৩৫০ টাকার একেকটি কোদাল কেনা হয়েছে ২ হাজার টাকায়। ৩১৩ টাকার বালতির মূল্য ধরা হয়েছে ১ হাজার ৯০০ টাকা। ২০০ টাকার তালা ৫ হাজার ৬০০ টাকা। একটি প্লাস্টিকের প্যাডেলযুক্ত ময়লা ফেলার ঝুড়ি (ডাস্টবিন) কেনা হয়েছে ১৩ হাজার টাকায়। অথচ এই ডাস্টবিন একেকটির দর ধরা হয়েছিল ৩৩৮ টাকা। একইভাবে ৪৮৬ টাকার প্রতিটি হ্যাকসো ফ্রেম (ধাতু কাটার করাত) কেনা হয় ৩ হাজার ৪৫০ টাকায়। প্রতিটি স্লাই রেঞ্জ কেনার কথা ৮৭৮ টাকায়। কেনা হয়েছে ৪ হাজার ৪৫০ টাকায়। ১ হাজার ৬৫০ টাকার পর্দা অতিরিক্ত ১৮ হাজার টাকা দিয়ে কেনা হয়। পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়েতে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের কেনাকাটার চিত্র এটি। সরকারের মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রণ কার্যালয় (সিএজি) তদন্ত প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে আসে।
সরকারি কেনাকাটায় এ ধরনের অস্বাভাবিক দাম দেখানোর ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর রেলপথ মন্ত্রণালয়ে তোলপাড় চলছে। এই অনিয়মের বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তবে সিএজি তদন্তে অভিযুক্ত কর্মকর্তারা শাস্তি না পেয়েই অবসরে চলে গেছেন। অনেকেই মারা গেছেন। একজন দেশের বাইরে আছেন বলে জানা গেছে।
এর আগে ঘটনা তদন্তে রেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে একজন অতিরিক্ত সচিবকে প্রধান করে আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সেই তদন্ত রিপোর্টে দেখা গেছে, ৩ কোটি টাকার কেনাকাটায় পদে পদে অনিয়ম হয়েছে। এই অপকর্মের জন্য দুজন কর্মকর্তাকে দায়ী করা হলেও ওপরের কারও নাম আসেনি। সিএজি ও রেলের তদন্তে এ ঘটনায় ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিদের দায়ী করা হয়েছে।
রাজশাহী রেলের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, মন্ত্রণালয়ের তদন্তে পশ্চিমাঞ্চলের চিফ কমার্শিয়াল ম্যানেজার শাহনেওয়াজকে দায়ী করার পর তার সব প্রমোশন বাতিল করে পঞ্চম গ্রেডে নামিয়ে আনা হয়েছে। তিন বছর ধরে তিনি বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) আছেন। এই অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত আরেকজন হলেন সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক বেলাল সরকার। তদন্তে সুপারিশের ভিত্তিতে তিনি যে স্কেলে চাকরিতে প্রবেশ করেছিলেন সেই স্কেলে নামিয়ে আনা হয়েছে। বর্তমানে তিনি বরখাস্ত আছেন। রেল কর্মকর্তাদের দাবি, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা হয়েছে।
জানা গেছে, রেলের তদন্তে টাকা উদ্ধারের কোনো সুপারিশ করা হয়নি। তবে ডিলারের টাকা আটকে দেওয়া হয়েছে। পুরো অর্থ উদ্ধারে রেল মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আরেকটি কমিটির প্রয়োজনে রয়েছে বলে মত দিয়েছেন রাজশাহী রেলের কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, অডিট যেভাবে হয়, সেভাবে অনিয়ম দুর্নীতি হয় না। অডিটে মূলত প্রকল্পের সব অর্থ নষ্টের কথা বলার চেষ্টা হয়। কিন্তু অনিয়ম হলেও কিছু জিনিসপত্র তো রয়েছে। সেগুলোর অর্থমূল্য আছে। এসব বিষয় বিবেচনায় নেওয়া উচিত।
রেলের পশ্চিমাঞ্চল বলতে রাজশাহী অঞ্চলকে বোঝায়। এখানে কেনাকাটায় অনিয়মের অভিযোগ নতুন নয়। এর আগে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের হাসপাতালগুলোতে কেনাকাটা খাতে ৭ কোটি ২০ লাখ টাকার অনিয়মের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে ২০২৩ সালের ১৫ জানুয়ারি রেলভবনে অভিযান চালায় দুদক। সেই সময় বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ নথি নিয়ে যান দুদক কর্মকর্তারা। রেলওয়ে ও দুদক কর্মকর্তারা বলছেন, কয়েকটি প্যাকেজে কাল্পনিক দাম দেখিয়ে এ রকম অনেক সুরক্ষাপণ্য ক্রয়ের নামে আর্থিক অনিয়ম হয়েছে। ঠিকাদার ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যোগসাজশে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। এই অপকর্মে জড়িতদের সবাই অবসরে গেছেন।
