আ ন ম আমিনুর রহমান
প্রকাশ : ২৭ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২৭ জুন ২০২৩, ১০:৪৫ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ডিমের চরের বড় গুলিন্দা

সুন্দরবনের কাছে ডিমের চরের কাছে বড় গুলিন্দা পাখির ঝাঁকের একাংশ। ছবি: নুসরাত জাহান
সুন্দরবনের কাছে ডিমের চরের কাছে বড় গুলিন্দা পাখির ঝাঁকের একাংশ। ছবি: নুসরাত জাহান

২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ রাতে মঙ্গলা থেকে ছোট্ট লঞ্চ ‘এমভি গাঙচিল’-এ রওনা হয়ে সকাল ১০টা নাগাদ সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের বাঘের বৈঠকখানাখ্যাত কচিখালী বন অফিসের সামনে নোঙর করলাম। এরপর ছোট্ট ট্রলারে করে কচিখালী খালে ঢুকলাম। এবার আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য বাঘমামাকে খোঁজা।

কচিখালী খালে সকাল ১১টা ২৭ মিনিটে মায়াবী এক হরিণ শিশুর দেখা পেলাম। ওর কিছু ছবি তুলে সামনে এগোতেই পরপর দুবার মামার গর্জন শুনলাম। তবে গর্জন গগণবিদারী ছিল না, কিছুটা মোলায়েম। এটা বাঘিনীর তার সন্তানকে সতর্ক করার ডাক। যাই হোক, ডাক শোনার মিনিট দশেকের মধ্যে আমরা বোট থেকে নেমে বাঘের বৈঠকখানার ঘাসবন ধরে সামনে এগোতে থাকলাম অতি সাবধানে। কারণ, এ ধরনের ঘাসবনে বাঘ ঘাপটি মেরে বসে থাকতে পারে; কিন্তু অনেক খোঁজাখুঁজি করেও মামার দেখা পেলাম না।

কচিখালী বন অফিসে পৌঁছতে পৌঁছতে পথে অতি বিরল ও বিপন্ন সুন্দরী বায়স (Sunderban Crow) ও শ্বেত শার্দুল (White Tiger) নামক দুই প্রজাতির প্রজাপতি, লেজে নিশানযুক্ত কুচকুচে কালো পাখি সিংহরাজ বা বড় ভিংরাজ (Racket-tailed Drongo), চমৎকারভাবে খোঁপা ফোলানো মোহনচূড়া (Common Hoope), ছোট্ট পাখি নীলটুনি (Purple Sunbird) ও সৈকত পাখি গোতরার (Common Greenshank) দেখা পেলাম।

এ ছাড়া বানর আর বুনো শূকর তো ছিলই। যা-ই হোক, মামাকে দেখতে না পেয়ে ভারাক্রান্ত মনে দুপুর সোয়া ১টা নাগাদ লঞ্চে ফিরলাম। দুপুরের খাবার সেরে খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে ৪টা নাগাদ কচিখালীর উল্টো দিকে অবস্থিত ডিমের চরের দিকে রওনা হলাম। এখানে গত বছর তিনটি ছানাসহ একটি বাঘিনীর পায়ের ছাপ দেখেছিলাম। এখন ওদের খোঁজেই যাচ্ছি। চরের প্রায় কাছাকাছি এসে পড়েছি, এমন সময় পানিতে জেগে থাকা এক চিলতে ভাসা চরে লম্বা ও বাঁকা ঠোঁটের মাঝারি আকারের ৪৫টি পাখির একটি বড় ঝাঁকের দেখা পেলাম।

স্বভাবগতভাবেই নৌকায় থাকা প্রত্যেকের ক্যামেরা মুহূর্তেই যেন গর্জে উঠল! ছোট্ট একটি পয়েন্ট অ্যান্ট শুট ক্যামেরা হাতে স্ত্রী নুসরাত জাহানও তাতে অংশ নিতে কার্পণ্য করল না। পাখিগুলো উড়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ক্যামেরার শাটারে ক্লিকের ধ্বনি হতে থাকল।

বাঘের খোঁজে সুন্দরবনের ডিমের চরে নামার আগমুহূর্তে দেখা লম্বা ও বাঁকা ঠোঁটের পাখিটির নাম বড় গুলিন্দা। এ দেশের সচরাচর দৃশ্যমান শীতের পরিযায়ী পাখি ও। ছোট গুলিন্দার মতো রাম চ্যাগা, কাঁচি চ্যাগা ও কোদাইল্লা নামেও পরিচিত। তা ছাড়া সাদাচোরা, সাদা কাঁচিচোরা বা রণ-পা পাখি নামেও ডাকা হয়। পশ্চিমবঙ্গে চোপ্পা বা সাদা কাষ্ঠচূড়া নামে পরিচিত। ইংরেজি নাম Eurasian Curlwe বা Common Curlew। স্কেলোপ্যাসিডি গোত্রের পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Numenius arquata। ওদের মূল আবাসস্থল ইউরোপের ব্রিটিশ আইল্যান্ড থেকে সাইবেরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত।

প্রাপ্তবয়স্ক বড় গুলিন্দার দেহের দৈর্ঘ্য ৫০ থেকে ৬০ সেন্টিমিটার (সেমি) ও প্রসারিত ডানা ৮০ থেকে ১০০ সেমি। পুরুষের ওজন ৪০০ থেকে ১ হাজার গ্রাম ও স্ত্রীর ৪৭৫ থেকে ১ হাজার ৩৬০ গ্রাম। একনজরে পালকের রং ঘন বাদামি; এই বাদামির ওপর থাকে চমৎকার ছিট ও ছোপের কারুকাজ। ডানার তলদেশের পালক সাদা। পেট ও লেজের তলা বালু-সাদা। সতেরো সেমি লম্বা নলাকার চঞ্চুটির গোড়া হলুদাভ, বাকিটা কালচে-সবুজাভ।

