মিথ্যা ঘোষণার আড়ালে নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকা পণ্য রপ্তানি করতে গিয়ে ফেঁসে গেল রাজ-কামাল এভারবেস্ট করপোরেশন। টোস্ট বিস্কুট, লাচ্ছা সেমাই ও মুড়ি রপ্তানির ঘোষণা দিলেও এর পরিবর্তে কাটারিভোগ চাল বিদেশে পাঠাচ্ছিল প্রতিষ্ঠানটি। সরকারের আমদানি-রপ্তানি নীতি আদেশ অনুযায়ী সুগন্ধি চাল রপ্তানি নিষিদ্ধ। এ ছাড়া ওই চালানে পণ্যের ওজনের ক্ষেত্রেও মিথ্যা তথ্য দেয় রাজ-কামাল। এসব অনিয়ম সত্ত্বেও ঢাকার কমলাপুর আইসিডির কাস্টম হাউস তা ধরতে পারেনি। সব প্রক্রিয়া শেষ করে চট্টগ্রাম বন্দরে চলে যায় চালানটি। এর পরই এক পণ্যের ঘোষণা দিয়ে আরেক পণ্য রপ্তানির চেষ্টা ও ওজন জালিয়াতি ধরা পড়ায় জাহাজীকরণের (শিপমেন্ট) আগ মুহূর্তে আটকে দেয় শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর।
শুল্ক গোয়েন্দা সূত্র জানায়, দেশের খাদ্যপণ্যের অন্যতম রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান রাজ-কামাল এভারবেস্ট করপোরেশন টোস্ট বিস্কুটের ঘোষণা দিয়ে ৭ হাজার ৩৮০ কেজি সিদ্ধ কাটারিভোগ চাল রপ্তানির প্রক্রিয়া শেষ করে চট্টগ্রামে পাঠায়। লিওন ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে রপ্তানির প্রক্রিয়াও শেষ করে। কাস্টম হাউস আইসিডি কমলাপুর থেকে পাঠানো এই রপ্তানি চালান শিপমেন্টের আগে (ফোর্স কিপডাউন) আটক করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। এরপর গত সোমবার চালানটি বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে কায়িক পরীক্ষা করে শুল্ক গোয়েন্দা। এতে দেখা যায়, পণ্য চালানটির প্রায় অর্ধেকই কাটারিভোগ চাল, যা সরকারের আমদানি-নীতি আদেশ অনুযায়ী রপ্তানি করা নিষেধ। এর আগে ২৪ জানুয়ারি কাস্টম হাউস আইসিডি কমলাপুর থেকে পণ্য চালানটি পরীক্ষা শেষ করে শিপমেন্টের জন্য চট্টগ্রামে পাঠায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ ফখরুল আলম কালবেলাকে বলেন, ‘শুল্ক গোয়েন্দা অনিয়ম হলেই ব্যবস্থা নেবে। এই পণ্য চালানের ক্ষেত্রেও তাই হবে। অনিয়মের বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট কাস্টম হাউসকে চিঠি দেওয়া হবে। আর এ ক্ষেত্রে অর্থ পাচারের কোনো বিষয় থাকলে তা শুল্ক গোয়েন্দা অনুসন্ধান করবে।’
সূত্র জানায়, রাজ-কামালের রপ্তানি ঘোষণা অনুযায়ী ওই চালানে ১৬ ধরনের সর্বমোট ১৫ হাজার ৩৯১ কেজি পণ্য থাকার কথা। কিন্তু শুল্ক গোয়েন্দার পরীক্ষায় এ ক্ষেত্রে বড় রকমের গরমিল পাওয়া যায়। কাগজপত্রে ২ হাজার ৯৯৫ কেজি বেকার্স সুইট টোস্টের কথা উল্লেখ থাকলেও শুল্ক গোয়েন্দার পরীক্ষায় মাত্র ৩৬৭ কেজি টোস্ট পাওয়া যায়। আর স্পেশাল টোস্ট ৮৪০ কেজি ঘোষণা দিলেও কায়িক পরীক্ষায় পাওয়া গেছে ৩৩৬ কেজি। এ ছাড়া ২ হাজার ৮৮০ কেজি টি টোস্ট ঘোষণা দিলেও পরীক্ষায় পাওয়া গেছে ১ হাজার ১৯২ কেজি। আবার কাগজপত্রে শুধু টোস্ট রপ্তানির কথা বলা হলেও ওই চালানে ৭ হাজার ৩৮০ কেজি কাটারিভোগ চাল পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে পণ্যের পরিমাণ ছিল ১৬ হাজার ১০৯ কেজি। ঢাকা কাস্টমসের শুল্ক কর্মকর্তা চালানটি পরীক্ষা করে শিপমেন্টের জন্য পাঠালেও তার প্রতিবেদনে এসব তথ্য উল্লেখ করেননি।
জানতে চাইলে কমলাপুর কাস্টম হাউসের অতিরিক্ত কমিশনার প্রমীলা সরকার কালবেলাকে বলেন, ‘রাজ-কামালের পণ্য চালানটি পরীক্ষা করা হয়েছিল। তবে পরীক্ষণ প্রতিবেদনে কোনো গরমিলের তথ্য ছিল না। কাস্টম হাউসের ৫ শতাংশ চালান পরীক্ষণ করা যায়।’
চালানটির পরীক্ষণে কোনো কর্মকর্তার অবহেলা রয়েছে কি না—জানতে চাইলে এই অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, ‘রপ্তানির ক্ষেত্রে সাধারণত সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ও রাজস্ব কর্মকর্তা পর্যায়ে নিষ্পত্তি হয়ে যায়। যার কারণে বিষয়টি আর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে আসে না।’
জানা গেছে, ১৯৯৬ সাল থেকে রাজ-কামাল এভারবেস্ট করপোরেশন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে খাবার পণ্য রপ্তানি করে আসছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া ও উত্তর আমেরিকায় চাল, তেল ও শুকনা খাবার রপ্তানি করে আসছে। সরকারেরর আমদানি নীতি আদেশে সুগন্ধি চাল রপ্তানি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নিষিদ্ধ সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠানটি সুগন্ধি চাল রপ্তানি করে আসছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে নানাভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করেও রাজ-কামাল করপোরেশনের দায়িত্বশীল কারও সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
রাজ-কামাল ফুডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মোস্তফা কামালের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘রাজ-কামাল ফুড ও করপোরেশনের ব্যবসায়িক কার্যক্রম সম্পূর্ণ আলাদা। রাজ-কামাল এভারবেস্ট করপোরেশনের দায়িত্বে আছেন হাসান সজিব। তিনি বর্তমানে বিদেশে রয়েছেন।’