ্ধদের কে কোথায় ভর্তি: দগ্ধদের মধ্যে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি হাসপাতালে ৪২ জন ভর্তি রয়েছে। এর মধ্যে শিক্ষার্থী ৩৬ জন, শিক্ষক চারজন, একজন অফিস সহায়ক এবং একজন ইলেকট্রিশিয়ান। তাদের মধ্যে মাহতাব (১৪), নাফিস (৯), জারিফ (১২), মাসুমা (৩২), মাহিয়া (১৫) ও আয়ান (১৪) আইসিইউতে ভর্তি। পোস্ট অপারেটিভ ইউনিটে ভর্তি রয়েছে তাসনুবা মাহবিন (১১), ফারজানা ইয়াসমিন (৪৫), তাসনিয়া (১০), শ্রেয়া (৯), রাইসা (১১), পায়েল (১২), নিশি (২৮), নুসরাত (১২), তৌফিক (১৩), ইয়ুশা (১১), জাকির (৫৫), সায়েবা (৯), আলভিনা (১০), মুনতাহা (১০), রুপি বড়ুয়া (১০), জায়ানা (১৩), নিলয় (১৩), আশরাফুল আলম (৩৭), সুমাইয়া লরিন (৩০), কাব্য (১৩) ও কাফি আহমেদ (১০)। এমএইচডি ইউনিটে ভর্তি রয়েছে মাকিন (১৫), আরিয়ান আফিফ (১২), রোহান (১৪), রাইয়ান (১৪) ও আবিদুর রহমান (১০)। এফএইচডি ইউনিটে ভর্তি রয়েছে সবুজা বেগম (৪০) সামিয়া (৯), সাইবা জাহান (১০), তাসনিয়া (১৫), মেহরিন (১১), আইমান (১০), সায়রা (১০) ও হাফসা খান (১১)। জরুরি বিভাগে ভর্তি আছে আয়ান খান (১২) ও কাজী আমজাদ সায়েদ (২০)।

সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি আছেন ২৩ জন। এর মধ্যে শিক্ষার্থী তিনজন, শিক্ষক দুজন, স্কুল স্টাফ একজন, ফায়ার ফাইটার একজন, পুলিশ সদস্য একজন এবং ১৫ জন সেনাসদস্য।

ভর্তিদের মধ্যে বার্ন আইসিইউ বিভাগে রয়েছে শিক্ষার্থী নাফিস (১৪), আকিব (১২), শিক্ষিকা মাহফুজা (৪৫), শিক্ষক আনোয়ার (৩৪), অধ্যক্ষের পিএস আতিক (২১) ও শিক্ষার্থী বিল্লাল হোসেন (১২)। পিএসি বিভাগে ভর্তি আছেন সেনাসদস্য আহসান (৪৫), হাবিবুল্লাহ (২৪), মো. আবদুল্লাহ (২৪), মোত্তাকিন (২৪), মো. শাকিল (২৬), নাফিস (২২), হযরত (২২), পুলিশ সদস্য মো. মানিক (৪৬), ফায়ার ফাইটার মো. সোহাগ (২৭) ও শিক্ষার্থী ফারহান শফি (১৭)। হাসপাতালের ট্রমা সেন্টারে ভর্তি আছেন সেনাসদস্য মো. কামরুজ্জামান (২৫), শাহরিয়ার (২৪), রাকিবুল (২৪), বাবুল (২২), রাবিউল (২২), কামাল (২১) ও তাহসান (২৪)।

এ ছাড়া কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালে ভর্তি আছে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী জান্নাতুল মাওয়া (১১)। শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিক্ষার্থী মেহেরুন নেসা, মো. ইয়াসিন এবং উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজন ভর্তি থাকলেও তার পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়া যায়নি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

গ্যাসের ট্যাবলেট খেয়ে নিঃসন্তান দম্পতির আত্মহত্যা

‘যারা গণতন্ত্র চায় না তারা নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে’

সারা দেশে টিসিবির পণ্য বিক্রি শুরু কাল, কিনতে পারবেন সবাই

ইউপি সদস্যকে হত্যার ঘটনায় প্রধান আসামি গ্রেপ্তার

মসজিদ কমিটি ব্যবস্থাপনা নীতিমালার গেজেট শিগগিরই : ধর্ম উপদেষ্টা

নামাজে রাকাত সংখ্যা ভুলে গেলে কী করবেন?

সাংবাদিক তুহিন হত্যা মামলার আরেক আসামি গ্রেপ্তার

সাবেক ছাত্রদল নেতার গলাকাটা লাশ উদ্ধার

পাবিপ্রবিতে ৫ ছাত্রের আমরণ অনশন

আবারও চোটে পড়েছেন রদ্রি

১০

চট্টগ্রামে এনসিপি নেতার পদত্যাগ

১১

শেখ হাসিনা যুব সমাজকে ধ্বংস করে দিয়েছে : এ্যানি

১২

পালিয়ে যাওয়া স্বৈরাচারের দিবাস্বপ্ন কখনোই বাস্তবে পরিণত হবে না : মঈন খান

১৩

জাপার চেয়ারম্যান আনিসুল, মহাসচিব রুহুল আমীন নির্বাচিত

১৪

পরিবহন ধর্মঘটের আহ্বানে লিফলেট বিতরণ

১৫

কারো মৃত্যুর পর ‘চল্লিশা’ খাওয়ানো কি জায়েজ?

১৬

আগামী নির্বাচনে জনগণ বিএনপিকেই নির্বাচিত করবে : রহমাতুল্লাহ

১৭

রেলিং ভেঙে নিচে পড়লেন প্রেমিক-প্রেমিকা, মর্মান্তিক ঘটনা ভাইরাল

১৮

মাগুরায় জিয়া স্মৃতি সংসদের নতুন কমিটি গঠন

১৯

এমন কিছু কথা যা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে না বলাই ভালো

২০
X