

বাড়ির সামনে থেমে আছে লাশবাহী গাড়ি। যার ভেতর কফিনে ধবধবে সাদা কাফনের কাপড়ে মোড়ানো রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় মেট্রোরেলের ট্রাকের খসে পড়া বিয়ারিং প্যাডের আঘাতে নিহত আবুল কালামের মরদেহ। গাড়ির বাইরে থেকে কাচের ভেতর দিয়ে তাকিয়ে তার ছোট্ট দুই সন্তান আব্দুল্লাহ (৫) ও পারিসা (৩)। প্রতিদিনের মতো তার বাবার চোখ মেলার অপেক্ষায়; কিন্তু এই দুই শিশুর সংক্ষিপ্ত জীবনকালের গতকাল সোমবারের সকালটি ছিল অন্যরকম। তাদের মায়ের দুচোখ দিয়ে অঝোরে ঝরছে অশ্রু, আর কানে ক্রমাগত বেজে উঠছে আহাজারি। ছোট্ট দুটি শিশু মাকে সান্ত্বনা দিতে বলতে থাকে, ‘মা তুমি কান্না করো না, বাবা ঘুমোচ্ছে।’
যদিও সন্তান বা স্বজন, কারও সান্ত্বনাই থামাতে পারছিল না নিহত আবুল কালামের স্ত্রী আইরিন আক্তার প্রিয়ার কান্না ও আহাজারি। বুক চাপড়ে মাতম করতে করতে তিনি বলছিলেন, ‘আমার সন্তানরা এখনো বুঝতে পারেনি, তাদের বাবা আর ফিরবে না। ওরা বলে, ‘বাবা ঘুমাচ্ছে মা, তুমি কান্না করো না’, আমি কীভাবে ওদের বোঝাই যে, ওদের বাবা আর কখনো জাগবে না! কালামই ছিল আমাদের একমাত্র ভরসা, এখন আমি ও আমার সন্তানরা কী করব, কোথায় যাব? আমরা একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়েছি।’
রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড খসে পড়ে প্রাণ হারান আবুল কালাম আজাদ। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন তিনি। দুপুর ১২টার আগে আগে ট্র্যাক দিয়ে মেট্রোরেল চলাচলের মুহূর্তে ওপর থেকে হঠাৎই বিয়ারিং প্যাড খুলে মাথায় পড়ে। এতে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তার। আবুল কালাম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে ঢাকায় একটি ট্র্যাভেল এজেন্সি পরিচালনা করতেন। স্বজনরা জানান, তিনি ব্যবসায়িক কাজে নিয়মিত ফার্মগেট এলাকায় যাতায়াত করতেন। গতকাল সকাল ৯টার দিকে শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার মোক্তারেরচর ইউনিয়নের ঈশ্বরকাঠি গ্রামে তার দাফন সম্পন্ন হয়েছে। স্থানীয় পোড়াগাছা মাদ্রাসা মাঠে জানাজা শেষে নড়িয়া পৌর কবরস্থানে লাশ দাফন করা হয়। ছোট্ট দুই শিশুসন্তান রেখে কালাম পাড়ি জমিয়েছেন না ফেরার দেশে। যদিও তার সন্তানরা এখনো বুঝতে পারছে না তাদের বাবা আর কখনো ফিরবেন না। এ দুর্ঘটনার খবর জানার পর থেকেই বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন কালামের স্ত্রী আইরিন আক্তার পিয়া। যা দেখে অবুঝ দুই শিশুসন্তান মায়ের কান্না থামাতে মাঝেমধ্যেই বলছেন, ‘বাবা ঘুমাচ্ছে মা, তুমি কান্না করো না।’
এর আগে গতকাল ভোরে কালামের মরদেহ তার গ্রামের বাড়ি ঈশ্বরকাঠিতে পৌঁছায়। এ সময় স্বজনদের আর্তনাদে সেখানে শোকাবহ পরিবেশ তৈরি হয়। কালামের আকস্মিক এমন মৃত্যুতে শোকাতুর পুরো গ্রামের মানুষ। আবুল কালাম (৩৫) ঈশ্বরকাঠি গ্রামের প্রয়াত জলিল চোকদারের ছেলে। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে থাকতেন নারায়ণগঞ্জের জলকাঠি এলাকায়। শৈশবেই হারিয়েছেন বাবা-মাকে।
চাচাতো ভাই নোমান চোকদার কালবেলাকে বলেন, ‘আবুল কালাম সৎ ও খুবই পরিশ্রমী মানুষ ছিলেন। আমাদের সবার সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক বজায় রাখতেন। তাকে এভাবে আকস্মিকভাবে হারানো আমাদের দিশেহারা করে দিয়েছে। ওর স্ত্রী ও সন্তানসহ পরিবারের জন্য সরকার কিছু করবে—এটাই আমাদের প্রত্যাশা।’
আবুল কালামের আরেক চাচাতো ভাই আব্দুল গণি চোকদার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে আমার ভাই মারা গেল। এখন এর দায় কে নেবে?’
নড়িয়ার সহকারী কমিশনার (ভূমি) লাকী দাস বলেন, ‘আবুল কালামের এমন মর্মান্তিক মৃত্যুতে আমরা শোকাহত। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমরা তার জানাজা ও দাফনে অংশ নিয়েছি। আমরা সার্বক্ষণিক তার পরিবারের পাশে আছি এবং পরিবারের লোকজন যে কোনো প্রয়োজনে প্রশাসনের সহযোগিতা পাবেন।’
অপমৃত্যুর মামলা: মেট্রোরেলের পিলার থেকে বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে পথচারী নিহতের ঘটনায় অপমৃত্যু মামলা হয়েছে। রোববার দিনের বেলা এ দুর্ঘটনার পর ওইদিন রাতে তেজগাঁও থানায় এ মামলা নথিভুক্ত হয় বলে জানিয়েছেন থানাটির ওসি মোবারক হোসেন। মামলার বাদী নিহত আবুল কালামের স্ত্রী আইরিন আক্তার প্রিয়া।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ওসি মোবারক হোসেন বলেন, ‘ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন আসার পর পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হবে। তবে নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে এ ঘটনার বিষয়ে আর কোনো অভিযোগ থাকলে তারা দিতে পারবেন। পরে তা যাচাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
মন্তব্য করুন