রীতা ভৌমিক
প্রকাশ : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০২:৩৮ এএম
আপডেট : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৬:০৬ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বিস্মৃতির আড়ালে সর্বকনিষ্ঠ ভাষাশহীদ অহিউল্লাহ

স্মৃতি রক্ষায় নেই কোনো উদ্যোগ
শহীদ অহিউল্লা। ছবি: সংগৃহীত
শহীদ অহিউল্লা। ছবি: সংগৃহীত

১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। এর আগের দিন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে নিরস্ত্র ছাত্রদের ওপর গুলি চালিয়ে হত্যার প্রতিবাদে ঢাকা শহরজুড়ে চলছিল প্রতিবাদের ঝড়। দুপুরের দিকে নবাবপুর হয়ে সদরঘাটের দিকে যাচ্ছিল একটি মিছিল। বংশাল এলাকা পার হওয়ার সময় স্লোগান শুনে সেই মিছিলে ঢুকে পড়ে ১০-১১ বছরের অহিউল্লাহ। হঠাৎ করে পুলিশের গাড়ি থেকে গুলিবর্ষণ শুরু হয়। অহিউল্লাহর মাথা ভেদ করে বেরিয়ে যায় একটি গুলি। অহিউল্লার বুক পকেটে তখন এক টুকরা কাগজ ছিল, যাতে নিজ হাতে এঁকেছিল প্রজাপতির ছবি।

ভাষা আন্দোলনের সর্বকনিষ্ঠ শহীদ অহিউল্লার গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা এভাবেই বর্ণনা করছিলেন তার ছোট বোন জয়নব বিবি। পুরান ঢাকার বংশালের সুরিটোলা এলাকার বাড়িতে গত রোববার কথা হয় তার সঙ্গে। ১৯৫১ সালের সেই দিনে জয়নবের বয়স ছিল ৮-৯ বছর। নিজ চোখের দেখা খুব বেশি স্পষ্ট না হলেও বড়দের মুখ থেকে জেনেছিলেন ভাষা আন্দোলনের সেসব ঘটনা। তবে বয়সের ভারে এখন অনেক কিছুই আর মনে করতে পারেন না।

শুধু জয়নব বিবি কেন, ইতিহাসেই প্রায় বিস্মৃত নাম শহীদ অহিউল্লাহ। ভাষা আন্দোলনের আলোচনায় ঘুরেফিরে শহীদ সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউরদের নাম আলোচিত হলেও অহিউল্লাহ যেন ধীরে ধীরে আড়ালে চলে যাচ্ছেন। ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকলেও কেউ আর তাকে স্মরণ করেন না। অন্য শহীদদের কবর সংরক্ষণ করা হলেও অহিউল্লাহর কবরের চিহ্নও অবশিষ্ট নেই। নতুন প্রজন্মের কাছে তার নামটি পৌঁছে দিতে নেই কোনো রকম প্রচেষ্টা।

ভাষা আন্দোলনের অগ্নিঝরা সেই সময়ে পুরান ঢাকার সুরিটোলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়তেন অহিউল্লাহ। ভালোবাসতেন ছবি আঁকতে। অহিউল্লাহর বাবা হাবিবউল্লাহ ছিলেন রাজমিস্ত্রি। আর মা আমিনা বিবি ছিলেন গৃহিণী। ভাইবোনদের মধ্যে অহিউল্লাহ ছিলেন বড়। সুরিটোলা এলাকার বর্তমান ১৫৩/২ লুৎফর রহমান লেনে ছিল তাদের বাসা। রোববার সরেজমিন দেখা যায়, সুরিটোলা মসজিদের গলি দিয়ে ঢুকে বাম পাশে আলো-বাতাসহীন সরু গলিতে অহিউল্লাহদের সেই বাড়ি। গলির ভেতর একসঙ্গে একজনের বেশি মানুষ হাঁটতে কষ্ট হয়।

অহিউল্লাহর শহীদ হওয়ার ঘটনা স্বচক্ষে দেখেছেন এমন অনেকেই এখনো বেঁচে আছেন। এর মধ্যে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে আর ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায় সেই দিনের ঘটনা।

ভাষার দাবিতে ডাকা ছাত্র ধর্মঘট রুখতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেছিল পূর্ব পাকিস্তান সরকার। সেদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় সমবেত হয়েছিলেন ছাত্ররা। মায়ের ভাষার অধিকার রক্ষায় ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত নেন তারা। আন্দোলন দমাতে পুলিশ লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাসের শেল নিক্ষেপ ও গুলিবর্ষণ করে। এতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম এ ক্লাসের ছাত্র মোহাম্মদ সালাহউদ্দীন (২৬), আব্দুল জব্বার (৩০), আবুল বরকত (২৫) এবং বাদামতলী কমার্শিয়াল প্রেসের মালিকের ছেলে রফিকউদ্দীন আহমদ (২৭) মারা যান।

নিরস্ত্র ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলি চালানোর প্রতিবাদে ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় প্রতিবাদ মিছিল নিয়ে রাস্তায় নামেন ছাত্র-জনতা। দুপুরের দিকে গুলিস্তান থেকে একটি মিছিল বের হয়। নবাবপুর হয়ে সদরঘাট জগন্নাথ কলেজের দিকে মিছিলটি এগোতে থাকে। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানে মুখরিত সেই মিছিলে যোগ দেন অহিউল্লাহ। বংশালের মানসী সিনেমা হলের সামনে টহলরত পুলিশ মিছিল লক্ষ করে কাঁদানে গ্যাস ও গুলি ছোড়ে। মিছিলকারীরা যে যেদিকে পারে ছুটতে থাকেন। অহিউল্লাহও তখন বাড়ির দিকে ছুটছিলেন। সেই সময় পুলিশের ছোড়া একটি গুলি তার মাথায় আঘাত করে। খুলি ভেদ করে সেটি অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। সেখানেই তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।

