ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে ৩৬ দফাসংবলিত একটি রূপরেখা বা প্রস্তাবনা চূড়ান্ত করেছে বিএনপি। সেখানে জামায়াতে ইসলামী সংশ্লিষ্ট চার প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্মকর্তাকে আগামী নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কোনো কাজে না রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এই চার প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে দুটি ব্যাংক ও দুটি হাসপাতাল। এ ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন কমিটি গঠন না করাসহ বিগত তিনটি নির্বাচনের (২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪) সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ‘বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ’ কর্মকর্তাদেরও নির্বাচনী কাজে বিরত রাখার প্রস্তাব থাকছে এই ৩৬ দফায়। বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের সূত্রে এ তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।
দলটি মনে করে, এসব কর্মকর্তাকে সম্পৃক্ত করা হলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এছাড়া অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু উপদেষ্টার কার্যক্রম, প্রশাসনিক রদবদল-পদায়নসহ দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে এই রূপরেখা প্রণয়ন করেছে বিএনপি, যা গত সোমবার অনুষ্ঠিত দলের স্থায়ী কমিটির সভায় চূড়ান্ত করা হয়।
এই ৩৬ দফা প্রস্তাবনা নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) সঙ্গে আলোচনা করবে বিএনপি। এ লক্ষ্যে স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খানের নেতৃত্বে দলের উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল আজ বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে নির্বাচন কমিশন (ইসি) ভবনে যাবে। সেখানে সিইসিকে এই ৩৬ দফা তুলে দেবে দলটি।
বিএনপি বেশ কিছুদিন ধরে নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন এবং সরকার তথা কিছু উপদেষ্টার কার্যক্রম নিয়ে কাজ করে আসছে। বিএনপি নেতাদের পর্যবেক্ষণে কিছু উপদেষ্টার বক্তব্য, তৎপরতা ও কার্যক্রমে সরকারের নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন হচ্ছে। বিএনপির অভিযোগ, প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ পদে রদবদল-পদায়ন নিয়ে এসব উপদেষ্টা পক্ষপাতমূলক আচরণ করছেন। গত বছরের ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর প্রশাসনে যেসব রদবদল ও নতুন পদায়ন হয়েছে, সেখানে জামায়াত-ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় নির্বাচন সামনে রেখে গত মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তার নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে এখন থেকে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে বিএনপি। সে সঙ্গে সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে থাকা দল-ঘনিষ্ঠদের বিষয়েও পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে।
সরকারের পাশাপাশি ইসিরও এখন থেকেই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করাসহ নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সব কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা চায় বিএনপি। দলটির অভিযোগ, নির্বাচন সামনে রেখে মাঠপর্যায়ের ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের যে তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে, সেখানেও জামায়াত-ঘনিষ্ঠদের প্রভাব দেখা যাচ্ছে। বিএনপির অভিমত, এতে করে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
প্রস্তাবনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের শতভাগ নিরপেক্ষতা নিশ্চিতের জন্য এখনই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আদলে এই সরকারের ও নির্বাচন কমিশনের দৃঢ় ভূমিকা পালন করতে হবে। নির্বাচনকে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করার লক্ষ্যে মাঠ প্রশাসনকে সম্পূর্ণ ঢেলে সাজাতে হবে। যেমন—ডিসি (রিটার্নিং কর্মকর্তা), ইউএনও (সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা), এসপি, ওসি এবং ক্ষেত্রমতে কমিশনার, পুলিশ কমিশনার, সবার জন্য প্রযোজ্য হবে।
বিএনপির প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছে, বিগত ‘অবৈধ’ নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট সব বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ কর্মকর্তাকে চিহ্নিত করে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে তাদের কোনোরূপ নির্বাচনী দায়িত্ব প্রদান করা যাবে না। রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি সম্ভাব্য ক্ষেত্রে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তাদের (ইলেকশন সার্ভিস) মধ্যে থেকে দক্ষ, সৎ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের নিয়োগের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৩৬ দফার প্রস্তাবে আরও রয়েছে, নির্বাচনী সময়সূচি ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেক জেলার জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ে এবং প্রত্যেক উপজেলা/থানায়/নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ে একটি করে অভিযোগ নিরসন কেন্দ্র চালু করতে হবে। নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কোনো অভিযোগ প্রাপ্তির ১২ ঘণ্টার মধ্যে বা যত দ্রুত সম্ভব তা নিষ্পত্তি করে অভিযোগকারীকে লিখিতভাবে অবহিত করতে হবে। জুলাই-২০২৪ এর ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সারা দেশে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ম্যানেজিং কমিটি/গভর্নিং বডি গঠিত হয়েছে। হঠাৎ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়সূচি ঘোষণার ঠিক পূর্বমুহূর্তে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তড়িঘড়ি করে আগামী ১ নভেম্বরের মধ্যে নতুন করে নির্বাচন সম্পন্নের জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে, যা সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এই কার্যক্রমের ফলে সারা দেশে শিক্ষক/শিক্ষিকাদের বার্ষিক পরীক্ষার একাডেমিক কার্যক্রম, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম, ভোটকেন্দ্রের নির্বাচনের প্রাক-কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো একটি বৃহৎ কার্যক্রমে শিক্ষক/শিক্ষিকা, অভিভাবক তথা ভোটারদের মধ্যে চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তাই অবিলম্বে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ম্যানেজিং কমিটি/গভর্নিং বডি নির্বাচন সংক্রান্ত নির্দেশনা স্থগিত করতে হবে।
এতে আরও বলা হয়েছে, নির্বাচনের নিরপেক্ষতা বজায় রাখার স্বার্থে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা বা পোলিং পারসোন্যাল তথা প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, পোলিং অফিসার নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে সর্বমহলের কাছে চিহ্নিত এমন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগ প্রদান করা যাবে না। এক্ষেত্রে তারা কয়েকটি ব্যাংক ও হাসপাতালের নাম উল্লেখ করেন।
নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সব প্রতিষ্ঠানে এবং দূতাবাসগুলোয় চুক্তিভিত্তিক সব নিয়োগ বাতিল করতে হবে। নির্বাচনে সম্ভাব্য সব কারচুপির সুযোগ প্রতিরোধ করে নিখুঁত ও ত্রুটিমুক্ত ফল নিশ্চিত করতে হবে। ভোটারদের প্রভাবিত করে—এরূপ ধর্মীয় প্রলোভন বা ধর্মীয় দণ্ড প্রদানের ভীতি প্রদর্শন রোধ করতে হবে। প্রবাসীদের পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে ভোটাধিকার প্রয়োগ আইনানুগ স্বচ্ছতার সঙ্গে করতে হবে। বিভিন্ন দেশে পোস্টাল ব্যালটে ভোট দানে ইচ্ছুক রেজিস্টার্ড প্রবাসী ভোটারদের তালিকা রাজনৈতিক দলকে যৌক্তিক সময়ের আগেই সরবরাহ করতে হবে।
মন্তব্য করুন