সর্বজনীন পেনশনের ‘প্রত্যয় স্কিম’ চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের কপালে। তাদের মতে, এই স্কিম আগামী ১ জুলাই চালু হলে আগে ও পরে যোগদানকৃতদের মধ্যে দুটি শ্রেণির জন্ম দেবে। একই কর্মক্ষেত্রে অবস্থানরত সহকর্মীদের মধ্যে এ বিভাজন শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। যে কারণে এই স্কিমে অন্তর্ভুক্ত না করার দাবিতে তারা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।
জানা গেছে, দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীকে পেনশন সুবিধার আওতায় আনতে সর্বজনীন পেনশন স্কিমের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ২০২৩ সালের ১৭ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর উদ্বোধন করেন। চলতি বছরের মার্চে পেনশন স্কিম বিধিমালা সংশোধন করে তাতে স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, স্বশাসিত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থার অন্তর্ভুক্তিকে বাধ্যতামূলক করা হয়।
জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান কবিরুল ইজদানী খান কালবেলাকে বলেন, ১ জুলাই থেকে প্রত্যয় স্কিম আসছে। এরপর যারা সরকারি চাকরিতে যোগদান করবেন, এই স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হওয়া তাদের জন্য বাধ্যতামূলক।
শিক্ষকরা যে কারণে বিরোধিতা করছেন : শিক্ষকরা বলছেন, এ স্কিম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও শিক্ষকদের জন্য অমর্যাদাকর। শিক্ষকরা বর্তমান ও নতুন স্কিমের তুলনামূলক চিত্র দেখিয়ে বলেছেন, এ স্কিমের কারণে তারা ১৩ ধরনের বৈষম্যের শিকার হবেন।
কীভাবে শিক্ষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তার একটি চিত্র তুলে ধরেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। সেখানে দেখা যাচ্ছে, বর্তমান পেনশন ব্যবস্থায় একজন অধ্যাপকের অবসর সময়কালীন মূল বেতন থাকে ৭৮ হাজার টাকা। তার বেতন থেকে পেনশন বাবদ কোনো অর্থ কাটা হয় না। তবে প্রত্যয় স্কিমে মূল বেতনের ১০ শতাংশ কর্তন হবে। ৩০ বছরে কেউ শিক্ষকতায় যোগদান করলে তার চাকরিকাল দাঁড়ায় ৩৫ বছর। মাসিক ৫ হাজার টাকা মূল বেতন থেকে কর্তন করলে ৩৫ বছরে তা দাঁড়াবে ২১ লাখ টাকা। কিন্তু বর্তমানে কর্তনের পরিমাণ শূন্য। বর্তমান পেনশন ব্যবস্থায় একজন অধ্যাপক আনুতোষিক পান ৮০ লাখ ৭৩ হাজার টাকা। প্রত্যয় স্কিমে আনুতোষিকের পরিমাণ শূন্য।
বর্তমানে পেনশনার ও নমিনি আজীবন পেনশনপ্রাপ্ত হন। প্রত্যয় স্কিমে পেনশনার আজীবন পেনশনপ্রাপ্ত হলেও তার মৃত্যুর পর নমিনির বয়স ৭৫ বছর পর্যন্ত পেনশন পাবেন। এক্ষেত্রে নমিনি বৃদ্ধ বয়সে একটা ঝুঁকির মধ্যে পড়বেন। আবার নমিনিও যদি পেনশনার হন, তাহলে তিনি কি ডাবল বেনিফিট পাবেন কি না, সেটি পরিষ্কার করা হয়নি। এখন নিট পেনশনের ওপর ৫ শতাংশ হারে বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হলেও নতুন স্কিমে সেটি শূন্য। বর্তমানে অর্জিত ছুটি অবসরকালীন জমা থাকলে তার পরিবর্তে অর্থ দেওয়া হয়; কিন্তু প্রত্যয় স্কিমে এ বিষয়ে কোনো উল্লেখ নেই। একজন সরকারি চাকরিজীবী এলপিআরে গেলে কী ধরনের সুবিধা পাবেন, সে বিষয়েও কোনো দিকনির্দেশনা নেই।
শিক্ষকদের কর্মসূচি ঘোষণা:
এদিকে, প্রত্যয় স্কিম প্রত্যাহার, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য সুপারগ্রেড কার্যকর এবং স্বতন্ত্র বেতনস্কেল প্রবর্তনের দাবি জানিয়ে সরকারকে আগামী ২৫ মে পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন। এ সময়ের মধ্যে দাবি মেনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে সারা দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের নিয়ে সর্বাত্মক আন্দোলন কর্মসূচির হুঁশিয়ারি দিয়েছে সংগঠনটি। সোমবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলন থেকে এ হুঁশিয়ারি দেয় ফেডারেশন।
ফেডারেশনের নেতারা বলেন, আগামী ২৫ মের মধ্যে আমাদের দাবির বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করা হলে ২৬ মে সারা দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকরা একযোগে সকাল সাড়ে ১১টা থেকে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করবেন। এ ছাড়া ২৮ মে শিক্ষকরা সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত দুই ঘণ্টার কর্মবিরতি পালন করবেন। এ সময়ের মধ্যে দাবি না মানা হলে আগামী ৪ জুন সারা দেশে শিক্ষকরা একযোগে অর্ধদিবস কর্মবিরতি পালন করবেন।
ফেডারেশনের মহাসচিব ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. নিজামুল হক ভূঁইয়া কালবেলাকে বলেন, সব সরকারি কর্মকর্তাকে এই স্কিমে আনা হলে আমাদের আপত্তি থাকতে না। হঠাৎ করেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য এটি নির্দিষ্ট করা হয়। এর ফলে শিক্ষকরা সম্মান ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
এদিকে সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করতে এমপিওভুক্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের (১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী) তালিকা, এমপিও শিট (শিট) এবং রশিদের সত্যায়িত হার্ডকপি বাহক মারফত উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসে জমা দেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠান প্রধানদের জানানো হয়েছে। এ নিয়ে শিক্ষক ও কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। তবে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ বলছে, সর্বজনীন পেনশন স্কিম বাধ্যতামূলক নয়। কোথাও এটি বাধ্যতামূলক করে চিঠি দেওয়া হলে তা প্রত্যাহারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান কবিরুল ইজদানী খান গতকাল সন্ধ্যায় কালবেলাকে বলেন, চারটি পেনশন স্কিমের কোনোটিই বাধ্যতামূলক নয়। কোনো উপজেলা থেকে বাধ্যতামূলক চিঠি দিলে সে চিঠি প্রত্যাহারের জন্য বলা হচ্ছে।