সিলেটের মৌলভীবাজার জেলা সদর থেকে প্রায় ৪৭ কিলোমিটার পূর্বে পৃত্থিমপাশা জমিদারবাড়ির অবস্থান। সাধারণত পুরোনো আমলের জমিদারবাড়ি বলতে আমরা যেমন ধ্বংসপ্রায়, পলেস্তারা খসে যাওয়া বা ভেঙে যাওয়া বাড়ির কথা ভাবি, পৃত্থিমপাশা জমিদারবাড়ি এক্ষেত্রে একদমই আলাদা। ৩৫ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত পৃত্থিমপাশা জমিদারবাড়ি আজও সাজানো-গোছানো। প্রায় ৩০০ বছর পর আজও বাড়িটির আসবাবপত্র, মসজিদের ফুলেল নকশা, ইমামবাড়া আর দিঘি মানুষকে আকৃষ্ট করে।
জমিদারি প্রথা না থাকলেও পূর্ব সিলেটের তৎকালীন জমিদার নবাব আলী আমজাদ খানের এই জমিদারবাড়িটি আজও কালের সাক্ষী হয়ে আছে সগৌরবে। সাজানো-গোছানো এ বাড়ির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো এখানকার ইমামবাড়া। জমিদারির পাশাপাশি এ অঞ্চলে ইসলাম প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে এই বাড়ি। এ ছাড়া একসময় এ বাড়িতে হাতির পিলখানা, বাঘ, হরিণ, ময়ূর ইত্যাদি ছিল।
১৪৯৯ সালে মুঘল সম্রাট আকবরের সময়কালে ইরান থেকে ধর্ম প্রচারের জন্য ভারতবর্ষে আসেন সাকি সালামত খান। ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যেই তার ছেলে ইসমাইল খান ১৫৫৬ সালে পৃত্থিমপাশায় আসেন। ইসমাইল খান ছিলেন ওডিশার গভর্নর। ইসমাইল খানের ছেলে শামসুদ্দিন খান। শামসুদ্দিন খানের ছেলে রবি খান, যার নামে ১৭৫৬ সালে রবিরবাজার প্রতিষ্ঠা করা হয়। রবি খানের ছেলে আলী আহমদ খান সিলেটের তৎকালীন কাজি (বিচারক) ছিলেন। নবাব আলী আহমদ খানের ছেলে নবাব আলী আমজাদ খান। তার নামেই লন্ডনের টেমস নদীর তীরে নির্মিত ঘড়ির আদলে ১৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দে সিলেটের কিন ব্রিজের ডানপাশে সুরমা নদীর তীরে ঐতিহাসিক ঘড়ি ঘরটি নির্মাণ করেন পৃত্থিমপাশার জমিদার নবাব আলী আহমদ খান। এটি এখন সিলেটের বিখ্যাত আলী আমজাদের ঘড়ি নামে পরিচিত।
আমজাদ খানের দুই উত্তরাধিকারী হলেন আলী হায়দার খান ও আলী আজগর খান। তাদের আমলেই বাড়িটি দুই ভাগ হয়ে যায়। আলী হায়দার খানের দুই ছেলে আলী ছফদর খান ওরফে রাজা সাহেব ও আলী সারওয়ার খান ওরফে চুন্নু নবাব। আলী ছফদর খান ভাসানী ন্যাপের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। অন্যজন আলী সারওয়ার খান ১৯৭০ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হন। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ১৯৭৩ সালের উপনির্বাচনে কুলাউড়া আসনের প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
পৃত্থিমপাশার জমিদারবাড়ির সদস্যরা শিয়া মতাবলম্বী। নবাব আলী আমজাদ খান জমিদারবাড়ির মসজিদের পাশেই ইমামবাড়াটি প্রতিষ্ঠা করেন। মহররমের দিন ইমামবাড়াকে কেন্দ্র করে কারবালার কাহিনি বর্ণনা, শোক মিছিল ও মাতম চলে। এখনো পৃত্থিমপাশা জমিদারবাড়ি থেকে মহররম উপলক্ষে তাজিয়া মিছিল বের হয়। এ সময় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লক্ষাধিক লোকের সমাগম ঘটে।
পৃত্থিমপাশা জমিদারবাড়ির জমিদারদের বর্তমান উত্তরসূরি সাবেক সংসদ সদস্য ও জমিদারবাড়ির ওয়াকফ স্টেটের যুগ্ম মোতাওয়াল্লি নওয়াব আলী আব্বাছ খান এবং তার চাচাতো ভাই নবাবজাদা আলী ওয়াজেদ খান বাবু। ওয়াজেদ খান বলেন, জমিদারি আমলে রাজস্ব আসত ১১ লাখ টাকা। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী বাড়িটি ধ্বংসের চেষ্টা চালায়। জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির ফলে ১০০ বিঘা জমি বাদে বাকি সব সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।
নবাব আলী আব্বাস খান বলেন, ‘জমিদারি চলে গেলেও আগের মতোই মানুষের কল্যাণে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। মানুষ এখনো আমাদের অনেক ভালোবাসে। বাপ-দাদারা যে সম্মান পেয়েছেন আমরা এখনো মানুষের কাছ থেকে আগের মতোই সম্মান পাচ্ছি। জমিদারবাড়ির ঐতিহ্য ও ইতিহাস ধরে রাখতে পরিবারের পক্ষ থেকে যাবতীয় স্থাপনাসহ সবকিছু নিয়মিত পরিচর্যা করা হয়।
মন্তব্য করুন