নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে সরকার একের পর এক নির্দেশনা দিলেও ব্যবসায়ীরা তা বাস্তবায়ন করছেন না। এ কারণে বাজারেও তার কোনো প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। সর্বশেষ প্রতি কেজি আলু ৩৫ থেকে ৩৬ টাকা, দেশি পেঁয়াজ ৬৫ টাকা এবং প্রতি পিস ডিমের মূল্য ১২ টাকা বেঁধে দেওয়া হলেও কোথাও এ দামে এসব পণ্য পাওয়া যাচ্ছে না। উল্টো সরবরাহ কমিয়ে দিয়ে একশ্রেণির ব্যবসায়ী বাজারে আরও অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ করেছেন আড়তদার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা।
গতকাল সোমবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে প্রতি কেজি আলু ৫০ থেকে ৫৫ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। একইভাবে প্রতি হালি ডিম ৫০ থেকে ৫২ টাকা এবং দেশি পেঁয়াজ প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ৮০ থেকে ৯০ টাকায়। এক মাসেরও বেশি সময় আগে খোলা চিনির কেজি ১৩০ টাকা নির্ধারণ করা হলেও বাজারে এখন তা ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ নিয়ে খুচরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ছেন সাধারণ ক্রেতারা।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের নির্দেশনা বাস্তবায়নে স্থানীয় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিশেষ সংস্থার মাধ্যমে নিত্যপণ্যের বাজারে নজরদারি বাড়াতে হবে। কারণ, তাদের কাছে আমদানি, মজুত ও সরবরাহসহ নিত্যপণ্যের সার্বিক তথ্য রয়েছে। তবে সরকারের নির্দেশনা বাস্তবায়নে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ছাড়া আর কোনো সংস্থার পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না।
এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়ার পর থেকে বাজারে আলুর সরবরাহ কমে গেছে বলে জানিয়েছেন আড়তদাররা। ব্যবসায়ীরা হিমাগার থেকে আলু বের না করায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের হিসাবে গত মৌসুমে দেশে আলুর উৎপাদন হয়েছে ২৯ লাখ ৪৮ হাজার টন। এর মধ্যে ৩৬৫টি হিমাগারে ২৪ লাখ ৩২ হাজার টন সংরক্ষণ করা হয়। সাধারণত ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল মাসে হিমাগারে আলু সংরক্ষণ করা হয় এবং জুন মাস থেকে খালাস শুরু হয়। এ বছরও সংরক্ষণ ও সরবরাহ স্বাভাবিকভাবে শুরু হয়।
হিমাগার প্রতিষ্ঠান হিমাদ্রি লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী এশতিয়াক আহমেদ গতকাল কালবেলাকে বলেন, ‘সরকার যে নির্দেশনা দিয়েছে, তা যৌক্তিক। নির্ধারিত দামে আলু সরবরাহ করা সম্ভব। হিমাগারগুলোতে পর্যাপ্ত আলু রয়েছে। সমস্যা হচ্ছে, যারা হিমাগারে সংরক্ষণ করেছেন, তারা এখন আলু বের করা কমিয়ে দিয়েছেন। আমরা প্রতিনিয়তই তাদের সরবরাহের জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। কিন্তু অজানা কারণে তারা আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।’
বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের হিসাব অনুযায়ী, দেশে এখনো ১১ থেকে ১২ লাখ টন আলুর মজুত রয়েছে। এতে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত আলুর কোনো সংকট হওয়ার কারণ নেই। অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির প্রেসিডেন্ট মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু সম্প্রতি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের এক মতবিনিময় সভায় জানান, ‘প্রতি কেজি আলু উৎপাদনে খরচ হয়েছে ১৮ থেকে ২০ টাকা। ফলে সব খরচ মিলিয়ে খুচরা পর্যায়ে দাম ৩৫ থেকে ৩৬ টাকার বেশি হওয়ার সুযোগ নেই। হিমাগার গেটে মে মাসে আলুর দাম ছিল ২৫ থেকে ২৭ টাকা কেজি, যা এখন ৩৮ টাকা কেজি। এক-দুদিন পরপর আলুর দাম বাড়ানো হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘সরকারি দপ্তরগুলো ঢাকায় বসে ফোন করে হিমাগারের তথ্য চান; কিন্তু সেখানে সরেজমিন না গেলে সঠিক মনিটরিং হয় না।’
