ঠান্ডা ও জ্বরে আক্রান্ত সিয়ামকে (৬) নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগে এসেছেন নাসরিন সুলতানা। লালবাগের পোস্তা এলাকার এই বাসিন্দা বলেন, তিন দিন ধরে সিয়ামের জ্বর। শুরুতে স্থানীয় ফার্মেসি থেকে ওষুধ খাওয়ানোর পর কিছুটা কমলেও মা ভরসা রাখতে পারেননি। তাই ঢামেক হাসপাতালের বহির্বিভাগে নিয়ে এসেছেন। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে সিয়ামের মায়ের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি জানান, তাদের আশপাশের প্রায় প্রতি ঘরেই শিশুরা ঠান্ডাজনিত কারণে অসুস্থ। সকাল ১১টায় মেডিসিন বিভাগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে বেরিয়ে যায় হৃদয় হোসেন। ঠান্ডায় তার টনসিল বেড়ে গেছে। ব্যথায় তার স্বাভাবিক কথা বলা ও খাবার খেতেও কষ্ট হচ্ছে। রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর এলাকার এই বাসিন্দার সঙ্গে এসেছেন তার ভাই বেলাল হোসেন। তিনি কালবেলাকে বলেন, চার দিন ধরে হৃদয়ের ঠান্ডাজনিত টনসিল সমস্যা। এরপর থেকে তার কথা বলতে ও খাবার খেতে কষ্ট হচ্ছে। চিকিৎসক বলেছেন, তাকে ঠান্ডা থেকে নিরাপদে রাখতে। খাবার পানি ও গোসলে গরম পানি ব্যবহার করতে। ওষুধ ঠিকঠাক মতো খেতেও বলেছেন। তাহলে এই সমস্যা কেটে যাবে। বহির্বিভাগের মতো আন্তঃবিভাগেও রোগীর বাড়তি চাপ রয়েছে। মেডিসিন ও শিশু বিভাগে শয্যাপূর্ণ শীতের রোগীতে। ঢামেক হাসপাতালের একাধিক চিকিৎসক জানিয়েছেন, বহির্বিভাগ ও আন্তঃবিভাগে গত দুই মাসের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ রোগী এখন ভিড় করছেন। তাদের ভাষ্যমতে, শীতে জ্বর, সর্দি, ঠান্ডা, কাশি, শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়া মাথাচাড়া দেয়। যখন বেশি ঠান্ডা পড়ে, তখন শিশুদের মতো বয়স্কদেরও পাতলা পায়খানা হয়ে থাকে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) মহাখালী হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ রোগী ভিড় করছেন। আইসিডিডিআর,বির মহাখালী হাসপাতালে ডায়রিয়া রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, ভর্তি হওয়া রোগীদের সাধারণত ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ছেড়ে দেওয়া হয়। আইসিডিডিআর,বির মিডিয়া ম্যানেজার একেএম তারিফুল ইসলাম খান জানান, সাধারণত বছরে দুই মৌসুমে ডায়রিয়ার প্রকোপ সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা যায়। গ্রীষ্ম আর শীতে রাজধানীতে শিশু ও বয়স্কদের ডায়রিয়া বেশি হয়। শীতের প্রকোপ বৃদ্ধির পর প্রতিদিন গড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী মহাখালী আইসিডিডিআর,বিতে আসছেন। অন্য সময়ে ডায়রিয়া রোগী ২৫০ থেকে ৩০০ জন এসে থাকেন।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, শীতে জ্বর, সর্দি, কাশি, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া দিন দিন বাড়ছে। যত দিন যাচ্ছে, ততই এই সমস্যা জটিল হচ্ছে। বায়ুদূষণ বেড়ে যাওয়ায় ঠান্ডা-কাশির আশঙ্কাও বেড়ে যাচ্ছে। এটি বড়দের ক্ষেত্রেও হচ্ছে। ফুসফুস বায়ুদূষণের কারণে আক্রান্ত হচ্ছে। ফলে অল্প ঠান্ডা-কাশি লেগে গেলেই সেটি শ্বাসকষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এমনকি ওষুধেও এই সমস্যা সহজে দূর হতে চায় না। আবার ডায়রিয়াও বাড়ছে। প্রথম দিকে বমি হয়, পরে পাতলা পায়খানা হতে থাকে। এটি পাঁচ-সাত দিন থাকতে পারে। তারপর নিজেই ভালো হয়। এই সমস্যা এড়াতে বাইরের খাবার একেবারে বর্জন করতে হবে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের চিকিৎসক ডা. মোহাম্মদ শফিকুল আলম চৌধুরী বলেন, শীতে শিশুদের ঠান্ডাজনিত সমস্যা বেশি দেখা যায়। যেমন কাশি, অ্যাজমার প্রকোপ বেড়ে