ভয়ংকর রূপ নিয়েছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি। প্রতিদিনই ডেঙ্গু আক্রান্তে রেকর্ড হচ্ছে। রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এমন পরিস্থিতিতে ডেঙ্গু থেকে রক্ষা পেতে মশানিরোধক পণ্য কিনতে দোকানগুলোয় ছুটছেন সব শ্রেণির মানুষ। তাই চাহিদা বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। সেইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মশা মারার স্প্রে, কয়েল, বৈদ্যুতিক ব্যাট ও মশারির দাম। অনৈতিক মুনাফা তুলতে অনেকেই ইচ্ছামতো বাড়তি দাম নিচ্ছেন বলে ক্রেতারা অভিযোগ করেছেন। মশা নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনের ব্যর্থতায় নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন নগরবাসী। আত্মরক্ষায় নিজেরাই নানা সামগ্রীর ব্যবহার বাড়িয়েছেন। মশারি, কয়েলের মতো পুরোনো কৌশল ছাড়াও মশানিরোধক ক্রিম, স্প্রে, অ্যারোসল, মশা মারার ব্যাট, ভ্যাপোরাইজিং মেশিন এবং বিভিন্ন ধরনের লোশন কিনতে মানুষ ভিড় করছেন ফার্মেসি, সুপারশপ ও জেনারেল স্টোরগুলোয়।
মগবাজারের বাসিন্দা তানজিলা খানম বলেন, আগে শুধু রাতে ঘুমানোর আগে মশার কয়েল জ্বালিয়ে ঘুমাতাম। ডেঙ্গুর কারণে এখন দিনের বেলায়ও কয়েল জ্বালিয়ে রাখি। মাসে এখন ৫-৬ প্যাকেট কয়েল লাগছে। মশার জন্য প্রতি মাসে অন্তত ১ হাজার ৫০০ টাকা বাজেট রেখেছেন মিরপুরের বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ২০১৯ সালের পর এবার নাকি পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। আমার নিজের একবার, দুই সন্তানের একজনের দুবার ডেঙ্গু হয়েছে। ছেলেকে শিশু হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা নিতে হয়েছিল। এবার নিজের ঘর পরিষ্কার রাখা ছাড়াও অডোমাস লোশন ক্রিম, হিট অ্যারোসল মশকিউটে স্প্রে, চার্জেবল ব্যাট কিনেছি ১ হাজার ৪০০ টাকার। এ ছাড়া কয়েল তো আছেই।
দোকানিরা জানান, এখন কেউ মশারি বা কয়েল ছাড়া থাকতে চাইছেন না। বাসা বা অফিসে মশা থাক বা না থাক, সবাই আতঙ্কগ্রস্ত। শিশুসন্তান নিয়ে পরিবারগুলো বেশি সতর্ক। যেসব এলাকা স্যাঁতসেঁতে এবং নিম্ন আয়ের মানুষ বাস করে, সেখানে কয়েলের চাহিদা তুলনামূলক বেশি। যারা একটু ভালো পরিবেশে থাকে, তারা মশা মারার স্প্রে ও বৈদ্যুতিক কয়েলে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। বাজারে চালু বৈদ্যুতিক ব্যাটও মশা মারার উপকরণ হিসেবে বেশ জনপ্রিয়।
গতকাল সরেজমিন রাজধানীর চকবাজার, নিউমার্কেট, গুলিস্তান এলাকার একাধিক বাজার ঘুরে দেখা যায়, আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় অতিরিক্ত মূল্যে বিক্রি হচ্ছে মশারি, কয়েল, অ্যারোসলসহ নানা কোম্পানির মশা তাড়ানোর স্প্রে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাহিদা মশারির। তিন ফুট বাই ছয় ফুট সিঙ্গেল মশারির পাইকারি মূল্য ২০০ থেকে ২৫০ টাকা; পাঁচ ফুট বাই ছয় ফুট ডাবল মশারি পাইকারিতে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা এবং ম্যাজিক মশারির দাম ৩০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত। এ ছাড়া মানভেদে শিশুদের ফোল্ডিং মশারির পাইকারি দাম ৩০০ থেকে শুরু করে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত। এসব মশারিই বাজারে খুচরা বিক্রি হচ্ছে পাইকারির প্রায় দ্বিগুণ দামে। নিরুপায় হয়ে বেশি দামেই এসব পণ্য কিনতে হচ্ছে। এদিকে পাইকারি বিক্রেতাদের দাবি, মানুষের আতঙ্ক, প্রয়োজন আর চাহিদার সুযোগ নিচ্ছেন এলাকার খুচরা বিক্রেতা ও দোকানিরা।
