

ভোরের নিস্তব্ধতা কিংবা গভীর রাতের অন্ধকারে রাজধানী ঢাকার রাস্তায় ঘুরছে যেন মৃত্যুর বাহন। ঢাকা দক্ষিণ এবং উত্তর সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়িগুলো যেন মৃত্যুদূত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে নগরবাসীর জীবনে। কখনো ডেমরা, কখনো যাত্রাবাড়ী, আবার কখনো মুগদা—হঠাৎ করেই যমদূতের মতো ছুটে আসা এসব ময়লার গাড়ির নিচে চাপা পড়ে তরতাজা জীবন। দুর্ঘটনার খবর ছাপা হয়, শোক প্রকাশ হয়; কিন্তু কয়েকদিন পরই সব চুপচাপ হয়ে যায়। কোনো দৃষ্টান্তমূলক বিচার হয় না, শহরের রাস্তায় ময়লার গাড়িগুলোর তাণ্ডব ঠিকই চলতে থাকে। এদিকে নাগরিকদের জীবন রয়ে যায় ঝুঁকির মধ্যে।
সর্বশেষ ডেমরায় ময়লার গাড়ির ধাক্কায় প্রাণ হারিয়েছেন দুই তরুণ। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির শিক্ষার্থী তাহসিন তপু (২৫) ও ইউরোপিয়ান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ইরাম হৃদয় (২৩) শুক্রবার ভোরে একটি গায়েহলুদের অনুষ্ঠান থেকে ফিরছিলেন। এ সময় দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) একটি ময়লার গাড়ি তাদের মোটরসাইকেলে ধাক্কা দিলে ঘটনাস্থলেই তারা প্রাণ হারান। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গাড়িটি হঠাৎ অতিরিক্ত গতিতে রাস্তায় চলছিল। সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ি নিয়ে এমন ঘটনা এটিই প্রথম নয়। ওই সড়কে আগেও ময়লার গাড়ির ধাক্কায় অনেকে আহত হয়েছেন। নিহতদের বন্ধুদের অভিযোগ, এলাকার ময়লার গাড়ির চালকরা প্রায়ই মাদক সেবন করে এবং বিশেষ করে রাতে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালায় তারা।
এ ঘটনায় অভিযুক্ত গাড়ির চালক মো. রফিকুল ইসলাম রফিককে গ্রেপ্তার করেছে ডেমরা থানা পুলিশ। তাকে গ্রেপ্তারের পর আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে বলে জানান ডেমরা থানার ওসি তাইফুর রহমান মির্জা। তিনি বলেন, সড়ক পরিবহন আইনের মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এই তরতাজা দুটি প্রাণ ঝরে গেলেও এটিকে হত্যাকাণ্ড হিসেবে দেখছে না প্রশাসন। সড়ক পরিবহন আইনের মামলাতেই তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। প্রাথমিকভাবে দেখা যায়, এসব দুর্ঘটনায় চালকের সহকারী বা পরিচ্ছন্নতাকর্মীরাই অনেক সময় গাড়ি চালান। কখনো কখনো মাদকাসক্ত অবস্থায় চালকের অবহেলায়ও প্রাণহানি ঘটেছে। নিহত দুই তরুণের বন্ধুদের অভিযোগ, ওই ময়লার গাড়ির চালক মাদকাসক্ত ছিল। গত তিন বছরে ঢাকায় ময়লার গাড়ির ধাক্কায় অন্তত ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে; কিন্তু কোনো ভুক্তভোগী পরিবার বিচার পায়নি।
নগরবাসীরা বলছেন, ভোরে এবং গভীর রাতে রাস্তা ফাঁকা পেয়ে অনিয়ন্ত্রিতভাবে চলে এসব ময়লার গাড়ি। এসব গাড়ির ফিটনেস থাকে না, অনেক চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্সও থাকে না। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, চালক সংকট এবং স্থায়ী চালকদের দায়িত্বে অবহেলার কারণে ময়লাবাহী ভারী ট্রাকগুলো চালাচ্ছেন অদক্ষরা। ফলে জনবহুল নগরে হামেশাই ঘটছে দুর্ঘটনা। প্রাণ হারাচ্ছে নিরীহ মানুষ। আগের যেসব মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোর ক্ষেত্রেও দেখা গেছে, চালকের আসনে থাকা ব্যক্তিদের বেশিরভাগেরই কোনো লাইসেন্স ছিল না।