যাওয়া, সাময়িক জ্বর, কোল্ড অ্যালার্জি হয়ে থাকে। এ সময় বাতাসে ধুলাবালু বেশি থাকায় অনেকের অ্যালার্জি বা শ্বাসকষ্টের মতো সমস্যা দেখা যায়। শিশুদের মতো বয়স্ক মানুষেরও কাশি, কোল্ড অ্যালার্জির সমস্যা দেখা দিতে পারে। ঠিক সময়ে শনাক্ত করা না গেলে সেটি অনেক সময় নিউমোনিয়ায়ও রূপ নিতে পারে। ঠান্ডার কারণে অনেকের টনসিল বেড়ে গিয়ে ব্যথার সৃষ্টি হতে পারে। তিনি বলেন, যদি শ্বাসকষ্ট ও কাশি অনেক বেশি হয়, তাহলে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। চিকিৎসক যদি প্রয়োজন মনে করেন, তাহলে হাসপাতালে ভর্তি করতেও হতে পারে। অনেক অভিভাবক চিকিৎসক বলার পরও শিশুকে হাসপাতালে ভর্তি করতে চান না। তারা ভাবেন, আরেকটু দেখি। এটি ঠিক নয়।
প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, শীতে ভাইরাসজনিত নানা রোগের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা যায়। শিশুদের নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্ট বেশি হয়। বয়স্ক মানুষও এসব রোগে আক্রান্ত হন। বিশেষ করে বাত ব্যথাসহ ক্রনিক রোগ সক্রিয় হয়। শীতের রোগ থেকে বাঁচতে পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ঠান্ডা একেবারে এড়িয়ে চলতে হবে। বয়স্ক ও শিশুদের অযথা বাইরে যাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। গোসল বা হাতমুখ ধোয়া থেকে শুরু করে সবসময় কুসুম গরম পানি ব্যবহার করতে হবে। খাবার পানির ক্ষেত্রে হালকা গরম পানি মিশিয়ে খেতে পারলে ভালো। ঘরে তাপমাত্রা ঠিক রাখতে প্রয়োজনে রুম হিটার ব্যবহার করতে হবে। মৌসুমি শাকসবজি বেশি করে খেতে হবে। শিশুদের ঠান্ডা খাবার যেমন আইসক্রিম, কোক ইত্যাদি এড়িয়ে চলা উচিত বলেও তিনি মনে করেন।
ফের চোখ রাঙাচ্ছে করোনাভাইরাস:
করোনা মহামারি থেকে গোটা বিশ্ব ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। এমন সময়ে কভিডের নতুন একটি উপ-ধরন জেএন-১ আবার গোটা বিশ্বকে চোখ রাঙাচ্ছে। উপ-ধরনটি প্রতিবেশী ভারতসহ বিশ্বের অন্তত ৪১টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) নতুন এই উপ-ধরনকে ভ্যারিয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট অখ্যায়িত করে নজর রাখায় গুরুত্ব দিয়েছে। দেশে করোনাভাইরাসের পাঠানো নিয়মিত বার্তা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এক সপ্তাহে প্রায় দ্বিগুণ রোগী শনাক্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। গতকাল আরও পাঁচজন করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, শীতে জ্বর, সর্দি, কাশির মৌসুমি ভাইরাস সক্রিয় থাকে। আগামী ফেব্রুয়ারি-মার্চে কভিড পরিস্থিতি কিছুটা বাড়তে পারে। তবে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। করোনার নতুন এই উপ-ধরন তেমন বেশি ক্ষতিকর নয়। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, করোনার নতুন (কভিড-১৯-এর জেএন-১) উপ-ধরন প্রতিবেশী ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেহেতু ছড়িয়ে পড়েছে, তাই এ বিষয়ে আমাদের নজর রাখতে হবে।
রাজধানীর বাইরেও শীতের রোগের প্রকোপ:
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানিয়েছে, চট্টগ্রামে শীতে কাঁবু শিশুরা। