কেউ বদলেছে দল, কেউবা পাল্টেছে আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা, আবার কেউ কেউ আবির্ভূত হয়েছে নতুন রূপে। সব মিলিয়ে দেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ‘কিশোর গ্যাং’ নামে পরিচিত অপরাধী চক্রগুলোর তাণ্ডব আরও বেড়েছে, সদস্য সংখ্যার সূচকও ঊর্ধ্বমুখী। একজন গ্রেপ্তার হলে নেতৃত্বে আসে আরেকজন। আর পুরোনো ‘লিডারের’ চেয়ে নতুন ‘লিডারের’ নেতৃত্বে আরও ভয়ংকর রূপ নেয় কিশোর গ্যাংগুলো। চাঁদাবাজি, খুন, ছিনতাই, মাদক কারবার ও কুপিয়ে জখমসহ জিম্মি করে টাকা আদায়ের মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জানান দিতে চায় নতুন ‘নেতার’ আধিপত্য ও অবস্থান সম্পর্কে। আর এভাবেই যেন অপরাধ ও সন্ত্রাসের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও এর আশপাশের এলাকাগুলো। এতে ঘরেবাইরে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন এসব এলাকার সাধারণ বাসিন্দারা। অন্তত আটটি কিশোর গ্যাংয়ের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জিম্মি সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও। এমনই একটি অপরাধ চক্রের নাম ‘কবজি কাটা গ্রুপ’।
গত সোমবার রাতে এই গ্রুপের হামলার শিকার হয় আদাবর থানা পুলিশের একটি টহল দল। এ সময় কুপিয়ে জখম করা হয় আল-আমিন নামে এক কনস্টেবলকে। আহত ওই পুলিশ সদস্য রাজধানীর জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। কবজি কাটা গ্রুপের সদস্যরা আদাবর থানা পুলিশের একটি গাড়িও ভাঙচুর করে। এই গ্রুপ ও সোমবার রাতের হামলার হোতা আপন দুই ভাই রনি ও জনি। আদাবরের ১০ নম্বর বালুর মাঠ এলাকায় বসেই পুরো মোহাম্মদপুর ও আদাবর এলাকায় বিস্তার করেছে আধিপত্য। এই অপরাধ চক্রটির পুরোনো ‘লিডার’ আনোয়ার ওরফে কবজি কাটা আনোয়ার ওরফে শুটার আনোয়ার। গত ফেব্রুয়ারিতে র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হলে তার অবর্তমানে গ্যাংয়ের নেতৃত্ব দিচ্ছে তুষার, রনি ও জনি। তাদের বিষয়ে আদাবর ও মোহাম্মদপুরের কয়েকজন বাসিন্দা বলেছেন, সোমবার রাত ১১টার দিকে আদাবরের সুনিবিড় হাউজিং এলাকার একটি গ্যারেজে পুলিশ সদস্যরা অভিযান চালান। এর আগে পুলিশের কাছে খবর যায়, ওই গ্যারেজে এক ছেলে ও মেয়েকে (প্রেমিক যুগল) জিম্মি করে রেখেছে কবজি কাটা গ্রুপের সদস্যরা। পুলিশের গাড়ি যখন ওই গ্যারেজের কাছে পৌঁছায়, তখন কবজি কাটা গ্রুপের অন্যতম সদস্য রনি ও জনি পুলিশের ওপর ধারালো অস্ত্র দিয়ে হামলা চালায়। হামলায় আরও অংশ নেয় গ্যাং সদস্য নাজির, ওসমান, দাঁতভাঙা সুজন, কবজি কাটা হৃদয় ও গাঁজা ব্যবসায়ী রাজু। যদিও এ ঘটনার পর বিশেষ অভিযান চালিয়ে ১০২ জনকে আটক এবং দেশীয় অস্ত্র ও মোটরসাইকেল উদ্ধার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগ। গতকাল সন্ধ্যায় এ বিষয়ে ডিএমপি মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, ‘আদাবরের সুনিবিড় হাউজিং এলাকায় একটি পুলিশ টহল দল দুজন ভুক্তভোগীকে উদ্ধারে অভিযানে গেলে স্থানীয় কিছু দুর্বৃত্ত তাদের ওপর হামলা চালায়।’
