একটা সময় সুন্দরী কাঠ ও গোলপাতার সর্ববৃহৎ ভাসমান বাজার হিসেবে সুপরিচিত ছিল পিরোজপুরের নেছারাবাদ উপজেলার কয়েকটি চর। সন্ধ্যা নদী-তীরবর্তী উপকূলে জেগে ওঠা এসব চরে সে সময় চলত কাঠের রমরমা ব্যবসা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সুন্দরী কাঠের দুষ্প্রাপ্যতা এবং গোলপাতা ব্যবহার কমে যাওয়ায় পরিবর্তন এসেছে সে বাজারে। সুন্দরী ও গোলপাতার স্থান দখল করে নেয় দেশীয় কাঠ। নেছারাবাদ থানা-সংলগ্ন সন্ধ্যা নদীর শাখা, সরকারি পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সামনের খালের চর, ইন্দেরহাট খালের মোহনা, মিয়ারহাট বাজারের খাল ও বয়াসহ নানা স্থানে গড়ে ওঠা এ ভাসমান বাজার এখন দেশের সবচেয়ে বড় কাঠের বাজারে রূপ নিয়েছে। ব্যবসায়ী ও শ্রমিক মিলিয়ে ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ কর্মসংস্থানের উৎস হয়ে উঠেছে এটি।
আনুমানিক ১৯১৭ সালের প্রথম দিকে সুন্দরবনের সুন্দরী গাছকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলে কাঠ ব্যবসা শুরু হয়। ১৯১৮ সালের শেষদিকে নেছারাবাদের সন্ধ্যা নদীর তীরঘেঁষে একাধিক শাখা খালে গাছ বেচা-কেনার উদ্দেশ্যে ভাসমান কাঠের হাট গড়ে ওঠে। তবে সুন্দরী কাঠ বেচাকেনায় সরকারের নিষেধাজ্ঞার পর এ বাজারে স্থান পায় মেহগনি, চম্পল, রেইনট্রিসহ নানা দেশীয় কাঠ। প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা এখানে আসেন। ভাসমান এ বাজারের মোকাম থেকে কাঠ কিনে ট্রাক, লঞ্চ, কার্গোসহ বিভিন্ন পরিবহনে নিয়ে যান প্রতিষ্ঠানে। ব্যবসায়ীরা জানান, দেশের প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ এ ভাসমান হাট থেকে কাঠ কিনে নিজ নিজ অঞ্চলে মোকাম গড়ে তুলছেন।
জানা গেছে, দেশের সর্ববৃহৎ এ ভাসমান কাঠের বাজার থেকে কাঠ কিনতে দূর-দূরান্ত থেকে নদীপথে আসেন ব্যবসায়ীরা। জলদস্যুদের ভয়ে ২৫ থেকে ৩০টি নৌকার বহর বানিয়ে স্বরূপকাঠির মোকামে আসেন তারা। কাঠ বেচাকেনার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত একই সঙ্গে চলাফেরা, খাওয়া-দাওয়া ও গল্প-গুজব করেন। যে যার মতো বেচাকেনা শেষে, আবার একইভাবে চলে যান।
নেছারাবাদের কাঠ ব্যবসায়ী মতিউর রহমান মৃধা বলেন, একটি গাছ চূড়ান্তভাবে ব্যবহারের আগে ৫-৬ বার বেচাকেনা হয়। গাছ কাটা থেকে ব্যবহার পর্যন্ত এর সঙ্গে অন্তত ৮ ধরনের শ্রমিক যুক্ত থাকেন।
এদিকে দক্ষিণ অঞ্চলের তথা দেশের সবচেয়ে বড় কাঠের বাজার হলেও এখানে রয়েছে নানা প্রতিকূলতা। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, হাটে রাজনৈতিক প্রভাব, ব্যবসায়ীরা সহজ ও স্বল্প লভ্যাংশে ব্যাংকিং সুবিধা না পাওয়া, দালাল চক্রের উৎপাত, নদীপথে জলদস্যুদের আক্রমণসহ নানা কারণে শতবর্ষী এ ব্যবসা বিলীনের পথে। বিশেষ করে পরিবহন সংকট ও পাইকারি ক্রেতার অভাবে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। পরিবহন সংকটে গাছ বিক্রি বন্ধ থাকায় ঋণের বোঝা দিন দিন বেড়েই চলছে।
নেছারাবাদের কাঠ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি জানান, চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে ব্যবসা করতে খুব কষ্ট হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ব্যবসা ছেড়ে অন্য কোনো কাজে চলে যেতে হবে।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাহবুব উল্লাহ মজুমদার বলেন, নেছারাবাদের নানাবিধ ব্যবসা-বাণিজ্যের মধ্যে কাঠের ব্যবসা অন্যতম। ব্যবসার পরিধি বাড়ানো ও সরকারি সুযোগ-সুবিধাসহ ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তায় উপজেলা প্রশাসন সবসময় নজর রাখছে।
মন্তব্য করুন