জানা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের মধ্যে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন মজিবুর রহমান, লুৎফর রহমান ও খন্দকার শহিদুল ইসলাম। তাদের সময়েই বিভিন্ন দপ্তরে এসব অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। তারা সবাই এখন অবসরে। তাদের মধ্যে মজিবুর রহমান মারা গেছেন। লুৎফর রহমান গুরুতর অসুস্থ এবং খন্দকার শহিদুল ইসলাম কানাডায়। এ কারণে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। সিএজি প্রতিবেদনে এ ঘটনায় মূলত তাদের দায়ী করা হয়েছে।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের ২০১৮-১৯ অর্থবছরের কেনাকাটায় এ অনিয়ম ও দুর্নীতির অডিট প্রতিবেদন এরই মধ্যে রাষ্ট্রপতির কাছে দাখিল করা হয়েছে। প্রতিবেদনে সরকারের আর্থিক ক্ষতির জন্য দায়দায়িত্ব নির্ধারণ করে ক্ষতির টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমার সুপারিশ করা হয়েছে।
নথি বলছে, রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় (রাজশাহী) কীটনাশক, হারপিক, ব্লিচিং পাউডার, কোদাল, বেলচাসহ অন্তত ৫০ ধরনের মালপত্র কিনেছে ২ থেকে ৫ গুণ বেশি দামে। এসব কেনাকাটায় ২ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। সিএজির প্রতিবেদন বলছে, ওই সব মালপত্রের বাজারমূল্য ৮৮ লাখ টাকা।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব মালপত্র কেনার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কার্যালয় সিএজিকে যে জবাব দিয়েছে, তা সন্তোষজনক নয়। এ কারণে বাজারদর অপেক্ষা বেশি দামে কেনার দায় নির্ধারণ করার সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি অতিরিক্ত খরচ করা অর্থ আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
রেলের পশ্চিমাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক অসীম কুমার তালুকদার কালবেলাকে বলেন, ‘ওই সময়ের মধ্যে পশ্চিমাঞ্চল রেলের মহাব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের কেউই চাকরিতে নেই; অবসরে চলে গেছেন। একজন অবসর নিয়েই কানাডায় চলে গেছেন।’
প্রতিবেদনে দেখা যায়, রেলের পশ্চিমাঞ্চল সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রকের দপ্তরের অধীনে ৮৮ লাখ ১১ হাজার টাকা মূল্যের মালপত্র কেনা হয়েছে ২ কেটি টাকায়। এই প্যাকেজে ১ কোটি ১১ লাখ ৮৮ হাজার টাকা লোপাট হয়েছে। নথি বলছে, ৪৩৮ টাকার বেলচা ১ হাজার ৫৩৮ টাকায়, ৩৫০ টাকার কোদাল ১ হাজার ৯৯৪ টাকায়, ৭৫ টাকার নিড়ানি ৬৯০ টাকায়, ৭৫ টাকার ল্যাট্রিন ব্রাশ ১৪৮ টাকায়, ৩১৩ টাকার বালতি ১ হাজার ৮৯৩ টাকায় এবং ৫৮ টাকা কেজি দরের ব্লিচিং পাউডার ২৭৪ টাকায়, ২০ টাকার বল সাবান ২৮৯ টাকায় এবং ৮১ টাকা লিটারের ডি-অয়েল ২৭৪ টাকায় কেনা হয়েছে। অতিরিক্ত দর দেখিয়ে কেনা হয়েছে এলইডি ইলেকট্রিক চার্জেবল সিগন্যাল লাইট ও ফ্ল্যাশ। এই সরঞ্জামের দাম ৫২৫ টাকা। কিন্তু কেনা হয়েছে ১ হাজার ৯৪৯ টাকা দরে।
গত বৃহস্পতিবার কেনাকাটায় অনিয়মের অভিযোগে রাজশাহী রেল ভবনে (পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের সদর দপ্তর) অভিযান চালানো হয়েছে। এই অভিযানে নেতৃত্ব দেন দুদক রাজশাহী জেলা সমন্বিত কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আমির হোসাইন। তার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি দল এই অভিযান পরিচালনা করেন।
দুদক রাজশাহী জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আমির হোসাইন জানান, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের বিভিন্ন মালপত্র কেনাকাটায় অসংগতির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অভিযান চালানো হয়েছে। এখান থেকে সংশ্লিষ্ট কিছু নথিপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে। আরও কিছু নথিপত্র তলব করা হয়েছে। হাতে পেলে সব রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করা হবে। এরপর কমিশনে অবহিত করা হবে।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) অসিম কুমার তালুকদার জানান, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের কেনাকাটা সংক্রান্ত বিষয়ে কার্যালয়ে দুদক কর্মকর্তা এসেছিলেন। তারা যেসব নথিপত্র দেখতে চেয়েছেন, সেগুলো দেখানো হয়েছে এবং দেওয়া হয়েছে। আরও কিছু নথি রেলওয়ের পক্ষ থেকে সরবরাহ করা হবে।