ঋণ অনিয়ম, আর্থিকভাবে বিশৃঙ্খলা, তারল্য সংকটসহ নানা কারণে প্রায় দুই বছর ধরে আলোচনায় দেশের ব্যাংক খাত। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০২২ সালের আগস্ট মাসে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, দুর্বল চিহ্নিত ১০টি ব্যাংককে বিশেষ নজরদারির মাধ্যমে আর্থিক অবস্থা উন্নত করা হবে। কিন্তু ওই বছরের শেষদিকে আরও কয়েকটি ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির বিষয়টি নজরে এলে এ তালিকায় যুক্ত হয় আরও ৪টি ব্যাংক। এরপর নতুন করে দুটি ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগও করা হয়েছে। বছর পার হলেও এসব ব্যাংকের আর্থিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়নি। তথ্য বলছে, ২০২২ সালে অধিক খেলাপি ঋণ, মূলধন সংকট, প্রভিশন ঘাটতি এবং আমানতের তুলনায় ঋণ বিতরণের সীমা লঙ্ঘন
করায় ১০টি ব্যাংককে দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এরপর নানা ঋণ কেলেঙ্কারির জন্য ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে এ তালিকায় আরও ৪ ব্যাংক যুক্ত হয়েছে। ঋণ অনিয়ম তদারকি করতে সরকারি-বেসরকারি এ ১৪ ব্যাংকে পর্যবেক্ষক ও সমন্বয়ক বসিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সময় এসব ব্যাংকের পর্ষদ সভায় তাদের নগদ প্রবাহ ও তারল্য পরিস্থিতি তুলে ধরতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। একই সঙ্গে কোনো ধরনের ঋণ অনুমোদন হলে তাও কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জানাতে বলা হয়েছে। ব্যাংকগুলোর আর্থিক পরিস্থিতির উন্নতির জন্য এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হলেও দু-একটি ব্যাংক ছাড়া গত এক বছরে এসব ব্যাংকের অবনতি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, বর্তমানে ছয় ব্যাংকের সমন্বয়ক ও আট ব্যাংকে পর্যবেক্ষক রয়েছেন। পর্যবেক্ষক ও সমন্বয়ক থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, রূপালী, অগ্রণী, বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকসহ ১৪টির বাইরেও বিদেশি ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের ঋণ শৃঙ্খলায় বড় ধরনের অনিয়ম থাকায় এ ব্যাংকটিকেও বিশেষ নজরে রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২ সালের ডিসেম্বরে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় ছিল বিদেশি ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান। ব্যাংকটির বিতরণকৃত মোট ঋণের ৯৭ দশমিক ৯২ শতাংশই খেলাপি ছিল। টাকার অঙ্কে যা ১ হাজার ৩৫৪ কোটি টাকা। সর্বশেষ সেপ্টেম্বরে খেলাপি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৮ দশমিক ১৮ শতাংশ। টাকার অঙ্কে যা ১ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা। আর মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪৩ কোটি ৪৫ লাখ টাকা।
সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে জনতা ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের ১৮ দশমিক ২৪ শতাংশই খেলাপি ছিল। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ১৪ হাজার ৩৮৬ কোটি টাকা। প্রভিশন ঘাটতি না দেখালেও ডেফারেল নেওয়া ছিল প্রায় সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা। মূলধন ঘাটতি ছিল ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। সর্বশেষ সেপ্টেম্বরে ব্যাংকটির খেলাপি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার কোটি টাকা। ডেফারেল কমাতে পারেনি ব্যাংকটি। এতে মূলধন ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৩০ কোটি টাকা।
২০২২ সালের ডিসেম্বরে আরেক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক সোনালীর খেলাপি ঋণ ছিল ১৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ। প্রভিশন ঘাটতি না দেখালেও প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার ডেফারেল সুবিধা নিয়েছিল। ২ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা মূলধন ঘাটতি রয়েছে ব্যাংকটির। আর গত সেপ্টেম্বরে সোনালীর খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ শতাংশ। তবে এই সময়ে মূলধন ঘাটতি পূরণ করতে পেরেছে সোনালী ব্যাংক।
২০২২ সালের ডিসেম্বরে রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৬ হাজার ৬৩০ কোটি, যা বিতরণকৃত মোট ঋণের ১৬ দশমিক ৫৬ শতাংশ। ব্যাংকটির ২ হাজার ৮১৪ কোটি টাকা প্রভিশন ঘাটতি এবং ২ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা মূলধন ঘাটতি ছিল। গত সেপ্টেম্বরে বেড়ে ২০ দশমিক ৭০ শতাংশ বা ৮ হাজার ৭২৮ কোটি টাকা, প্রভিশন ঘাটতি বেড়ে ৪ হাজার ১৯৮ কোটি টাকা এবং মূলধন ঘাটতি কিছুটা কমে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ১২২ কোটি টাকা।
২০২২ সালের ডিসেম্বরে অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ১৪ হাজার ৮১০ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত মোট ঋণের ২২ দশমিক ৩১ শতাংশ। ব্যাংকটির ৪ হাজার ৪২২ কোটি টাকার প্রভিশন ঘাটতি এবং ২ হাজার ৮৫১ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতি ছিল। গত সেপ্টেম্বরে খেলাপি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৮৭৪ কোটি টাকা, প্রভিশন ঘাটতি ৪ হাজার ৬০০ কোটি এবং মূলধন ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা।
’২২ সাল শেষে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের মোট ঋণের মধ্যে খেলাপি ছিল ৪২ দশমিক ৮১ শতাংশ। প্রভিশন ঘাটতি ছিল ৩৪৪ কোটি টাকা এবং ডেফারেল সুবিধা ছিল ৪০০ কোটি টাকা। গত সেপ্টেম্বরে খেলাপি বেড়ে দাঁড়িয়েছে মোট ঋণের ৬০ দশমিক ১০ শতাংশ, প্রভিশন ঘাটতি বেড়ে ৫৪২ কোটি এবং ডেফারেল দাঁড়িয়েছে ৪২৭ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক কালবেলাকে বলেন, ব্যাংকগুলোর কি ধরনের উন্নয়ন হয়েছে তা জানতে সময় লাগবে।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল আমিন কালবেলাকে বলেন, উন্নতি না হওয়ার কয়েকটি কারণ হতে পারে। যেমন, ওইসব ব্যাংকের শীর্ষ কর্তাদের দুর্বলতা, রাজনৈতিক বা প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপ, সঠিক কর্মপরিকল্পনা ঠিক না করা। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষক বা সমন্বয়কদের ভূমিকা কি ছিল তাও দেখা দরকার বলেও মনে করছেন তিনি।
অগ্রণী ব্যাংকের বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়োগকৃত পর্যবেক্ষক জাকির হোসেন কালবেলার কাছে কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি।