রাজন ভট্টাচার্য
প্রকাশ : ০৬ মে ২০২৪, ০২:২০ এএম
আপডেট : ০৬ মে ২০২৪, ০৭:৩৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ত্রুটির কারণে অধিকাংশ দুর্ঘটনা

পুরোনো সিগন্যালে চলে তিন শতাধিক ট্রেন

পুরোনো সিগন্যালে চলে তিন শতাধিক ট্রেন

যাত্রী নিরাপত্তায় প্রশিক্ষিত জনবল তৈরি ও রেলের স্বয়ংক্রিয় বা ডিজিটাল সিগন্যাল ব্যবস্থায় নজর নেই রেল কর্তৃপক্ষের। ব্রিটিশ আমলের ৮০ শতাংশের বেশি অ্যানালগ সিগন্যাল ব্যবস্থায় চলছে নিরাপদ যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে পরিচিত রেলপথ। একদিকে জনবল সংকট, অন্যদিকে দক্ষ জনবল হিসেবে যারা কাজ করছেন, তারাও করছেন ভুল। বারবার সিগন্যাল ভুলে ঘটছে বড় দুর্ঘটনা। টাকা বাঁচাতে আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে জনবল নিয়োগ করছে রেলওয়ে। স্বল্প টাকায় নিয়োগকৃত অদক্ষ জনবল রেলের বোঝায় পরিণত হচ্ছে। সংকটও বাড়াচ্ছে।

সব মিলিয়ে ডিজিটাল দেশে অ্যানালগ পদ্ধতিতে চলছে রেল। অর্থাৎ স্বয়ংক্রিয় সিগন্যালিং ব্যবস্থায় উল্টোপথে হাঁটছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। ট্রেন দুর্ঘটনা কমাতে কম্পিউটারভিত্তিক স্বয়ংক্রিয় সংকেত ব্যবস্থা চালুর পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এদিকে সিগন্যাল ভুলের কারণে ট্রেন দুর্ঘটনা হওয়ায় গতকাল রোববার পর্যন্ত ঢাকা থেকে জয়দেবপুর হয়ে দেশের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের রেল যোগাযোগ এখনো স্বাভাবিক হয়নি। ঢাকা রেলওয়ে স্টেশন থেকে অনেক ট্রেন বিলম্বে ছেড়ে যায়।

রেলমন্ত্রী মো. জিল্লুল হাকিম কালবেলাকে বলেন, সম্প্রতি সিগন্যাল ভুলের কারণে বেশ কয়েকটি রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে। বিএনপির আমলে গোল্ডেন হ্যান্ডশেক দিয়ে রেলের জনবল বিদায় করা হয়েছে। অনেকে অবসরে গেছেন। এখন চুক্তিতে চালক, গার্ড, স্টেশন মাস্টার নিয়োগ দিয়ে আমাদের রেল পরিচালনা করতে হয়। মূলত দক্ষ জনবলের অভাবে ট্রেন দুর্ঘটনা বাড়ছে।

রেল সংশ্লিষ্টরা জানান, নামমাত্র স্বয়ংক্রিয় বা ডিজিটাল সিগন্যাল পয়েন্ট থাকলেও পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চল রেলের অধিকাংশ সেকশনে এখনো চালু রয়েছে ব্রিটিশ আমলের ‘ম্যানুয়ালি’ সিগন্যাল ব্যবস্থা।

ত্রুটিপূর্ণ সিগন্যাল, ভুল সিগন্যাল বা সিগন্যাল অমান্য করা এবং রেলওয়ের চালক ও কর্মীদের অবহেলায় দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় বলে মনে করেন গণপরিবহন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ত্রুটিপূর্ণ সিগন্যাল ব্যবস্থা দিয়ে দেশে প্রতিদিন তিন শতাধিক যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়ে।

রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩ সালের ২৩ অক্টোবর কিশোরগঞ্জের ভৈরবে আন্তঃনগর এগারসিন্দুর এক্সপ্রেস ও একটি মালবাহী ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে ২২ জন নিহত ও বহু যাত্রী আহত হন। মালবাহী ট্রেনটি সিগন্যাল অমান্য করে স্টেশনে প্রবেশ করায় দুর্ঘটনা ঘটে। এতে চালকসহ সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বহীনতার বিষয়টি তদন্তে উঠে আসে ।

গত ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রামের পটিয়া রেলস্টেশনে ঢাকা-কক্সবাজার রুটে ননস্টপেজ সার্ভিসের দুটি ট্রেন পর্যটক এক্সপ্রেস ও কক্সবাজার এক্সপ্রেস মুখোমুখি সংঘর্ষ থেকে বেঁচে যায়। সম্প্রতি পাবনার ঈশ্বরদী জংশন স্টেশনে মালবাহী দুই ট্রেনের সংঘর্ষ হয়। সর্বশেষ গত ৩ মে সিগন্যাল ভুলে গাজীপুরে তেলবাহী ও যাত্রীবাহী ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন গুরুতর আহত হন। এ ছাড়া শনিবার দুপুরে সিরাজগঞ্জের বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম রেলওয়ে স্টেশনে স্টেশন মাস্টার ও পয়েন্টসম্যানের ভুলে একই লাইনে দুটি যাত্রীবাহী ট্রেন প্রবেশের ঘটনা ঘটে।

