দেশের কৃষিবিদদের জাতীয় সংগঠন কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ (কেআইবি)-এর নির্বাচনের জন্য উন্মুখ সদস্যরা। গত বছরের ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বহুপ্রতীক্ষিত এই নির্বাচন আয়োজনে প্রশাসকও নিয়োগ দিয়েছে সমাজসেবা অধিদপ্তর। প্রশাসক লে. কর্নেল (অব.) মো. আব্দুর রব খানকে নিয়োগের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন শেষে নতুন কমিটির কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করতে বলা হলেও সেদিকে খুব একটা নজর নেই তার। কেআইবি সদস্যরা বলছেন, নির্বাচন নয়, অপ্রয়োজনীয় উন্নয়ন আর মেরামতের নামে অর্থ ও সময় অপচয় করাতেই মনোযোগ বেশি প্রশাসকের। দীর্ঘ ১৫ বছর পর গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচন আয়োজনের সুযোগকে উদরস্থ করে নিয়মবহির্ভূতভাবে লাভজনক কাজে মনোনিবেশ করেছেন প্রশাসক।
এমন পরিস্থিতিতে গত ২৭ এপ্রিল ও ২২ জুলাই দুই দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে নির্বাচন আয়োজনের জন্য ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত কেআইবি প্রশাসকের দায়িত্ব দেওয়া হয় আব্দুর রব খানকে। কিন্তু বর্ধিত এই সময়ের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করেননি তিনি। সদস্যদের চাপের মুখে শেষমেশ নির্বাচনের পথে হাঁটলেও সাধারণ সভা আহ্বান ছাড়াই গঠন করেন নির্বাচন কমিশন, যাকে সম্পূর্ণ অবৈধ বলছেন অনেকেই। প্রশাসক জ্যেষ্ঠ কৃষিবিদদের মতামত ছাড়াই ইচ্ছামতো নির্বাচন কমিশন গঠন করেছেন। এতে রাজনৈতিক দলের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে অভিযোগ তুলে কেআইবির সাধারণ সদস্যরা এটিকে ক্ষমতার অপব্যবহার বলে উল্লেখ করেন, যা নিয়ে সংগঠনের সদস্যরা রীতিমতো ক্ষুব্ধ। করেছেন বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশও।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, কেআইবি প্রশাসক কোনো উন্নয়নকাজ, কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত বা নিয়োগ দিতে পারবেন না; কিন্তু নিয়মের তোয়াক্কা না করে এসবের সবই করছেন তিনি।
কেআইবির একাধিক সদস্য অভিযোগ করে কালবেলাকে বলেন, নির্বাচনের দাবি নিয়ে প্রশাসক লে. কর্নেল (অব.) মো. আব্দুর রব খানের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করা হলেও নানা টালবাহানা করে তিন মাসের জায়গায় ৯ মাস ধরে চেয়ার আঁকড়ে আছেন তিনি। সংশ্লিষ্ট কারও অনুমতি ছাড়াই ইচ্ছামতো অপ্রয়োজনীয় উন্নয়নকাজে ব্যয় করছেন কেআইবির তহবিলের টাকা। অথচ সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে ইনস্টিটিউশনের ডাটাবেস সফটওয়্যার ডেভেলপ করা জরুরি হলেও সেদিকে নজর নেই। প্রশাসকের উন্নয়ন করার নিয়ম না থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন উন্নয়নকাজে এরই মধ্যে ৫০-৬০ লাখ টাকা খরচ দেখানো হয়েছে।
কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, সমাজসেবা অধিদপ্তর গত ১২ ফেব্রুয়ারি কেআইবির প্রশাসক হিসেবে আব্দুর রব খানকে নিয়োগ দেয়। ১৩ মার্চ অবসরকালীন পদ ও পদবি অনুযায়ী বেতন স্কেল অনুসরণ করে মূল বেতন, বাড়ি ভাড়া ও যাতায়াত ভাতার বিষয়টি বিবেচনা করার কথা বলে অধিদপ্তর। কিন্তু তা না করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মচারীদের স্কেল অনুসারে বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। আব্দুর রব খান প্রতি মাসে বেতন হিসেবে নেন ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। এ ছাড়াও মাসে গাড়ির ভাড়া ও তেলের খরচ বাবদ নেন ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা। বেতন-ভাতার সমপরিমাণ অর্থ ঈদ বোনাস এবং বাংলা নববর্ষ ভাতা হিসেবেও গ্রহণ করেছেন। একইভাবে গাড়ি মেরামতের জন্য খরচ করছেন অর্থ।
