

বিশ্বের রাজধানীখ্যাত নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচনে আজ মঙ্গলবার ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের এ মেয়র নির্বাচনে ইতিহাস গড়তে চলেছেন বিরোধী দল ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী জোহরান মামদানি। ভোটগ্রহণের আগের বেশিরভাগ জরিপে এমনটাই ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। আজ যদি তিনি জেতেন—তবে তিনি হবেন শতবছরের মধ্যে এ শহরের সর্বকনিষ্ঠ, প্রথম মুসলিম ও দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত মেয়র।
তবে জোহরান মামদানিকে ঘিরে আলোচনার অন্ত নেই। বিশ্বগণমাধ্যমও তাকে বারবার টাইমলাইনে নিয়ে আসছে। কয়েক মাস আগেও যিনি কম পরিচিত ছিলেন, অথচ সেই ডেমোক্রেটিক প্রার্থী এখন টক্কর দিচ্ছেন খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। যাকে ফোন করে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার মতো নেতারা প্রশংসা করছেন।
মামদানিকে নিয়ে এত আলোচনার অন্যতম কারণ—তিনি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির প্রচলিত ধারার একদম বিপরীতমুখী। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তার রিপাবলিকান পার্টি যে ‘শ্বেতকায়, খ্রিষ্টান ও রক্ষণশীল’ আমেরিকার কথা বলে, বাস্তবে মামদানি তেমনটা নন। যিনি নিজেকে খোলামেলাভাবে একজন প্রগতিশীল, সমাজতন্ত্রী হিসেবে তুলে ধরেন। বারবার স্বয়ং ট্রাম্পকে প্রকাশ্যেই চ্যালেঞ্জ করেছেন এ মামদানি।
এ নির্বাচনে মামদানির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যান্ড্রু কুমো। তিনি অবশ্য সারা জীবন ডেমোক্রেটিক পার্টির সদস্য থাকলেও বাছাইপর্বে পরাজিত হয়ে এখন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন। তবে মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, ব্যালটে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নাম না থাকলেও বাস্তবে এ নির্বাচনে একজন অদৃশ্য প্রার্থী। কুমোর পক্ষ নিয়ে তিনিও এ নির্বাচনের একজন অংশগ্রহণকারী। এ কারণে বড় ব্যবধানে মামদানির বিজয় হলে অনেকেই তা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অনাস্থা হিসেবে দেখবেন। ট্রাম্পের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে অসন্তুষ্ট নিউইয়র্কবাসী এখন এমন একজনকে মেয়র হিসেবে চান, যিনি মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে পাঞ্জা নিতে পারেন।
এদিকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও নিউইয়র্কের আদি বাসিন্দা। তিনি কোনোভাবেই চান না মামদানি এ শহরের মেয়র নির্বাচিত হোন। এর মধ্যে মামদানিকে শুধু সাচ্চা কমিউনিস্ট নন, রীতিমতো উন্মাদ বলেও নিন্দা জানিয়েছেন ট্রাম্প। এমন একজনকে মেয়র করা হলে নিউইয়র্কের জন্য বরাদ্দ কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেট বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন তিনি।
কয়েক মাস আগেও মামদানি তুলনামূলকভাবে কম পরিচিত ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন হিপ হপ শিল্পী ও আবাসন উপদেষ্টা। এখন নিউইয়র্ক স্টেট অ্যাসেমব্লিম্যান এবং যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম শহরের নেতৃত্বে আসার দৌড়ে সবার চেয়ে এগিয়ে। তবে একটি জরিপ বলছে, প্রধান তিন প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জোহরান ও কুমোর মধ্যে যে কারও জেতার সম্ভাবনা রয়েছে। এ জরিপ দেখলে মনে হয়, বর্তমান মেয়র এরিক অ্যাডামসের উত্তরসূরি কে হবেন, সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেশ জমে উঠেছে।
গত বৃহস্পতিবার প্রকাশিত এমারসন কলেজ/পিআইএক্স ১১/দ্য হিলের জরিপে দেখা গেছে, ডেমোক্রেট প্রার্থী মামদানি তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী অ্যান্ড্রু কুমোর চেয়ে প্রায় ২৫ পয়েন্ট এগিয়ে রয়েছেন। এ জরিপে জোহরানের প্রতি ৫০ শতাংশ এবং কুমোর প্রতি ২৫ শতাংশ ভোটার সমর্থন জানিয়েছেন।