এর আগে ২৪ অক্টোবর যাত্রাবাড়ীতে ময়লার গাড়িতে পিষ্ট হয়ে প্রাণ যায় ইকবাল হোসেন (৩৫) নামে এক যুবকের। তিনি পেশায় লন্ড্রি দোকানের কর্মী ছিলেন। গাড়িটি চালাচ্ছিলেন চালকের সহকারী মো. রুবেল। স্থানীয়রা তাকে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে দেয়। সে সময় যাত্রাবাড়ী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) কাজী রমজানুল হক বলেন, ‘কেউ অভিযোগ করেনি, তাই ৫৪ ধারায় আটক দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে।’
এর আগে গত বছরের ২৫ এপ্রিল রাজধানীর মুগদায় দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির ধাক্কায় সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী মাহিন আহমেদ মারা যায়। ২০২১ সালের ২৪ নভেম্বর গুলিস্তানে ময়লার গাড়িতে নটর ডেম কলেজের ছাত্র নাঈম হাসান নিহত হন। পরদিন পান্থপথে সংবাদকর্মী আহসান কবির খান মারা যান। নাঈমের মৃত্যুর পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাজপথে নামেন শিক্ষার্থীরা।
২০২৩ সালের ৬ মার্চ উত্তর সিটি করপোরেশনের গাড়ির ধাক্কায় মারা যান কাপড় ব্যবসায়ী আবু তৈয়ব (২৬)। ২০২২ সালে ময়লার গাড়ির দুর্ঘটনায় কমপক্ষে চারজনের মৃত্যু হয়—এর মধ্যে ২ এপ্রিল খিলগাঁওয়ে নাসরিন খানম, ২৩ জানুয়ারি মহাখালী উড়াল সড়কের নিচে শিখা রানী ঘরামি, জুলাইয়ে মিরপুরে সাব্বির আহমেদ এবং মুগদার টিটিপাড়ায় নাজমা বেগম। এ ছাড়া ২০২১ সালে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের বর্জ্যবাহী গাড়ির ধাক্কায় অন্তত সাতজন প্রাণ হারান।
সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির চাপায় মৃত্যু ঘটলে কয়েকদিন ন্যায়বিচারের দাবিতে তোলপাড় হয়। নিহত ব্যক্তির পরিবার মামলার মাধ্যমে বিচার চায়। তদন্ত শেষে পুলিশ চার্জশিট জমা দেয় এবং আনুষ্ঠানিকভাবে বিচার শুরু হয়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সাক্ষী না থাকায় মামলা দীর্ঘসূত্রি হয়ে পড়ে। অনেক সময় ভুক্তভোগীর পরিবারই আসামিপক্ষের সঙ্গে আপস করে, যার ফলে অভিযুক্তরা খালাস পেয়ে যায়।
আদালত ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির চাপায় গত কয়েক বছরে প্রাণ হারানো ১৬ জনের ঘটনায় রাজধানীর বিভিন্ন থানায় স্বজনরা ১৪টি মামলা করেছেন। খিলগাঁওয়ে ডিএসসিসির ময়লার গাড়ির চাপায় নাসরিন খানমের মৃত্যু হলেও তার পরিবার মামলা করেনি। এসব মামলার মধ্যে ১০টিতে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে এবং একটিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা পড়েছে। বাকি কয়েকটি মামলা এখনো তদন্তাধীন। অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরু হয়েছে ৯টি মামলায়। তবে এর মধ্যে তিনটি মামলা আপসে নিষ্পত্তি হয়েছে এবং অভিযুক্তরা খালাস পেয়েছেন। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় কমছে না এই মৃত্যুযন্ত্রের তাণ্ডব।
সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, ময়লার গাড়ির চাপায় মৃত্যুর ঘটনা শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতির বিষয় নয়, এটি শহরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার দীর্ঘদিনের ত্রুটিকে নির্দেশ করে। অপরাধ ও দুর্ঘটনার তদন্ত প্রক্রিয়া দীর্ঘসূত্রী হওয়া, সাক্ষীর অভাব এবং আপসের মাধ্যমে মামলা বন্ধ হয়ে যাওয়া ন্যায়বিচারের পথে বড় বাধা সৃষ্টি করে। ফলে সাধারণ মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঠিক তদারকিই পারে এসব অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু রুখে দিতে।
মন্তব্য করুন