কালবেলা ডেস্ক
প্রকাশ : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৮:০৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সামরিক শক্তি দেখিয়ে কী বার্তা দিল চীন

বিশাল কুচকাওয়াজ ও সমরাস্ত্রের প্রদর্শনী
সামরিক শক্তি দেখিয়ে কী বার্তা দিল চীন

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের উপস্থিতিতে গতকাল বুধবার অনুষ্ঠিত চীনের সামরিক বাহিনীর কুচকাওয়াজ বিশ্বজুড়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের বিরুদ্ধে বিজয়ের ৮০তম বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে চীন তার সামরিক শক্তি এবং অত্যাধুনিক অস্ত্রের বিশাল সম্ভার প্রদর্শন করেছে। সামরিক বিশ্লেষক ও কূটনীতিকদের মতে, এই কুচকাওয়াজ শুধু একটি বিজয় উদযাপনের অনুষ্ঠান ছিল না; বরং এর মাধ্যমে চীন বিভিন্ন পক্ষকে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়েছে।

গতকালের সামরিক কুচকাওয়াজে সমরাস্ত্রের প্রদর্শনীতে এমন কিছু অত্যাধুনিক সামরিক সরঞ্জাম দেখানো হয়েছে, যা আগে কখনো জনসমক্ষে আনা হয়নি। এর মধ্যে ছিল পারমাণবিক অস্ত্রের সম্পূর্ণ ‘ট্রায়াড’ (স্থল, সমুদ্র এবং আকাশ থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য পারমাণবিক অস্ত্র) ব্যবস্থা। এর পাশাপাশি হাইপারসনিক অস্ত্র, ড্রোন এবং আকাশ প্রতিরক্ষা লেজারও প্রদর্শন করা হয়েছে।

সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশাল আয়োজনে চীনের এই সমরাস্ত্র প্রদর্শনীর মূল উদ্দেশ্য হলো, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের নিজেদের সামরিক সক্ষমতা সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ধারণা দেওয়া। সিঙ্গাপুর-ভিত্তিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক আলেকজান্ডার নেইলের মতে, ‘চীন এই কুচকাওয়াজ ও বৃহৎ সমরাস্ত্রের প্রদর্শনীর মাধ্যমে তার প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং সামরিক শক্তির বার্তা দিয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বী সামরিক পরিকল্পনাবিদদের জন্য এটি একটি গুরুতর চিন্তার বিষয়।’

কুচকাওয়াজের মূল দিকগুলো: চীনের এই সামরিক কুচকাওয়াজ শুধু দূরপাল্লার অস্ত্রের প্রদর্শনীই ছিল না; বরং এতে চীনের সামরিক বাহিনীর বহুমুখী সক্ষমতাও তুলে ধরা হয়। এই প্রদর্শনীতে প্রথমবারের মতো চীন তার স্থল, সমুদ্র ও আকাশ থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য পারমাণবিক অস্ত্রের সম্পূর্ণ ‘ট্রায়াড’ প্রদর্শন করেছে। এতে অন্তর্ভুক্ত ছিল ডিএফ-৫সি আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং একটি নতুন সড়ক-মোবাইল দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ডিএফ-৬১।

সমরাস্ত্রের বিশাল প্রদর্শনীতে চীন নতুন প্রযুক্তির বিষয়ে তার আগ্রহেরও প্রমাণ দিয়েছে। প্রদর্শনীতে নতুন ধরনের সমুদ্র ড্রোন এবং হাইপারসনিক অস্ত্র প্রদর্শিত হয়েছে। এ ছাড়া নতুন প্রজন্মের যুদ্ধ ট্যাংকও উন্মোচন করা হয়। টাইপ-১০০ নামের এই ট্যাংক এয়ার ডিফেন্স ও গোয়েন্দা ড্রোন সিস্টেম দিয়ে সজ্জিত।

আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো গতকাল অনুষ্ঠিত চীনের সামরিক বাহিনীর কুচকাওয়াজে দেশটির নবগঠিত মহাকাশ, সাইবারস্পেস এবং তথ্য সহায়তা ইউনিটগুলোও অংশ নেয়। বিশ্লেষকদের মতে, এর মাধ্যমে চীন দেখাতে চেয়েছে যে, তারা অত্যাধুনিক মহাকাশ এবং ইলেকট্রনিক যুদ্ধেও নিজেদের সক্ষমতা বাড়াতে প্রস্তুত। তাইওয়ানের অধ্যাপক ইং-ইউ লিনের মতে, এই পরিবর্তনগুলো সম্ভবত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে এসেছে, যেখানে ড্রোনের ব্যাপক ব্যবহার দেখা গেছে।

কাকে কী বার্তা দিল চীন: বিশ্লেষকদের মতে, এই কুচকাওয়াজ ও সমরাস্ত্রের প্রদর্শনী যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি চীনের একটি সুস্পষ্ট প্রতিরোধের বার্তা। বিশেষ করে, চীনের নতুন দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ডিএফ-৬১ এবং আপগ্রেড করা আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র ডিএফ-৫সি, যার পাল্লা প্রায় ২০ হাজার কিলোমিটার, প্রদর্শন করে চীন বোঝাতে চেয়েছে যে, তার পারমাণবিক সক্ষমতা এখন আরও বিস্তৃত ও শক্তিশালী। সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অস্ত্রগুলো পূর্ব এশিয়ায় যে কোনো সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনাকে জটিল করে তুলতে পারে। চীনের ডিএফ-২৬ মাঝারি-পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, যা যুদ্ধজাহাজ ও গুয়ামের মতো সামরিক ঘাঁটিকে লক্ষ্যবস্তু করতে পারে, তা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি বড় হুমকি। তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে কোনো সংঘাত হলে দক্ষিণ ও পূর্ব চীন সাগরে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা চীনের জন্য অপরিহার্য, যা এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যের কারণে কঠিন ছিল। নতুন অস্ত্রের প্রদর্শনীতে চীন এই বার্তা দিয়েছে যে, তারা এই অঞ্চলে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে বদ্ধপরিকর।

এ ছাড়া বৃহৎ এই সামরিক প্রদর্শনীতে চীনের প্রতিবেশী দেশগুলো, যেমন ভারত ও রাশিয়াকেও বার্তা দেওয়া হয়েছে। বেইজিং দেখাতে চেয়েছে, তারা এখন কেবল একটি অর্থনৈতিক শক্তি নয়; বরং একটি সামরিক পরাশক্তিও। চীন নিজেকে বিশ্ব শান্তি এবং স্থিতিশীলতার ‘রক্ষক’ হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে, যা অনেক দেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বব্যাপী ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ তৈরি করেছে।

গ্লোবাল টাইমসে প্রকাশিত এক নিবন্ধ অনুযায়ী, চীনের এই কুচকাওয়াজ ‘শান্তির জন্য প্রাচ্যের প্রতিশ্রুতি’ এবং ‘মানবতার জন্য একত্রে ভবিষ্যৎ গড়ার অঙ্গীকার।’ এই বার্তাগুলোর উদ্দেশ্য হলো, ছোট দেশগুলোকে আশ্বস্ত করা যে চীন তাদের পাশে আছে এবং তারা বিশ্বের নতুন পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে।

বিশ্লেষক আলেকজান্ডার নেইলের মতে, চীনের এই সমরাস্ত্রের প্রদর্শনীর আরেকটি উদ্দেশ্য হতে পারে নতুন সামরিক প্রযুক্তি অন্য দেশগুলোর কাছে বিক্রি করা। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়, চীন তার এই প্রযুক্তি অন্যান্য সামরিক বাহিনীর কাছে বিক্রি করতে আগ্রহী। এটি চীনের সামরিক প্রযুক্তি রপ্তানি বাজারকে আরও সম্প্রসারিত করতে সাহায্য করবে।’

কিছু বিশ্লেষক অবশ্য বলছেন, চীনের এই প্রদর্শনীর পেছনে কিছু কৌশলও থাকতে পারে। তাইওয়ান-ভিত্তিক অ্যাসোসিয়েশন অব স্ট্র্যাটেজিক ফোরসাইটের গবেষক চিয়ে চুংয়ের মতে, ‘কিছু অস্ত্র হয়তো এখনো সীমিত পর্যায়ে মোতায়েন করা হয়েছে এবং ফিল্ড টেস্টিং-এর মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।’ এ ধরনের অস্ত্র প্রদর্শন করে চীন হয়তো নিজেদের সক্ষমতা বাড়িয়ে দেখাতে চাইছে, মনে করেন চিয়ে চুং।

