সারা বিশ্বে শিশুমৃত্যুর হার কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশে নবজাতক, এক বছরের কম বয়সী এবং পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর হার বেড়েছে। এজন্য সেপসিস, মেনিনজাইটিস, নিউমোনিয়াসহ নানা সংক্রমণের কারণে অকালজন্ম এবং অন্তঃসত্ত্বা জটিলতাকে দায়ী করা হচ্ছে। সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) গত পাঁচ বছরের হিসেবে এমন চিত্র উঠে এসেছে। এদিকে বাংলাদেশ হেলথ সার্ভের তথ্যমতে, নবজাতক মৃত্যুর এক-চতুর্থাংশ ঘটে জন্মকালীন শ্বাসরোধে। প্রায় সমান মৃত্যুর কারণ সেপসিস বা জীবাণুর বিষক্রিয়া জনিত পচন, নিউমোনিয়া বা অন্য কোনো সংক্রমণ। ১৭ শতাংশ মৃত্যু ঘটছে অপরিণত জন্ম এবং জন্মের সময় কম ওজন হওয়ার কারণে।
চিকিৎসক ও জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুমৃত্যুর হার বৃদ্ধি জন্য সমন্বিত স্বাস্থ্য সেবায় পিছিয়ে থাকা একটি বড় কারণ। দেশে এখনো সবার জন্য মানসম্মত প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, গর্ভকালীন ও প্রসবকালীন সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন, ওষুধ প্রতিরোধী নানা ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ, বায়ু দুষণ ও প্রাতিষ্ঠানিক সন্তান জন্মদান সন্তোষজনক পর্যায়ে উন্নতি করতে না পারা অন্যতম কারণ।
বিবিএসের বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস প্রতিবেদন-২০২৩ এ বলা হয়েছে, শিশুর মৃত্যু বেড়ে যাওয়ার অর্থ—দেশে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, গর্ভকালীন সেবা, প্রসবকালীন সেবা ও প্রসবোত্তর সেবা কার্যক্রম ঠিকভাবে চলছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) মতে, গর্ভকালে অন্তত আটবার প্রসব-পূর্ব সেবা নিতে হবে। কিন্তু দেশের ৬০ শতাংশ অন্তঃসত্ত্বা চারবারও প্রসব-পূর্ব সেবা পান না। দেশে এখনো ৩৩ শতাংশ সন্তানের জন্ম হয় বাসাবাড়িতে।
২০২২ সালে দেশে এক বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যু হার ছিল হাজারে ২৫ জন, যা ২০২৩ সালে বেড়ে হয়েছে ২৭। পাঁচ বছর আগে এই সংখ্যা ছিল ২১। এক মাসের কম বয়সী নবজাতকের মৃত্যুর হারও বেড়ে গেছে। প্রতি এক হাজার নবজাতকের মধ্যে মারা যাচ্ছে ২০ জন। ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৬। পাঁচ বছর আগে ছিল ১৫। এ ছাড়া পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ৩৩ জন। ২০২২ সালে ছিল ৩১ জন। পাঁচ বছর আগে ছিল ২৮ জন।
দেশে পুরুষের গড় আয়ু এখন ৭০ দশমিক ৮ বছর। নারীর গড় আয়ু হয়েছে ৭৩ দশমিক ৮ বছর। শিশু মৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়ায় মানুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ুও কমেছে। প্রত্যাশিত গড় আয়ু হলো, ২০২৩ সালে জন্মগ্রহণকারী শিশুরা গড়ে ৭২ দশমিক ৩ বছর আয়ু পেতে পারে। গত বছর দেশে মানুষের গড় আয়ু ছিল ৭২ দশমিক ৩ বছর। আগের বছর ছিল ৭২ দশমিক ৪। গড় আয়ু যে কোনো দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য সূচক। স্বাধীনতার বছর দেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৪৬ বছর।
দেশে শিশুমৃত্যুর হার কেন বাড়ছে আর এই সমস্যা মোকাবিলায় করণীয় বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের পেডিয়াট্রিক রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. কামরুজ্জামান কামরুল কালবেলাকে বলেন, নানা ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ, বায়ুদূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে শিশুরা শ্বাসকষ্ট ও নিউমোনিয়ার মতো রোগে আক্রান্ত হয়। তাই শিশুদের ব্যাপারে নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। টিকার ডোজগুলো দিতে হবে। এর বাইরেও নিউমোনিয়া থেকে সুরক্ষিত থাকতে বেশ কিছু টিকা রয়েছে, সেগুলো দিতে হবে। মা ও শিশুর সুষম খাবার নিশ্চিত করতে হবে। নবজাতককে ছয় মাস পর্যন্ত শুধু মায়ের বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। এরপর বুকের দুধের পাশাপাশি পুষ্টিকর খাবারও খাওয়াতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ মানুষ সামান্য জ্বর-ঠান্ডা, কাশির সমস্যা হলে ফার্মেসি থেকে উচ্চ ক্ষমতার অ্যান্টিবায়োটিক সংগ্রহ করে খায়। এতে সব বয়সীদের মধ্যে অ্যান্টিবায়েটিক রেজিস্ট্যান্স তৈরি হচ্ছে। মানুষের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। শিশুদের ওপর এর প্রভাব পড়ছে সবচেয়ে বেশি। এ কারণে শিশুমৃত্যুর হারও বেড়ে যেতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বলেন, সেপসিস, মেনিনজাইটিস এবং নিউমোনিয়ার কারণে অকাল জন্ম এবং অন্তঃসত্ত্বা জটিলতা দেখা দেয়। এতে নবজাতকের বেশি মৃত্যু হয়। এই মৃত্যু প্রতিরোধে স্বাস্থ্য সেবার মান বাড়াতে হবে। এখনো দেশের অনেক শিশুর জন্ম হয় বাড়িতে অদক্ষ ধাত্রীর মাধ্যমে। সেখানে প্রসূতি ও নবজাতকের জটিলতা তৈরি হলে শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যায়। এজন্য প্রাতিষ্ঠানিক সন্তান জন্মদান বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক সেবার গুণগত মান বৃদ্ধি করতে হবে। চিকিৎসা ব্যয় সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হবে। তবেই সামগ্রিকভাবে শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে আনা সম্ভব।