জানা যায়, সরকারি অ্যাম্বুলেন্সে অহিউল্লাহকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। বাড়িতে সে খবর পৌঁছামাত্র তার বাবা হাবিবউল্লাহ স্বজনদের নিয়ে হাসপাতালে ছুটে যান। সন্তানের মরদেহ নিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। আজিমপুর পুরোনো কবরস্থানে তার লাশ কবর দেওয়া হয়।

১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে শহীদ অহিউল্লাহর নাম পাওয়া যায়। এ ছাড়া দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, ‘ছাত্ররা শোভাযাত্রা করে শহরের প্রধান রাস্তা নবাবপুর রোডে পৌঁছলে পুলিশ তাদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৮৫ জন আহত ব্যক্তি এবং মিটফোর্ড হাসপাতালে ৬০ জন আহতের চিকিৎসা করা হয়। গুরুতর আহত ৪৫ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন মারা গিয়েছে।’

তবে এই সংবাদে নিহতের নাম উল্লেখ করা হয়নি।

অহিউল্লাহদের বাড়ির উল্টো দিকে ১৩৮ নম্বর বাড়ি আব্দুর রশিদের। ভাষা আন্দোলনের সময় তিনিও খুব ছোট ছিলেন। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘সরু রাস্তার এপার ওপার বাড়ি হওয়ায় সেদিনের ঘটনা একটু একটু মনে আছে। নবাবপুরে ভাষাশহীদদের জন্য প্রতিবাদ মিছিলে শামিল হয়েছিলেন অহিউল্লাহ। পুলিশ গুলিস্তান থেকে মিছিলকারীদের ধাওয়া করেছিল। তাতে মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। অহিউল্লাহ বংশালের মানসী সিনেমা হলের সামনে দিয়ে সুরিটোলার নিজ বাড়ির দিকে ফিরছিলেন। মাথায় গুলি লাগলে তিনি সেখানেই নিহত হন।’

আব্দুর রশিদ আরও বলেন, ‘অহিউল্লার মৃত্যুর খবর বাড়িতে আসার পর স্বজনদের মধ্যে কান্নার রোল পড়ে যায়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে তার মরদেহ বাড়িতে আনা হয়েছিল। এলাকার লোকজন তার মরদেহ দেখতে ভিড় করেছিলেন। আজিমপুর পুরোনো কবরস্থানে তার লাশ কবর দেওয়া হয়েছিল।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেই কবরের অস্তিত্ব এখন আর নেই। সরকার তো নয়ই, স্বজনদেরও কেউ কবরটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়নি।

বোন জয়নব বিবি জানান, অহিউল্লাহর ছবি কিংবা অন্য কোনো স্মৃতি তাদের কাছে নেই। সরকারের পক্ষ থেকে কখনো তাদের সঙ্গে যোগাযোগও করা হয়নি।

মহান ভাষা আন্দোলনের অন্যতম শহীদের এই বোন আক্ষেপ করে বলেন, ‘সাংবাদিকরা মাঝেমধ্যে কথা বলতে আসেন। এতে আমাদের তো কোনো লাভ নেই। আর কেউ তো খোঁজ নেয় না।’

অহিউল্লাহর এক স্বজন আব্দুল্লাহ আল মামুন কালবেলাকে বলেন, ‘সর্বকনিষ্ঠ ভাষাশহীদ অহিউল্লাহ আমাদের এলাকার গর্ব। সরকারের কাছে তার নামে বংশালের মানসী সিনেমা হল থেকে সুরিটোলা লুৎফর রহমান লেন হয়ে সুরিটোলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সড়কটির নামকরণের দাবি করছি।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

কাঠগড়ায় মলিন মুখে চুপচাপ ছিলেন নুসরাত ফারিয়া

আবারও বড় পরাজয়ের মুখে মেসির মায়ামি

ফারিয়ার পাশে দাঁড়ালেন বাঁধন

নুসরাত ফারিয়া কারাগারে

ঝিনাইদহে সংঘর্ষে আহত ২ শতাধিক

আদালতে নুসরাত ফারিয়া

বদলে দেওয়া ইরাকি এক ‘নারীবাদীর’ গল্প

গৃহকর্মী মরিয়ম বিবিকে উদ্ধার করল পুলিশ

দিনাজপুরে ট্রাক-মাইক্রোবাস সংঘর্ষে নিহত ৪

খেলাধুলার উন্নয়নে সকল পদক্ষেপ নেওয়া হবে : তারেক রহমান

১০

বিশ্বে সবচেয়ে গরম এখন কোথায়?

১১

ভক্তদের অপেক্ষা করতে বললেন রাশমিকা

১২

ঢাকার বাতাস আজও ‘অস্বাস্থ্যকর’ 

১৩

শাবিপ্রবি শিক্ষককে হেনস্তা, সড়ক অবরোধ

১৪

একসঙ্গে চীন-পাকিস্তান-আফগানিস্তান, লক্ষ্য ভারত?

১৫

দুপুরের মধ্যে ঢাকাসহ ১৮ জেলায় ঝড়ের শঙ্কা

১৬

নড়াইলে বিএনপি নেতার গাড়িবহরে হামলা

১৭

এখন কী ভাবছে পাকিস্তান?

১৮

১৯ মে : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১৯

বুনিয়ান-উম-মারসুস / বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করল পাকিস্তান

২০
X