রিপাবলিকান প্রার্থী কার্টিস স্লিওয়া কুমোর থেকে চার পয়েন্ট পিছিয়ে আছেন। স্লিওয়ার প্রতি সমর্থন রয়েছে ২১ শতাংশ ভোটারের এবং ৪ শতাংশ ভোটার কাকে ভোট দেবেন, এখনো সেই সিদ্ধান্ত নেননি। জোহরানের সমর্থন গত মাসের তুলনায় ৭ শতাংশ বেড়েছে, কুমোর জনসমর্থন ৩ শতাংশ কমেছে, আর স্লিওয়ার সমর্থন বেড়েছে ১১ শতাংশ।
এই জরিপ গত ২৫ থেকে ২৭ অক্টোবরের মধ্যে পরিচালিত হয়েছে। এতে সম্ভাব্য ভোটার ও যারা ইতিমধ্যে ভোট দিয়েছেন, তারা অংশ নিয়েছেন।
এমারসন কলেজ পোলিংয়ের নির্বাহী পরিচালক স্পেনসার কিমবলের ভাষায়, জোহরান বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটি জোট গড়ে তুলেছেন। কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারদের মধ্যে তার সমর্থন গত মাসে ৫০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৭১ শতাংশ হয়েছে। অন্যদিকে, কুমোর সমর্থন ১০ পয়েন্ট কমেছে।
জোহরান তরুণ ভোটারদের মধ্যেও শক্ত অবস্থানে আছেন। ৫০ বছরের নিচের ৬৯ শতাংশ ভোটার তাকে সমর্থন করছেন। আর ৫০ বছরের বেশি বয়সী ভোটারদের মধ্যে ৩৭ শতাংশ জোহরানকে, ৩১ শতাংশ কুমোকে এবং ২৮ শতাংশ স্লিওয়ার প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার প্রকাশিত মারিস্ট নিউইয়র্ক সিটি জরিপে দেখা গেছে, সম্ভাব্য ভোটারদের মধ্যে জোহরান স্বতন্ত্র প্রার্থী কুমোর চেয়ে ১৬ পয়েন্ট এগিয়ে রয়েছেন।
জরিপে দেখা যায়, কাকে ভোট দেবেন, সে ব্যাপারে যারা এখনো পুরোপুরি সিদ্ধান্ত নেননি—তবে এক প্রার্থীর দিকে ঝুঁকে আছেন, তাদের মধ্যে জোহরানের প্রতি সমর্থন রয়েছে ৪৮ শতাংশ ভোটারের। আর কুমোর প্রতি ৩২ শতাংশ ও স্লিওয়ার প্রতি ১৬ শতাংশ ভোটারের সমর্থন রয়েছে। এ জরিপ ২৪ থেকে ২৮ অক্টোবরের মধ্যে পরিচালিত হয়েছে। এতে ত্রুটির সীমা হতে পারে ৪ দশমিক ২ শতাংশ পয়েন্ট।
কুইনিপিয়াক বিশ্ববিদ্যালয়ের গত বুধবার প্রকাশিত জরিপে দেখা যায়, জোহরান ৪৩ শতাংশ সম্ভাব্য ভোটারের সমর্থন পাচ্ছেন। অন্যদিকে, কুমোর প্রতি ৩৩ শতাংশ ও স্লিওয়ার প্রতি মাত্র ১৪ শতাংশ ভোটারের সমর্থন রয়েছে।
কুইনিপিয়াকের সহকারী পরিচালক মেরি স্নো বলেন, ‘প্রার্থীরা তাদের বক্তব্য পেশ করেছেন, আগাম ভোট শুরু হয়েছে, কুমোর চেয়ে জোহরান ১০ পয়েন্ট এগিয়ে, স্লিওয়া অনেক পিছিয়ে। তবে এখনো একটি ‘ওয়াইল্ড কার্ড’ আছে, সেটি হচ্ছে সিদ্ধান্তহীন ভোটারের সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে, যা শেষ পর্যায়ে পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। সিদ্ধান্তহীন ভোটারের সংখ্যা ৯ অক্টোবরের পর থেকে বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।
সাফোক বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক গবেষণাকেন্দ্রের পরিচালক ডেভিড প্যালিওলোগাস বলেন, এ নির্বাচনে এক ব্যক্তির ভোটাররাই ফল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। তিনি হচ্ছেন রিপাবলিকান প্রার্থী কার্টিস স্লিওয়া। তার ১১ শতাংশ ভোট কুমোর জয়ের পথে বড় বাধা। দ্বিতীয় পছন্দ হিসেবে সেই ভোটারদের ৩৬ শতাংশ কুমোকে এবং মাত্র ২ শতাংশ জোহরানকে পছন্দ করেন।
এখন নিউইয়র্কবাসী কাকে মেয়র হিসেবে বেছে নেবেন, আজই তা নিশ্চিত হওয়া যাবে।
ট্রাম্পের ব্যাপারে জনরায়: শুধু নিউইয়র্কে নয়, যুক্তরাষ্ট্রের আরও তিনটি অঙ্গরাজ্যের নির্বাচন হবে আজ। যার ফলাফল ট্রাম্প ও তার প্রশাসনের ব্যাপারে একটি জনরায় হিসেবে দেখা হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে নিউজার্সি ও ভার্জিনিয়ায় গভর্নর পদে নির্বাচন। এ দুই রাজ্যে প্রতিনিধি পরিষদ ও উচ্চ পরিষদের ভোটগ্রহণ করা হবে। উভয় রাজ্যে গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের হার হয়।
এ ছাড়া ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর গেভিন ন্যুসাম নির্বাচনী ম্যাপ পরিবর্তনের অনুমতি চেয়ে একটি গণভোটের আয়োজন করেছেন। আগামী বছরের নভেম্বরে মধ্যবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল হিসেবে রিপাবলিকান পার্টি বড় রকমের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে পারে। তা ঠেকাতেই ট্রাম্পের নির্দেশে টেক্সাসের নির্বাচনী ম্যাপ ঢেলে সাজানো হয়েছে।
মন্তব্য করুন