কেআইবির তথ্যানুযায়ী, অবৈধভাবে নিজের পরিচিত ৫ জনকে নিয়োগ দিয়েছেন আব্দুর রব খান। তাদের মধ্যে সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্লাব ইনচার্জ পদে মো. জহিরুল ইসলাম ভূঁইয়া এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে সৈয়দ ইমরুল কায়েস মো. কাফিকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাদের দুজনেরই বেতন মাসে ৪৫ হাজার টাকা করে। আর ২৫ হাজার টাকা বেতনে ডরমিটরি ইনচার্জ হিসেবে ডি. এম. মাহবুবুর রহমান এবং আহমেদ ইফতেখার রায়ানকে দৈনিক মজুরি ৮০০ টাকায় কমপ্লেক্স ক্যাশিয়ার ও হোসাইন মোহাম্মদ আব্দুল্লাহকে কেআইবির ডাটা এন্ট্রি অপারেটর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে আরও দুজনকে নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে বলে জানা গেছে। কেআইবির স্থায়ী কর্মচারী ছুটি ভোগ করায় ছুটি অনুমোদন না করে কোনো ধরনের কারণ দর্শানোর নোটিশ বা পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই সরাসরি চাকরি থেকে অব্যাহতি প্রদান করেছেন। ওই অব্যাহতিপত্রে চাকরিচ্যুত কর্মচারীর বেতন-ভাতাদির বিষয়ে তিনি কিছুই উল্লেখ করেননি। যা কেআইবি কর্মচারী চাকরি বিধি প্রবিধানমালা ও সরকারি চাকরি বিধিমালার পরিপন্থি। মেরামতের কাজ ও খরচের কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, দুটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) মেরামতের খরচ দেখানো হয়েছে ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা। বসানো হয়েছে ২টি কমপ্রেসর, যার প্রতিটির ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। যদিও প্রথমে এই কাজের কোটেশন দেওয়া হয়েছিল মাত্র ৯৩ হাজার টাকায়। পরে তা বাতিল করে প্রায় দ্বিগুণ খরচে কাজ করানো হয়। অডিটোরিয়ামের ছাদ মেরামত করান ১৫ লাখ টাকায়। ১০ লাখ টাকার কাজ তার পছন্দের লোকের মাধ্যমে করান প্রায় ১৫ লাখ টাকায়। অযাচিতভাবে ক্লাব, অফিস ও আরও কিছু জায়গায় সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়, যার ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। ৬০ হাজার টাকায় ১৬টি সোফাসেট মেরামতের কোটেশন দিয়ে কাজের অনুমতি দেওয়া হলেও তা বাদ দিয়ে নিজের পরিচিত লোক দিয়ে কাজ করিয়ে খরচ দেখানো হয়েছে ১ লাখ ২৮৬২ টাকা। এর মধ্যে শুধু কাজের মজুরি দেখানো হয়েছে ৪১ হাজার টাকা। জেনারেটর মালপত্র ক্রয় ও মেরামতে খরচ দেখানো হয়েছে ৯০ হাজার ২৭৫৫ টাকা। এর মধ্যে শুধু জেনারেটর পরিদর্শন, সমস্যা চিহ্নিত ও সার্ভিস চার্জ দেখানো হয়েছে ৫৪ হাজার টাকা। অথচ এই পুরো কাজের জন্য মোট ৩৫ হাজার টাকা কোটেশন দেওয়া হয়েছিল। ডরমিটরির কিছু জায়গায় সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো হয়েছে ১ লাখ ৪৭ হাজার টাকায়।
৪ লাখ ৬৩ হাজার টাকায় ক্লাবের ডরমিটরিতে নতুন করে সিসিটিভি বসানো হয়েছে। এই কাজ করতে একটি আইটি ফার্ম ২ লাখ ২০ হাজার টাকার প্রস্তাব দিয়েছিল। ডানহাম বুশের ১২ টন এসি ও ১৮ টন এসির মেরামতকাজে ব্যয় দেখানো হয়েছে ২ লাখ ৯৩ হাজার টাকা। অথচ এই কাজ করতে একটি প্রতিষ্ঠান মাত্র ১ লাখ টাকার প্রস্তাব দিলেও গ্রহণ করা হয়নি। কাজ করার এক মাস পরই আরও বড় সমস্যা দেখা দেয়। যার সমাধানে ৬ থেকে ৮ লাখ টাকা ব্যয়ের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। সারা বছর সবকিছু ঠিকঠাক চললেও গত জুন মাসে কেআইবি ভবনের
সাব-স্টেশন সুইচ গিয়ার ভিসিবি মেরামত ও সার্ভিসের বিল দেওয়া হয়েছে ১ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। মূলত এই কাজে স্বাভাবিকের চেয়ে তিনগুণ বিল দেখানো হয়েছে। কৃষিবিদদের অভিযোগ, প্রতিটি কাজেই স্বাভাবিক খরচের চেয়ে বেশি খরচ দেখানো হয়েছে এবং বিভিন্ন সময় যারা এসব করেছেন তাদের না দিয়ে প্রশাসক তার পরিচিত লোকজনকে দিয়ে কাজ করিয়েছেন। ঢাকার বাইরে ৫ দিনের সফরে খরচ নিয়েছেন ৪৬ হাজার ৭৯০ টাকা। ২০১৫ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত কোনো অডিট হয়নি। বাহ্যিক নিরীক্ষার জন্য একটি ফার্মের সঙ্গে ১০ সপ্তাহের জন্য চুক্তি করা হয়, যা শুরু হয় গত ২৭ এপ্রিল। দুই ধাপে ৫ মাস ধরে অডিট করা হয়। প্রশাসক তার কর্মপরিধি-বহির্ভূত এবং কোনো প্রকার নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে একক ক্ষমতাবলে ৮ লাখ টাকায় অডিটর নিয়োগ দিয়ে ইচ্ছামতো অডিট করান।