তবে ক্যানবেরার ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলসের ফেলো জেনিফার পার্কারের মতো বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, চীনের এই সক্ষমতাকে অবমূল্যায়ন করা উচিত নয়। তার মতে, ‘যদিও এর সঙ্গে কিছুটা প্রতারণা থাকতে পারে, তবে আমাদের চীনের সক্ষমতাকে অবমূল্যায়ন করা উচিত নয়। তারা একটি অত্যন্ত সক্ষম সামরিক বাহিনী, এবং আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত।’

জোরালো কূটনৈতিক বার্তা: সামরিক কুচকাওয়াজ ও সমরাস্ত্রের বৃহৎ প্রদর্শনীর মাধ্যমে কূটনৈতিক দিক থেকেও চীন একটি শক্তিশালী বার্তা দিয়েছে। এই অনুষ্ঠানে অনেক অ-পশ্চিমা দেশের নেতারা উপস্থিত ছিলেন, কিন্তু সবচেয়ে বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করেছে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং উত্তর কোরিয়ার কিম জং উনের একসঙ্গে উপস্থিতি। বিশ্লেষকরা বলছেন, তিন নেতার এই ছবি পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতি একটি স্পষ্ট প্রতিরোধের বার্তা দিয়েছে।

শি জিনপিং তার উদ্বোধনী ভাষণে বলেন, বিশ্ব এখন ‘শান্তি ও যুদ্ধের মধ্যে একটি পছন্দের মুখোমুখি।’ তিনি হুঁশিয়ারি দেন, চীন একটি মহান জাতি, যা ‘কোনো ধরনের উৎপীড়নকারীকে ভয় করে না।’ তার এই মন্তব্যকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের প্রতি একটি প্রচ্ছন্ন হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

দরজা খুলতেই সন্তানের সামনে মাকে হত্যা

‘জাতীয় পার্টিসহ ১৪ দলকে নিষিদ্ধ না করলে সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা’

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় শরীয়তপুরে রোপণ করা হবে তিন লাখ গাছ

শান্তি চুক্তির আগে-পরে ইউক্রেনকে সহযোগিতায় প্রস্তুত যুক্তরাজ্য ও মিত্র দেশ 

ক্যান্টনমেন্ট অধিদপ্তরের অধীনে কাজের সুযোগ, পদ ৬৩

জিএম কাদের ও তার স্ত্রীর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

শেখ হাসিনা-কামালের মামলায় রাজসাক্ষী মামুনের জেরা চলছে

আইসিইউতে কিংবদন্তি লালন সংগীতশিল্পী ফরিদা, যা জানা গেল

তারেক রহমানের সহায়তায় নতুন জীবন পেল রাতুল

তালাবদ্ধ ঘরে ব্যবসায়ীর লাশ, চিরকুটে লেখা ছিল হত্যার কারণ

১০

সংসার ভাঙল মোনালি ঠাকুরের

১১

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে ১৪৪ পদে বড় নিয়োগ, আবেদন করুন দ্রুত

১২

ঝাউবাগানে ঝুলছিল সাংবাদিকের মরদেহ

১৩

কালো জাদু হলে বুঝবেন কীভাবে? যে ৫টি আলামত বললেন বিশেষজ্ঞ আলেম

১৪

পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে পিটার হাসের ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক

১৫

‘ছাত্র ও যুবসমাজের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবে বিএনপি’

১৬

বিপজ্জনক মধ্যপ্রাচ্য, যে কোনো সময় বৃহত্তর যুদ্ধ শুরু 

১৭

কুখ্যাত সন্ত্রাসী কোপা মাসুদ গ্রেপ্তার

১৮

আপিল বিভাগের রায়ে তারেক রহমান নির্দোষ প্রমাণিত: কায়সার কামাল

১৯

যুক্তরাজ্যে বিনামূল্যে উচ্চশিক্ষার সুযোগ 

২০
X