একই সময়ে মোহাম্মদপুর থানার নবীনগর হাউজিং এলাকায় দুটি রিকশার গ্যারেজে হামলা চালায় ওই গ্রুপের সদস্যরা। দুটি গ্যারেজ থেকে পাঁচটি রিকশা ছিনিয়ে নেয় তারা। এ সময় ধারালো অস্ত্র দিয়ে রাশেদ নামে এক গ্যারেজ মালিককে কুপিয়ে জখম করে। আহত রাশেদ কালবেলাকে বলেন, ‘আমার কাছে চাঁদা চেয়েছিল। গরিব মানুষ। অল্প আয় হয়। তাই চাঁদা দিতে পারি নাই। গতকাল (সোমবার) রাতে ৫০ থেকে ৬০ জন এসে গ্যারেজে হামলা চালায়। আমাকে পেয়ে কুপিয়ে গাড়ি (রিকশা) নিয়ে যায়। আমার পাশের গ্যারেজ থেকেও গাড়ি নিয়েছে।’
কিশোর গ্যাংগুলোর তৎপরতার চিত্র তুলে ধরে নবীনগর হাউজিংয়ের এক গ্যারেজ মালিক বলেন, ‘একজন গ্রেপ্তার হলে আরেকজন দায়িত্ব নেয়। নতুন নেতা আগের নেতার চেয়েও ভয়ংকর তাণ্ডব চালায়। নিজের আধিপত্য ও ক্ষমতা দেখাতে গিয়ে তারা এসব করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সবথেকে বিপদের কথা হলো, গ্রেপ্তার হওয়ার অল্প কয়েকদিন পরই তারা আবার জামিনে বেরিয়ে আসে। জামিনে বেরিয়ে তারা আরও ভয়ংকর রূপ ধারণ করে।’
এই গ্যারেজ মালিকের অভিযোগের সত্যতা মেলে র্যাব-২ এর গত ১১ মাসের অভিযান ও গ্রেপ্তারের পরিসংখ্যানে। গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত মোহাম্মদপুর ও আদাবর এলাকায় ছয়টি চিহ্নিত কিশোর গ্যাং এবং জেনেভা ক্যাম্পের বড় দুই সন্ত্রাসী গ্রুপের বিরুদ্ধে ৪৮৬টি অভিযান পরিচালিত হয়েছে। এসব অভিযানে গ্রেপ্তার হয় ৬৮০ জন। সে সময় আনোয়ারের সঙ্গে গ্রেপ্তার হয়েছিল রনি ও জনিও। আনোয়ার এর পর জামিনে এসে আবার গ্রেপ্তার হয়েছে। এ সময়ে নেতৃত্বে আসে রনি-জনি।
মোহাম্মদপুর ও আদাবর এলাকায় সক্রিয় আট গ্যাং: মোহাম্মদপুর ও আদাবর এলাকায় মোট আটটি কিশোর গ্যাং সক্রিয় আছে বর্তমানে। র্যাব-২ এর করা তালিকা অনুযায়ী গ্যাংগুলো হলো—কবজি কাটা গ্রুপ, কিলার আরমান গ্রুপ, টুন্ডা বাবু গ্রুপ, বোমা গ্রুপ, গিটঠা গ্রুপ, কসাই গ্রুপ, পাটালি গ্রুপ ও এলেক্স। টুন্ডা বাবু গ্রুপ বেশি সক্রিয় শ্যামলী ও আগারগাঁও এলাকায়। এ ছাড়া বাকি গ্রুপগুলো মোহাম্মদপুর ও আদাবরকেন্দ্রিক। স্থানীয়রা জানান, গত বছরের ৫ আগস্টের আগে পাটালি গ্রুপের নেতৃত্বে ছিল ফর্মা সজীব। তার অবর্তমানে ফর্মা আলমগীর ও ফালান এই গ্রুপটির নেতৃত্ব দিচ্ছে। এ ছাড়া এলেক্স গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করছে এলেক্স ইমন ও সোহাগ। কবজি কাটা গ্রুপসহ এই দুটি গ্রুপ সবথেকে বেশি সক্রিয়। বাকিগুলো এলাকায় এই তিন গ্রুপের চেয়ে তুলনামূলক কম সক্রিয় ও লোকবলসম্পন্ন।
কিশোর গ্যাংগুলোর নতুন নেতৃত্বের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার ইবনে মিজান বলেন, ‘আমাদের অভিযানে গ্যাং নেতারা গ্রেপ্তার হয়। তারপর নতুন নেতারা গ্যাংয়ের দায়িত্ব নেয়। নতুন নেতাদের বিষয়ে তো ধরে ধরে খোঁজ নেওয়া সম্ভব হয় না। তারা যখন কোনো অকারেন্স (অপরাধ) ঘটায়, তখন নতুন করে দেখা যায় নেতা বদলেছে। যেমন আদাবরের ঘটনায় দেখলাম, আনোয়ারের জায়গায় নেতৃত্বে এসেছে রনি-জনি। তবে আমরা সবাইকেই আইনের আওতায় আনব।’
মন্তব্য করুন