দূরপাল্লার বাস ভ্রমণ শেষে নির্ধারিত স্টপেজে গভীর রাত কিংবা ভোরে নামার পর গন্তব্যে পৌঁছাতে তুলনামূলক নিরাপদ বাহন মনে করা হয় সিএনজিচালিত অটোরিকশাকে। সেই অটোরিকশার চালকই যখন ছিনতাইকারী বা ছিনতাই চক্রের সদস্য, তখন নগরবাসীর জন্য নিরাপদ ভ্রমণ যেন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। গত এক সপ্তাহে নগরে এ ধরনের ছিনতাইকারী চক্রের উৎপাত বেড়েছে। এমন ছিনতাইয়ের ঘটনায় এ সময়ে শুধু রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানাতেই মামলা হয়েছে তিনটি। গতকাল বৃহস্পতিবার এ ধরনের একটি চক্রের চার সদস্য গ্রেপ্তার হয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সদস্য ও শেরেবাংলা নগর থানাপুলিশের হাতে।
গ্রেপ্তারের বিষয়টি গতকাল কালবেলাকে নিশ্চিত করেন ডিএমপির ডিবি তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ রাকিব খান। গত ১৬ আগস্ট ভোরে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে রাজস্ব ভবনের সামনে এই চক্রের কবলে পড়ে সঙ্গে থাকা সব কিছু খোয়ান একজন। ভুক্তভোগী রাতের বাসে রাজশাহী থেকে গাবতলীতে এসে বাসায় পৌঁছার জন্য সিএনজিচালিত অটোরিকশায় ওঠেন। এ ঘটনায় শেরেবাংলা নগর থানায় তার অভিযোগের সূত্র ধরে অপরাধীদের ধরতে ছায়াতদন্তে নামে তেজগাঁও বিভাগের গোয়েন্দা দল। এক পর্যায়ে ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ থেকে শনাক্ত হয় অটোরিকশাটির চালক। এরপর গতকাল ভোরে টেকনিক্যাল বাসস্ট্যান্ডে অভিযান চালিয়ে জাকির হোসেন নামে সেই চালককে গ্রেপ্তার করা হয়। জাকিরের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে চক্রের বাকি তিন সদস্য মো. নজরুল ইসলাম (৪৭), মো. মিজানুর রহমান (৪৫) ও মো. হাফিজুল ইসলাম হাবুও (৪৫) গ্রেপ্তার হয়।
টার্গেট উত্তরবঙ্গের, ছিনতাই পুরোনো বাণিজ্য মাঠ এলাকায়: অভিযানে অংশ নেওয়া ডিবির একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চক্রের একজন সদস্য অটোরিকশা নিয়ে উত্তরবঙ্গ থেকে ছেড়ে আসা দূরপাল্লার বাসস্ট্যান্ডগুলোতে যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। বিশেষ করে ভোরের আলো ফোটার আগে-পরের নির্জন সময়টা কাজে লাগায় তারা। সাধারণভাবেই যাত্রী নিয়ে চালকের বেশে থাকা চক্রের সদস্য আগারগাঁও এলাকার পুরোনো বাণিজ্য মেলার মাঠের কাছাকাছি অথবা শ্যামলী-আগারগাঁও মূল সড়কের কোনো ফাঁকা জায়গায় পৌঁছে অটোরিকশার স্টার্ট বন্ধ করে দেয়। তখন পরিকল্পনা অনুযায়ী আগেই সেখানে থাকা চক্রের বাকি সদস্যরা যাত্রীকে জিম্মি করে তার সঙ্গে থাকা সবকিছু ছিনিয়ে নেয়।
এই চক্রের সদস্যদের ধরার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে ডিবি তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ রাকিব খান বলেন, ‘ভোর ৪টায় টেকনিক্যাল বাসস্ট্যান্ড থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক জাকির হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়। সেখানেই প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জাকির জানান যে, তার অন্য সহযোগীরা ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে আগারগাঁও পুরোনো বাণিজ্য মেলা এলাকায় উতপেতে বসে আছে। তখন অভিযানে থাকা ডিবির সদস্যরা যাত্রীবেশে সেই অটোরিকশা নিয়েই রওনা হয়। এক পর্যায়ে পুরোনো বাণিজ্য