মৌসুমভেদে পালকের রং বদলে হলদে বা হলদে-বাদামি হতে পারে। ওড়ার সময় পিঠ ও ডানার সাদা রং চোখে পড়ে। চোখের রং বাদামি। বাদামি রঙের চঞ্চুটি অত্যন্ত লম্বা ও কাঁচির মতো বাঁকানো। লম্বা পা, পায়ের পাতা ও আঙুলের রং ধূসর। স্ত্রী ও পুরুষ দেখতে একই রকম, তবে আকারে স্ত্রী খানিকটা বড়। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির পিঠে খুব স্পষ্ট ডোরা ও সাদা কোমরে পীতাভ আভা দেখা যায়।

বড় গুলিন্দা উপকূলীয় এলাকা, কাদাচর, বেলাভূমি, হ্রদ, চারণভূমি, বাদা বন, জলাভূমি, ধানক্ষেত ইত্যাদিতে একাকী কিংবা ছোট বা মাঝারি ছোট দলে বিচরণ করে। কাদামাটিতে ধীরে ধীরে হেঁটে লম্বা চঞ্চুর সাহায্যে কাদার নিচের নরম স্তর থেকে কেঁচো, চিংড়ি, শামুক-ঝিনুক ইত্যাদি খুঁজে খায়। প্রজনন মৌসুমে ফড়িং, উভচর প্রাণী এবং ইঁদুরও খেতে পারে। আকাশে ওড়ার সময় ‘কারলু-উ---’ শব্দে ও প্রজননকালে ‘উক-উক-উক---’ শব্দে ডাকে।

মার্চ থেকে জুলাই প্রজননকাল। এ সময় মূল আবাস এলাকার উন্মুক্ত মাটি বা ঘাসের মধ্যে সামান্য একটু গর্তের মতো করে তাতে পুরুষ পাখি মাটির ঢেলা ইত্যাদি দেয়। আর স্ত্রী সরু ঘাস ও ঝরা পালক দিয়ে বাসার গদি বানায়। ডিম পাড়ে তিন থেকে ছয়টি, রং গাঢ় দাগছিটসহ বাদামি-জলপাই। ডিম ফোটে ২৭ থেকে ২৯ দিনে। স্ত্রী-পুরুষ দুজনে মিলেমিশে ডিমে তা দেয়। ছানারা উড়তে শিখে ৩২ থেকে ৩৮ দিনে। আয়ুষ্কাল প্রায় পাঁচ বছর।

লেখক: পাখি ও বন্যপ্রাণী প্রজনন বিশেষজ্ঞ এবং অধ্যাপক, বশেমুরকৃবি, গাজীপুর

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

৩৫ ছক্কা, ১৪ চারে ১৪১ বলে ৩১৪ রান করা কে এই ব্যাটার

শীতকালীন আগাম সবজি চাষে ব্যস্ত কৃষকরা

২ জন মিলে জামাত করলে মুক্তাদি কোথায় দাঁড়াবেন? সঠিক নিয়ম জেনে নিন

সন্ধ্যার মধ্যে ঢাকাসহ ৭ জেলায় হতে পারে ঝড়বৃষ্টি

যে কারণে সঞ্জয়ের সঙ্গে প্রেম বিচ্ছেদ হয় মাধুরীর

নাক মাটিতে না লাগিয়ে শুধু কপালের ওপর সিজদা করলে কি নামাজ হবে?

দাঁড়িয়ে থাকা বাসে আরেক বাসের ধাক্কা, নিহত ১

হঠাৎ মুখোমুখি রণবীর-দীপিকা

ফিফা অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপ / ব্রাজিলের ছিটকে যাওয়ার দিনে বিশ্বকাপের পরের রাউন্ডে আর্জেন্টিনা

রাগ করে বাসা থেকে বের হওয়া তরুণের মরদেহ মিলল ধানমন্ডি লেকে

১০

মানব পাচারকারীদের ঘাঁটিতে বিজিবির হানা

১১

এইচএসসি পাসেই চাকরি দিচ্ছে আড়ং

১২

চা বাগান শ্রমিক সর্দার হত্যা, চাঞ্চল্যকর তথ্য জানাল পুলিশ

১৩

মির্জা ফখরুলের সঙ্গে গোয়েন লুইসের বৈঠক

১৪

গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা দখল / গ্রেটা থুনবার্গ ক্ষুধার্থ, বাকিদের ভাগ্যে যা ঘটেছে

১৫

ফের ক্রিকেট মাঠে মুখোমুখি ভারত-পাকিস্তান, খেলা দেখবেন যেভাবে

১৬

আয়ারল্যান্ড সিরিজের সূচি প্রকাশ, জেনে নিন কবে কখন ম্যাচ

১৭

জর্জিয়ার প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে উত্তেজিত জনতার হামলা

১৮

লোহাগড়ায় ৩১ দফা বাস্তবায়নে বিএনপি নেতা তুহিন মোল্লার লিফলেট বিতরণ

১৯

আফগানদের হোয়াইটওয়াশ করতে মুখিয়ে টাইগাররা

২০
X