এ ছাড়া কেআইবির পেছনের ভবনের যে দুটি ফ্লোর খালি আছে, তার একটি ফ্লোরে ডরমিটরি এক্সটেনশন করার লক্ষ্যে এরই মধ্যে বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রস্তাব সংগ্রহ করেছেন প্রশাসক। আর অন্য ফ্লোরটি ভাড়া দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা গেছে। ৩০ হাজার কৃষিবিদকে আইডি কার্ড প্রদান ও কেআইবির মাঠের চারপাশ সৌন্দর্যবর্ধনে একটি প্রকল্প হাতে নিতে চাচ্ছেন প্রশাসক।
এভাবে মূল কাজ নির্বাচন আয়োজনকে পাস কাটিয়ে নিয়মবহির্ভূতভাবে একের পর এক বিভিন্ন উন্নয়নকাজ করার প্রতিবাদ জানিয়ে বিক্ষোভ করেন কৃষিবিদরা। তারা প্রশাসকের বিরুদ্ধে নির্বাচন নিয়ে টালবাহানার অভিযোগ তুলে তার পদত্যাগের দাবি জানান।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক কৃষিবিদ শামীমুর রহমান শামীম কালবেলাকে বলেন, ‘তিন মাসের মধ্যে নির্বাচনের জন্য প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ৯ মাস হয়ে যাচ্ছে, নির্বাচন না দিয়ে নিয়মের বাইরে তিনি (প্রশাসক) কাজ করছেন। নিয়োগ বা চাকরিচ্যুত ও উন্নয়ন—এমন কোনো কিছু করার নিয়ম তার নেই। কিন্তু নির্বাচন না দিয়ে বিভিন্ন কাজ করে যাচ্ছেন, যার প্রয়োজন নেই। প্রশাসকের সঙ্গে মিটিং করে নির্বাচনের দাবি করা হলেও তার কোনো কর্ণপাত নেই। আমরা কৃষিবিদরা ১৫ বছর ধরে বঞ্চিত, এখনো নির্বাচন থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।’
একই ধরনের অভিযোগ করেন কেআইবির সাবেক মহাসচিব কৃষিবিদ আনোয়ারুনবী মজুমদার (বাবলু)। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘সমাজসেবা অধিদপ্তর প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে নির্বাচনের জন্য, কিন্তু তা হচ্ছে না। প্রশাসকের এখতিয়ার নেই কাউকে নিয়োগ বা চাকরিচ্যুত করা ও উন্নয়ন করার। এসব করবে নির্বাচিত কমিটি। কিন্তু এই প্রশাসক তা না করে কেআইবির অর্থ খরচ করে অপ্রয়োজনীয় কাজ করেছেন। নির্বাচনের দাবি নিয়ে আমরা তার সঙ্গে মিটিং করেছি, কিন্তু নির্বাচন না দিয়ে সময়ক্ষেপণ করছেন।’
এদিকে সদস্যদের চাপের মুখে নির্বাচনের পথে হাঁটলেও অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশন গঠনের অভিযোগ উঠেছে আব্দুর রব খানের বিরুদ্ধে। তাকে অপসারণ এবং একতরফাভাবে গঠিত নির্বাচন কমিশন ও ঘোষিত তপশিল বাতিলের দাবিতে গত সোমবার বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেন কৃষিবিদরা। রাজধানীর খামারবাড়ি সড়কে কেআইবি কমপ্লেক্সের সামনে এ কর্মসূচি পালন করা হয়।
সমাবেশে বক্তারা অভিযোগ করেন, প্রশাসক আব্দুর রব খান দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই কেআইবিতে অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা ও দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন। নিজের পছন্দের ব্যক্তিদের অনিয়মভাবে নিয়োগ দিয়েছেন, যা কেআইবির বিধিবিধানের পরিপন্থি। বর্তমান প্রশাসক কৃষিবিদদের অগ্রাহ্য করে একতরফাভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। প্রশাসক নিজের ইচ্ছামতো রাজনৈতিকভাবে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করেছেন। তার বিরুদ্ধে বিস্তর দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এসব তুলে ধরে সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে কেআইবির প্রশাসক লে. কর্নেল (অব.) মো. আব্দুর রব খানের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। পরে কল করার কারণ জানিয়ে বার্তা পাঠায়েও কোনো সাড়া মেলেনি।
মন্তব্য করুন