কলকাতা থেকে ঢাকাগামী মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনটি স্টেশনের ৫ নম্বর লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় দায়িত্বরত স্টেশন মাস্টার ও পয়েন্টসম্যানের ভুল সিগন্যালের কারণে ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী ধূমকেতু এক্সপ্রেস ট্রেনটি একই লাইনে প্রবেশ করে । তবে এ সময় চালক একই লাইনে আরেকটি ট্রেন দেখতে পেয়ে ট্রেনটি দ্রুত থামিয়ে দেওয়ায় মুখোমুখি সংঘর্ষের হাত থেকে ট্রেনটি অল্পের জন্য রক্ষা পায়।

একের পর এক সিগন্যাল ভুলে ট্রেন দুর্ঘটনার ঘটনায় রেল ভবনজুড়ে তোলপাড় চলছে। এ নিয়ে শনিবার ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন রেলের নবনিযুক্ত মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী।

রেলওয়ের প্রকৌশলীরা বলছেন, কয়েকটি কারণে মূলত ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। একটা কারণ হলো সিগন্যাল ওভারসুট করা অর্থাৎ ট্রেনকে থামার সিগন্যাল দেওয়া হলেও না থেমে চলে যাওয়া। আরেকটা কারণ হলো, ভুল সিগন্যাল। স্টেশন মাস্টার ভুল সিগন্যাল দিলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

আবার অনেক সময় দেখা যায়, সিগন্যাল দিয়েছে একরকম আর লাইন সেটিং করেছে অন্যরকম। এ ছাড়া পয়েন্ট সেট করে লক করতে হয়। অনেক সময় লক না করলেও কিন্তু ট্রেন চলে যায়। এ ধরনের অনেক গাফিলতির কারণে ট্রেনে মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটে। এসব দুর্ঘটনার পর গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন বলছে, সিগন্যাল ব্যবস্থা ত্রুটির কারণে অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে ।

জানা গেছে, রেলে কম্পিউটারভিত্তিক স্বয়ংক্রিয় সংকেত ব্যবস্থা তথা কম্পিউটারবেইজড ইন্টারলিঙ্ক সিস্টেম (সিবিআইএস) নেই। সনাতন পদ্ধতির নন-ইন্টারলিঙ্ক ব্যবস্থায় সংকেত দেওয়া হয়। তাছাড়া পুরোনো সংকেত (ম্যানুয়াল) পদ্ধতিতে দক্ষ হয়ে উঠতে পারেনি নতুন নিয়োগ পাওয়া জনবল। আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে ঠিকাদারের সরবরাহ করা পয়েন্টসম্যান রেলের বিশেষায়িত কাজ জানেন না।

রেলের মহাপরিচালক বলেছেন, অর্ধেক জনবল দিয়েছে আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে জনবল সরবরাহকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। সিবিআইএসে দুজন কর্মী লাগলে সনাতনে লাগে পাঁচজন। যারা নতুন আসছেন, তারাও দক্ষ নন। শিখিয়ে-পড়িয়ে কাজ চালাতে হচ্ছে। সিগন্যালের ভুল রোধে এখন থেকে কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করবেন। এতে ট্রেন চলাচলে বিলম্ব হলে কিছু করার নেই ।

এদিকে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন বলছে, ভারতসহ অন্যান্য দেশে রেল দুর্ঘটনা হলেও বাংলাদেশে রেল দুর্ঘটনাকে নিছক দুর্ঘটনা বলা যাবে না, বলতে হবে কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড । কারণ এখানে রেললাইনের অবকাঠামো ঠিক নেই, চালকের খামখেয়ালি ও ত্রুটিপূর্ণ সিগন্যালের কারণে দুর্ঘটনা হয়। রেলের ছোট-বড় দুর্ঘটনার ৯০ শতাংশই ঘটে সিগন্যাল ব্যবস্থার ত্রুটির কারণে।

রেলওয়ে পশ্চিমের প্রধান সংকেত ও টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলী মিজানুর রহমান কালবেলাকে বলেন, ট্রেন দুর্ঘটনা কমাতে উন্নত সিগন্যাল পদ্ধতির বিকল্প নেই ।

রেলওয়ে পূর্বের প্রধান সংকেত ও টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলী সুশীল কুমার হালদার বলেন, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উন্নত সিগন্যাল ব্যবস্থার চিন্তা রেল কর্তৃপক্ষের রয়েছে। এজন্য কাজও চলছে বলে জানান তিনি।

গণপরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিবেশী দেশ ভারতে রেলওয়ের সিগন্যাল ব্যবস্থা পরিচালনা করা হয় আধুনিক প্রযুক্তিতে। দেশটির প্রায় ২ লাখ কিলোমিটার রেলপথ পরিচালনা করা হয় টেলিকম সিস্টেমে ।

তবে বাংলাদেশ রেলওয়েতে পিএলসি (পেপার লাইন ক্লিয়ার) ব্যবস্থার মাধ্যমে ম্যানুয়ালি সিগন্যাল ব্যবস্থায় ট্রেন পরিচালনা করা হয় ।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান কালবেলাকে বলেন, আমাদের রেললাইনের অবকাঠামো ঠিক নেই। সিগন্যাল অমান্য করা হয় এবং রেলকর্মীদের দায়িত্বে অবহেলার কারণে দুর্ঘটনা হয়। তাই বাংলাদেশের রেল দুর্ঘটনাটা মূলত কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সাবেক পরিচালক গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক কালবেলাকে বলেন, রেলের নিজস্ব অবকাঠামো উন্নয়ন বা রেললাইন, পুরোনো রেল ব্রিজ বা কালভার্ট মেরামত, পুরোনো সিগন্যালিং ব্যবস্থার আধুনিকায়ন দরকার। সেদিকে নজর না দিয়ে রেল একের পর এক নতুন প্রকল্প নিচ্ছে। দুর্ঘটনা রোধে রেলের সিগন্যালিং ব্যবস্থা আধুনিকায়নে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

সিগন্যাল বিভাগে সবচেয়ে কম জনবল জানিয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী কালবেলাকে বলেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সাল থেকে সারা দেশে ১৬০টি নতুন ট্রেন চালু করেছে। নানা কারণে সিগন্যাল ব্যবস্থার উন্নয়ন উপেক্ষিত রয়েছে। পুরো সিগন্যাল ব্যবস্থা আধুনিকায়ন করা সম্ভব হয়নি।

আবদুল্লাপুর-পার্বতীপুর, দর্শনা-খুলনা এবং আখাউড়া-সিলেটসহ অধিকাংশ সেকশনে ম্যানুয়ালি সিগন্যাল ব্যবস্থায় ট্রেন চালানো হয়। তবে জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী সেকশনে সিবিআইএস ও সিটিসি সিগন্যাল ব্যবস্থা স্থাপনের একটি প্রকল্পের কাজ চলমান। এ ছাড়া আখাউড়া-ভৈরব সেকশনসহ পদ্মা সেতু লিঙ্ক লাইন স্থাপন প্রকল্পে আধুনিক সিগন্যাল ব্যবস্থা স্থাপনের কাজ চলছে বলে জানান তিনি।

রেলের পশ্চিমাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) অসীম কুমার তালুকদার বলেন, আউটসোর্সিংয়ে নিয়োগ পাওয়া জনবলের দক্ষতায় ঘাটতি রয়েছে। আবার নিয়মিত লোক বদল হয়। ফলে সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণে সমস্যা লেগেই আছে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ইরানের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের নাম ঘোষণা

অটোরিকশাচালকদের ওপর স্টিম রোলার চালাচ্ছে সরকার :  রিজভী 

২৫০০ অটোরিকশা চালকদের বিরুদ্ধে মামলা

নবীনদের চাকরি দিচ্ছে ওয়ালটন

দিনাজপুরে বোরো সংগ্রহের উদ্বোধন

বাড়ি ফেরার পথে ট্রাকচাপায় নিহত ২

শিক্ষার্থীকে বেধড়ক পেটাল যুবলীগ নেতা

বুনো হাতির তাণ্ডবে নির্ঘুম রাত কাটছে গ্রামবাসীর

ব্যাটারিচালিত রিকশা চালু রাখার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী : ওবায়দুল কাদের

অসাধারণ ক্লপের আবেগঘন বিদায়

১০

বিএনপির হাত থেকে ইসলামকে রক্ষা করতে হবে : পররাষ্ট্রমন্ত্রী

১১

প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দিবে ঢাবি শিক্ষক সমিতি

১২

চাকরি দেবে নোমান গ্রুপ, আবেদন করুন শুধু পুরুষরা

১৩

টাকা নিতে অস্বীকৃতি, পোলিং অফিসারকে মারধর

১৪

দীপিকার নাম বদলে দিলেন রণবীর

১৫

রাইসির মৃত্যুতে রাষ্ট্রীয় শোক পালনের ঘোষণা পাকিস্তানের

১৬

রাইসিকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে, বললেন ইসরায়েলি নেতা

১৭

ইরানকে সহযোগিতায় সবকিছু করতে প্রস্তুত পুতিন

১৮

চাচিকে গলা কেটে হত্যাচেষ্টায় যুবক গ্রেপ্তার 

১৯

রাইসির মৃত্যুতে পাল্টে যাবে ইরানের পররাষ্ট্রনীতি!

২০
X