সহযোগী অধ্যাপক হওয়ার যোগ্যতাও যার ছিল না, তিনি ভুয়া তথ্য এবং জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে হয়ে গেছেন অধ্যাপক। শুধু অধ্যাপক হয়েই থামেননি, পরবর্তী সময়ে প্রেষণে একটি প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্বও পেয়েছেন। তিনি হলেন যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের ইমপ্যাক্ট তৃতীয় পর্যায়ের বর্তমান প্রকল্প পরিচালক ড. এস এম আলগীর কবীর। নামের আগে ডক্টর লিখলেও তার পিএইচডি ডিগ্রি ভুয়া।
জানা গেছে, আলগীর কবীর ২০০৬ সালের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের ১০ শতাংশ সরাসরি কোটায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক পদে নিয়োগ পান। পরে পদোন্নতির মাধ্যমে হয়েছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক। এরপর প্রেষণে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের প্রকল্প পরিচালক পদে নিয়োগ পান। বর্তমানে তিনি এই পদে রয়েছেন।
জানা গেছে, আলমগীর কবীর সহযোগী অধ্যাপক পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন ভুয়া তথ্য জালিয়াতির মাধ্যমে। ওই পদে নিয়োগের আবেদনে যে প্রতিষ্ঠান থেকে পিএইচডি ডিগ্রির অর্জন করেছেন বলে তথ্য দিয়েছেন—সেটা ভুয়া। যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন, সেই নামে রেজিস্টার্ড কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। সহযোগী অধ্যাপক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে যে শিক্ষাগত যোগ্যতা লাগে, সেখানেও ভুয়া তথ্য দিয়েছিলেন। অর্থাৎ ওই পদে নিয়োগের জন্য আবেদনের সঙ্গে তিনি যেসব তথ্য দিয়েছেন, তার সবই ছিল মিথ্যা, ভুয়া এবং জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি।
জানা গেছে, ভুয়া তথ্য দিয়ে অধ্যাপক হওয়ার অভিযোগ তদন্তে ২০২২ সালে অনুসন্ধানে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন ( দুদক )। অনুসন্ধানে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় এবং জাল-জালিয়াতি ও প্রতারণার আশ্রয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করায় তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। গতকাল বৃহস্পতিবার মামলাটি করেন দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক সাইদুল ইসলাম।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি সরকারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রিয়াজ রহমানের এপিএস আলমগীর কবির শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা। একসময় পেশায় শিক্ষক থাকলেও শিক্ষকতা ছেড়ে লাভজনক পদে পদায়িত হন। ভুয়া অধ্যাপক হওয়ার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তার জনবল নিয়োগে আর্থিক লেনদেনসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে।
মামলার বিষয়ে জানতে আলমগীর কবিরের অফিসিয়াল ফোন নম্বরে কল দিলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। পরে তার মোবাইল ফোন নম্বরে বারবার ফোন দিলে তিনি রিসিভি করেননি। এমনকি মামলার বিষয় উল্লেখ করে মন্তব্য চেয়ে মেসেজ দিলেও কোনো সাড়া দেননি।
দুদকের মামলার এজহারে বলা হয়েছে, বিভিন্ন মিথ্যা তথ্য এবং জাল-জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে এবং সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষা ক্যাডারের ১০ শতাংশ সরাসরি কোটায় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন আলমগীর কবির, যা ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।
ঘটনার বিবরণে বলা হয়েছে, ২০০৬ সালে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের ১০ শতাংশ সরাসরি কোটায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক পদে জনবল নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। বিজ্ঞপ্তিতে শিক্ষাগত যোগ্যতা হিসেবে ডক্টরেট ডিগ্রিসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দ্বিতীয় শ্রেণির স্নাতকোত্তর ডিগ্রি বা দ্বিতীয় শ্রেণির সম্মান ডিগ্রি এবং কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ন্যূনতম আট বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করা হয়।
আলগীর কবীর সরাসরি কোটায় সহযোগী অধ্যাপক পদে ২০০৬ সালের ২৫ মে পিএসসি বরাবর আবেদন করেন। আবেদনের সঙ্গে মালয়েশিয়ার ক্যামডেন বিশ্ববিদ্যালয় (ইউএসএ) নামের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে পিএইচডি ডিগ্রি গ্রহণের সনদপত্রের কপি জমা দেন। কিন্তু দুদকের অনুসন্ধানে উঠে আসে, ক্যামডেন বিশ্ববিদ্যালয় নামে মালয়েশিয়া কোনো রেজিস্টার্ড শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। অর্থাৎ আসামির পিএইচডি ডিগ্রি সনদ জাল এবং ভুয়া।
এ ছাড়া সহযোগী অধ্যাপক পদে চাকরির আবেদনের জন্য ন্যূনতম আট বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতার বলা হলেও এখানেও তিনি জালিয়াতি করেন। ২ বছর ৩ মাস ১১ দিনের ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও তিনি প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে আট বছরের অভিজ্ঞতার সনদ দেখান। সনদ পর্যালোচনায় দেখা যায়, সেটি বিজ্ঞপ্তির শর্ত অনুযায়ী যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সংগৃহীত নয় এবং সনদে যেসব শর্তাবলি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী যুক্ত থাকা আবশ্যক ছিল, তারও উল্লেখ নেই।
মামলায় আরও বলা হয়েছে, আসামি প্রভাষক পদ থেকে প্রেষণে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর এপিএস এবং তৃতীয় সচিব হিসেবে মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশনে কর্মরত থাকা অবস্থায় সরকারি কর্মচারী হয়ে জাল ও ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রির সনদ তৈরি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে অভিজ্ঞতার দুই বছরেরও বেশি ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে উল্লিখিত শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা দেখিয়ে মিথ্যা সনদ আবেদনের সঙ্গে জমা দেন।
এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ভুয়া সনদ এবং তথ্য দিয়ে নিয়োগ পাওয়া অবশ্যই প্রতারণা। দুদকের অনুসন্ধানে এটা প্রমাণিত হলে এ ধরনের ঘটনায় মামলা হওয়াটাই প্রত্যাশিত। দোষী প্রমাণিত হলে অবশ্যই বিচারের আওতায় আনা উচিত। এর সঙ্গে কোনো সংশ্লিষ্ট মহলের যোগসাজশ থাকলে তাদেরও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।