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (চমেক), চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালসহ নগরের বিভিন্ন হাসপাতালে বাড়ছে নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তীব্র শীত শুরুর আগ থেকেই চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতালে বাড়তে শুরু করে নিউমোনিয়া, সর্দি, কাশিসহ বিভিন্ন ঠান্ডাজনিত রোগ। শুধু নিউমোনিয়াই নয়, শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে ব্রংকিওলাইটিসে। শীতকালে কিংবা এর আগেও ঋতু পরিবর্তনের সময় এই রোগ বেশি হয়। অনেকেই একে নিউমোনিয়া ভেবে শিশুকে ভুল ওষুধ প্রয়োগ করে থাকেন। প্রতিদিন চমেক হাসপাতালের বহির্বিভাগে ১৫০ থেকে ১৮০ জন শিশু রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। জ্বরের পাশাপাশি ডায়রিয়া, ব্রংকিওলাইটিস ও নিউমোনিয়ার শিশু রোগীও আসছে। গত নভেম্বরের পর থেকে বহির্বিভাগ থেকে গড়ে ১৫-২০ শিশুকে ওয়ার্ডে পাঠানো হচ্ছে। একইভাবে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে প্রতিদিন ২০০ শিশু রোগী বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিচ্ছে। চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. শেখ ফজলে রাব্বি কালবেলাকে বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে শিশু রোগী ভর্তি হয়েছে, এবার এখনো সেই পরিস্থিতি হয়নি। তবে শীত আসার পর থেকে শিশু রোগী কিছুটা বেড়েছে। বিশেষত নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। ঠান্ডাজনিত রোগ এড়াতে অভিভাবকদের আরও সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন এ চিকিৎসক।
বরিশাল ব্যুরো জানিয়েছে, দক্ষিণাঞ্চলে শীতের সঙ্গে বাড়ছে ঠান্ডাজনিত রোগ। হাসপাতালে এখন শয্যা সংকট। ঠান্ডা, শ্বাসকষ্ট, অ্যালার্জি, চর্মরোগসহ শীতকালীন নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত রোগীর ভিড় বাড়ছে বরিশালের হাসপাতালে। পর্যাপ্ত জায়গা এবং শয্যা সংকটের কারণে হাসপাতালের মেঝেতেই চিকিৎসা নিতে হচ্ছে রোগীদের। সরেজমিন বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দেখা যায়, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মেডিসিন এবং চর্ম বহির্বিভাগে রোগীর দীর্ঘ লাইন পড়ে যাচ্ছে। এসব রোগীর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত। বহির্বিভাগের চিকিৎসকদের দাবি, মেডিসিন ও চর্ম বহির্বিভাগে প্রতিদিন গড়ে ৩০০ থেকে ৪০০ রোগী আসছেন। যাদের মধ্যে বেশিরভাগ শ্বাসকষ্ট, অ্যালার্জিং এবং চর্মরোগে আক্রান্ত। বৃদ্ধ এবং শিশু বয়সের রোগীরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে এসব রোগে। শুধু বহির্বিভাগেই নয়, হাসপাতালের মেডিসিন আন্তঃবিভাগেও শীতকালীন রোগে আক্রান্ত রোগীর চাপ বেড়েছে দ্বিগুণ। বিশেষ করে বয়স্ক শ্বাসকষ্টজনিত রোগীদের ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক ডা. রবীন্দ্র নাথ বলেন, মূলত আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে বিভিন্ন বয়সের মানুষ শীতকালীন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।
খুলনা ব্যুরো জানিয়েছে, খুলনায় শীতের প্রকোপে বাড়ছে ঠান্ডাজনিত রোগ। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্র জানায়, অক্টোবর থেকে ঠান্ডাজনিত কারণে রোগী আসছে। গত কয়েক দিন শীত বাড়ায় শিশু ওয়ার্ডে রোগীর চাপ বেশ বেড়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য মেডিসিন ওয়ার্ডেও বিশেষ করে নিউমোনিয়া, ব্রংকাইটিস, শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা, হাঁপানি, সর্দি-জ্বর ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে আসছেন হাসপাতালে। হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৫০০ বেডের বিপরীতে ১ হাজার ৬০০-এর বেশি রোগী ভর্তি। এ ছাড়া বহির্বিভাগে প্রতিদিন রোগী আসেন প্রায় ১ হাজার ৫০০। এ ছাড়া খুলনা জেনারেল হাসপাতালেও বহির্বিভাগে ঠান্ডাজনিত রোগী বাড়ছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের আরএমও ডা. মো. মুরাদ হাসান। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. সুমন রায় জানান, শীতের প্রকোপ বাড়ায় ঠান্ডাজনিত কারণে মানুষের রোগবালাইও বেড়েছে।