মেলা মাঠ এলাকায় পৌঁছানোর পর চালক অটোরিকশার স্টার্ট বন্ধ করে দেয়। তখন ছিনতাই চক্রের বাকি তিন সদস্য দেশীয় অস্ত্র হাতে অটোরিকশার কাছে এলে ডিবি সদস্যরা ধাওয়া দিয়ে তাদের মধ্যে দুজনকে ধরে ফেলে। একজন পালিয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে বাকি তিনজনের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আশুলিয়া এলাকা থেকে তাকেও গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারদের কাছ থেকে তিনটি ছুরি, দুটি ছিনতাই করে নেওয়া মোবাইল ফোন এবং একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা উদ্ধার করে আমাদের সদস্যরা।’
সিএনজিতেই জিম্মি করে বিকাশে আনায় টাকা: গত ১৬ আগস্ট ছিনতাইয়ের শিকার এক ভুক্তভোগীর অভিজ্ঞতা ও গ্রেপ্তারদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে ডিবি বলছে, প্রথমে চালক স্টার্ট বন্ধ করে দিয়ে ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে গেছে—এমন টালবাহানা করতে থাকে। এরই মধ্যে চলে আসে চক্রের অন্য সদস্যরা। এসেই ভেতরে জোর করে ঢোকে। এরপর যাত্রীর গলায় ছুরি ধরে টাকা, দুটি মোবাইল ফোন ও বিকাশ অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়। আরও টাকা দেওয়ার জন্য ছিনতাইকারীরা ভুক্তভোগীকে মারধর ও চাপ দেয়। এতে তিনি পরিবার থেকে বিকাশের মাধ্যমে টাকা এনে দিতে বাধ্য হন।
অল্প ভাড়ার লোভে পরে সর্বস্ব হারায় যাত্রী: ভোরের দিকে উত্তরবঙ্গ থেকে আসা বাসগুলো থেকে যাত্রী নামে টেকনিক্যাল মোড়ে। তখন সিএনজিচালিত অটোরিকশার সাধারণ চালকরা গন্তব্যে যেতে বেশি টাকা দাবি করে থাকেন। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ছিনতাই চক্রের চালক অল্প টাকা ভাড়া চায়। টাকা কম চাওয়ায় যাত্রীরা সহজেই সেই অটোরিকশায় উঠে গন্তব্যে পৌঁছাতে চায়। এটাই কাল হয় যাত্রীদের। এমনটা উল্লেখ করে শেরেবাংলা নগর থানার ওসি ইমাউল হক কালবেলাকে বলেন, ‘অল্প ভাড়ার ফাঁদে ফেলে ভোরবেলায় তারা যাত্রী তোলে টেকনিক্যাল মোড় থেকে। এরপর যাত্রীদের শিশু হাসপাতাল, পুরোনো বাণিজ্য মেলার মাঠ এলাকার মতো নির্জন জায়গায় পৌঁছলে সবকিছু ছিনিয়ে নেয় ভয়ভীতি দেখিয়ে। গত ১১, ১৪ ও ১৬ আগস্ট একই এলাকায় এমন তিনটি ঘটনার লিখিত অভিযোগ পেয়েছি আমরা। সে অভিযোগগুলো আমলে নিয়ে ডিবির সঙ্গে যৌথ অভিযানে চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।’
এমন ছিনতাই রুখতে জনসচেতনতাসহ টহল জোরদার করা হয়েছে উল্লেখ করে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘ভোরে চলাচল করা সিএনজিগুলো চিহ্নিত করতে আমরা শ্যামলী এলাকায় চেকপোস্টে টহল জোরদার করেছি। সেখানে ভোরে চলাচল করা অটোরিকশাচালকদের হাতে একটি ফর্ম দেওয়া হয়। সেই ফর্মে তাদের নাম-ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর টুকে নেওয়া হয়। এরা আবার পরে দুই দফায় চেকপোস্টের মুখে পড়ে গণভবন ও ধানমন্ডি বয়েজ স্কুলের চেকপোস্টে। এতে যারা প্রকৃত অটোরিকশাচালক তাদের সহজেই চিহ্নিত করা যায়। আর যারা অপরাধ করে, তাদেরও চিহ্নিত করা যায়। যাত্রীদের প্রতি আহ্বান, টেকনিক্যাল এলাকা থেকে যারা কম ভাড়ায় অটোরিকশা নেবেন, তারা চালকের ছবি, অটোরিকশার নম্বর ও চালকের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে কাউকে দিয়ে রাখবেন বা থানার নম্বরে দেবেন।’
মন্তব্য করুন