অন্যদিকে, পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা দেখা দেওয়ায় জুলাই মাস থেকে আমদানির অনুমতি দিয়েছে সরকার। এ সময়ে আমদানি পর্যায়ে পেঁয়াজের দাম কিছুটা কমলেও খুচরা পর্যায়ে তার কোনো প্রভাব পড়েনি। এরপর আগস্টে ভারত সরকার পেঁয়াজ রপ্তানিতে ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে। এতে বাংলাদেশের আমদানিকারকদের ব্যয় বেড়েছে।
শ্যামবাজার কৃষিপণ্য আড়ত বণিক সমিতির সভাপতি হাজী মো. সাঈদ কালবেলাকে বলেন, ‘ভারত শুল্ক আরোপের কারণে ব্যবসায়ীদের ব্যয় বেড়েছে। তবে বাজারে আমদানি ও দেশি পেঁয়াজ পর্যাপ্ত রয়েছে। পাইকারি পর্যায়ে দেশি পেঁয়াজের কেজি ৫৩ থেকে ৫৫ টাকা এবং আমদানি করা পেঁয়াজ ৪০ থেকে ৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।’
পেঁয়াজের আড়তদার ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, সরকার দাম ঠিক করে দিলেও মোকাম বা আঞ্চলিক ব্যাপারীদের কারণে তা বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। তারা আড়ত মালিকদের দাম নির্ধারণ করে দিচ্ছে এবং তাদের সিদ্ধান্তের বাইরে কোনো আড়ত বিক্রি করলে তাকে পরবর্তী সময়ে মাল দিচ্ছে না। পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণ বা দাম নির্ধারণ আড়ত মালিকদের হাতে নেই। ব্যাপারীরা যখন যে কমিশন ঠিক করে দেয়, তাই আড়ত বা পাইকারি বাজারে বাস্তবায়ন হচ্ছে।
এদিকে নানা পদক্ষেপের পরও বাজার নিয়ন্ত্রণে না আসায় চারটি প্রতিষ্ঠানকে ৪ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দিয়েছে সরকার। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এসব প্রতিষ্ঠানকে ডিম আমদানির অনুরোধ জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবে সরকারের এ সিদ্ধান্তে প্রান্তিক খামারিদের লোকসান বাড়বে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।
বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, ‘পোলট্রি খাদ্য ও বাচ্চার দাম না কমিয়ে সরকার ডিমের দাম বেঁধে দিয়েছে। এতে প্রান্তিক খামারিদের লোকসান আরও বাড়বে। বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হলে এ খাতের মৌলিক কাঁচামাল (বাচ্চা, খাদ্য এবং ওষুধ) দাম কমাতে হবে।’
বাজার পরিস্থিতির বিষয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘চলমান পরিস্থিতিতে দুটি বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন। প্রথমত, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে দাম ঠিক করে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এখানে প্রতিযোগিতা থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, বর্তমানে দেশে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির আবহ চলছে। আর এ সুযোগে ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফা করে নিতে চাইছেন। মুদ্রাস্ফীতির কারণে তাদের লোভস্ফীতি বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকার মুদ্রাস্ফীতি কমাতে সক্ষম হলে জিনিসপত্রের দাম কমবে বলে মনে করি।’
তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতির কারণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যে কাজটি করছে, সেটি আওতায় পড়ে না। পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে হয়তো তারা দাম ঠিক করে দিচ্ছে; কিন্তু মনে রাখতে হবে, এর বাস্তবায়ন প্রশাসনকে করতে হবে। দ্রুত ও কার্যকরী আইনি পদক্ষেপ নিতে হলে সরবরাহের উৎসে যেতে হবে। সেখান থেকে নির্ধারিত দাম বাস্তবায়ন করতে হবে।’
মন্তব্য করুন