গুলিস্তানের মশারি বিক্রেতা খাদেমুল ইসলাম বলেন, আগে প্রতিদিন ৩ থেকে ৪ হাজার টাকার পণ্য বিক্রি করতাম। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এখন প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ হাজার টাকার মশারি বিক্রি করছি।
এক ক্রেতা জানান, বাজারে ক্রেতা বাড়ায় একদামে মশারি বিক্রি করছেন বিক্রেতারা। যে মশারি কিছুদিন আগে বা গত বছর ২০০ টাকা ছিল, এখন সেটার একদাম ৪০০ টাকা।
বাজারে দেশি-বিদেশি অর্ধশতাধিক ব্র্যান্ড ও নন-ব্র্যান্ডের মশার কয়েল পাওয়া যায়। পাইকারি বাজারে এসব কয়েলের দাম ৪০ থেকে ৮০ টাকা এবং খুচরা বাজারে প্রতি প্যাকেট বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত। খুচরা বিক্রেতারা এখন ক্রেতাদের কাছ থেকে মশার কয়েল ও স্প্রের দাম ১০ থেকে ৩০ টাকা বেশি রাখছেন। নিউমার্কেটের এক ক্রেতা জানালেন, তিনি দুই প্যাকেট কয়েল কিনেছেন ২৪০ টাকায়। এগুলোর প্রতিটির গায়ে মূল্য লেখা ২০০ টাকা করে। পণ্যের গায়ের দামের চেয়েও কমমূল্যে পণ্য কিনছি, তবু ঠকছি।
২৫০ গ্রাম থেকে শুরু করে ৮০০ গ্রাম পর্যন্ত মসকিটো স্প্রে বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত। ৫০ গ্রাম থেকে শুরু করে ২৫০ গ্রাম পর্যন্ত বিভিন্ন কোম্পানির মসকিটো ক্রিম বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা পর্যন্ত। কিছুদিন আগেও এসব পণ্যের দাম অনেক কম ছিল।
গুলিস্তান স্টেডিয়াম মার্কেটে বিক্রি হচ্ছে র্যাকেট বা কিলার ব্যাট, মসকিটো বেস্ট কিলার, মসকিটো বাল্ব, মসকিটো ভ্যাপ্রোজারসহ নানা ইলেকট্রনিক পণ্য। গত বছরের তুলনায় আমদানি করা এসব ইলেকট্রনিকস পণ্যের দামও বেড়েছে বেশ। সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া র্যাকেট বা কিলার ব্যাট ৩৫০ টাকা থেকে বেড়ে ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কিছু দেশি প্রতিষ্ঠান আমদানি পণ্য নিজেদের মোড়কে দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছে। দাম বাড়ার কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা ডলার ও এলসি সংকটের কারণকে দায়ী করছেন।
দোকান মালিক হাসিবুর রহমান বলেন, দেশে ডলার সংকটের কারণে মশা বাড়ার এ মৌসুমকে সামনে রেখে আমরা কোনো এলসি খুলতে পারিনি। যেসব আমদানিকারক কিছু পণ্য এনেছেন, তারাও অতিরিক্ত মূল্যে আমাদের সাপ্লাই দিচ্ছেন।
মিরপুরে স্বপ্ন সুপারশপের বিক্রয় কর্মী জানান, গত সপ্তাহে মশা নিরোধক কোনো পণ্য ছিল না। তবে বিপুলসংখ্যক ক্রেতার চাহিদার কারণে অ্যারোসল স্প্রে আনা হয়েছে, রয়েছে অটোমোস ক্রিম। এ ছাড়া কয়েল ও চার্জেবল ব্যাট বিক্রি বেড়েছে।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) তৌহিদুজ্জামান বলেন, আগের তুলনায় এবার মশা মারার র্যাকেট বিক্রি প্রায় তিনগুণ বেড়েছে। প্রতিটি র্যাকেটের দাম ৫০০ থেকে ৫২০ টাকার মধ্যে। গ্রামাঞ্চলে মশার কয়েলের চাহিদা বেড়েছে প্রায় ১০ শতাংশ।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ জব্বর মণ্ডল বলেন, মশা মারার যেসব সরঞ্জাম বাজারে আছে, তার দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রতিবছরই অভিযান পরিচালনা করা হয়। এবারও আমরা অভিযান পরিচালনা করব। যারা অসাধু ব্যবসায়ী আছে, তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসব।
মন্তব্য করুন