ভোলা জেলার ৯টি উপজেলার গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ করেছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। গুরুত্বপূর্ণ গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় এ কাজ করা হয়। তবে এই প্রকল্পে রড ছাড়া আরসিসি রাস্তা ঢালাই, রাস্তার কাজ বাকি রেখেই বিল পরিশোধ, নির্ধারিত পরিমাপের চেয়ে কম রাস্তা নির্মাণ, নিম্নমানের পাবলিক টয়লেট এবং ব্রিজের সংযোগ সড়ক না করাসহ বেশ কিছু অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
জানা গেছে, অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামীণ পরিবহন ও বাজারজাতকরণ ব্যয় কমানো এবং স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ‘গুরুত্বপূর্ণ গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন: ভোলা জেলা’ শীর্ষক প্রকল্পটি ২০১৭ সালে অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রকল্পটি ২০২০ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ২০২২ সালে শেষ হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ হয় ৪২৪ কোটি টাকা।
জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আলোচ্য প্রকল্পের আওতায় সড়ক, ব্রিজ, কালভার্ট, ড্রেন, সাইক্লোন শেল্টার, সংযোগ সড়ক এবং বাজার উন্নয়ন ও পাবলিক টয়লেট নির্মাণ করা হয়েছে। তবে, স্থানীয় জনগণের জীবনমান উন্নয়নে এই প্রকল্পের আওতায় যেসব অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে, তার বেশিরভাগই নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করে কোনোমতে গোঁজামিল দিয়ে শেষ করা হয়েছে।
জানা গেছে, চরফ্যাসন উপজেলার ওসমানগঞ্জ ইউনিয়নের আমিন মিয়ার হাটে বাজার অবকাঠামো নির্মাণ অংশে একটি টিনশেড স্টল নির্মাণ করা হয়েছে। তবে সেটি দোকান বসানোর অনুপযোগী। টিনশেড স্টলের ফ্লোর ফিনিশিং নিম্নমানের হওয়ায় তা ব্যবহার করতে পারছে না বলে অভিযোগ সুবিধাভোগীদের। এ ছাড়া, টিনশেড বাজার ঘরটিতে আসতে একটি আরসিসি রাস্তার নির্মাণ করা হয়েছে; কিন্তু সেখানে রড ব্যবহার না করেই আরসিসি ঢালাই দেওয়া হয়েছে। এসবের সংশোধন না করেই ঠিকাদারের বিলও পরিশোধ করা হয়েছে। একই অবস্থা বাজার এলাকার নির্মিত আরসিসি ড্রেনের। পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য নির্মাণ করা হলেও একাধিক জায়গায় ভাঙা ও স্লাব বিহীন অবস্থায় ড্রেনটি বন্ধ ও অকার্যকর অবস্থায় রয়েছে।
এদিকে জাহানপুর ইউনিয়নের আটকপাট বাজার সংলগ্ন এলাকায় একটি পাবলিক টয়লেট নির্মাণ করা হলেও তা ব্যবহার অনুপযোগী। টয়লেটের বেশিরভাগ চেম্বার অকার্যকর। কমোড ও বেসিন ভাঙা। এ ছাড়া ছাদের পানির ট্যাঙ্কির সঙ্গে বেসিন এবং টয়লেটের কল পর্যন্ত পানির সংযোগ নষ্ট। ভবনটির প্লাস্টার খসে পড়ছে।
একই অবস্থা জিন্নাগড় ইউনিয়নের বাজারের টয়লেটটিরও। এটা কেউ ব্যবহার করতে পারে না। এদিকে বাজারের পাবলিক টয়লেট হয়ে মসজিদের সামনে ঘাট পর্যন্ত একটি রাস্তা নির্মাণ করা হলেও নির্ধারিত পরিমাপের তুলনায় তা কম। তাছাড়া, রাস্তাটি একাধিক জায়গায় ভাঙ্গা।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, অবকাঠামো নির্মাণ কাজে অনিয়ম ও কাজের গুণগত মান ভালো হয়নি। টয়লেটগুলো অত্যন্ত নিম্নমানের। ব্যবহার উপযোগী না। টয়লেটগুলো যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ করা প্রয়োজন। এ ছাড়া বেশিরভাগ সময় তালাবদ্ধ থাকায় এটি পাবলিট টয়লেট কি না, তা এলাকাবাসীর কাছে স্পষ্ট নয়।
ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার অবকাঠামো উন্নয়ন কাজেও অনিয়ম হয়েছে। উপজেলার বড় মানিকা ইউনিয়নে ১ হাজার ৪৭০ মিটার রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে; কিন্তু বছর না পেরোতেই রাস্তার বিভিন্ন স্থানে ভেঙে গেছে এবং গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। প্যালাসাইডিং ওয়াল নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও তা করা হয়নি। এ ছাড়া রাস্তাটি নিচু জলাভূমি এলাকায় নির্মাণ করায় অল্প বৃষ্টিতেই ডুবে যায়। ফলে বছরের বেশিরভাগ সময় রাস্তাটি ব্যবহার উপযোগী থাকে না। শোল্ডার না থাকায় রাস্তাটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া খুতবা ইউনিয়নে ১২ মিটারের একটি একটি ব্রিজ নির্মাণ করা হলেও সংযোগ সড়ক নির্মাণ হয়নি।
শুধু চরফ্যাশন এবং বোরহানউদ্দিন উপজেলা নয়, প্রকল্পের বেশিরভাগ উপজেলার অবকাঠামো উন্নয়নে একই ধরনের অনিয়ম হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া প্রকল্পের আওতায় কেনা যানবাহনগুলো এখনো পরিবহন পুলে জমা হয়নি। দুই বছর হয়ে গেলেও এখনো প্রকল্পে কোনো অডিট করা হয়নি।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) চলতি বছরের সমাপ্ত প্রকল্পের মূল্যায়ন প্রতিবেদনও আলোচ্য প্রকল্পের অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে। সম্প্রতি মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করে আইএমইডি। এতে বলা হয়েছে, প্রকল্পের কিছু কিছু কার্যক্রম বাস্তবায়নে অনিয়ম দেখা গেছে। নির্মাণকাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারকে কালো তালিকাভুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছে আইএমইডি।
এতে আরও বলা হয়, আটকপাট বাজারে রাস্তার পরিমাণ কম। তাছাড়া রাস্তাটি ইতোমধ্যে ভেঙ্গে গেছে। পাবলিক টয়লটির বেশিরভাগ কমোড ও বেসিন ভাঙা, পানির সংযোগ নষ্ট। ভবনটির প্লাস্টার খসে পড়ে যেতে দেখা গেছে। টিনশেড স্টলে ফ্লোর ফিনিশিং না করার কারণে সুভিধাভোগীরা ব্যবহার করতে পারছে না। আরসিসি রাস্তার কিছু অংশে রড ছাড়া ঢালাই হয়েছে। পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য নির্মিত ড্রেনটি বন্ধ ও অকার্যকর এবং স্লাব ভাঙা। যথাযথভাবে নির্মাণ না করায় রাস্তাগুলো টেকসই হয়নি। প্যালাসাইডিং ওয়াল এবং শোল্ডার না থাকা এবং নিচু এলকায় নির্মাণ করায় রাস্তাগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নির্মাণকাজ সন্তোষজনক নয়। এসব কাজ সম্পূর্ণ না করেই ঠিকাদারের বিল পরিশোধ করা হয়েছে।
প্রকল্পটির বিষয়ে বেশ কিছু সুপারিশ করেছে আইএমইডি। এতে বলা হয়েছে, দ্রুত ব্রিজটির সংযোগ সড়ক নির্মাণ এবং ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা ও পাবলিক টয়লেটগুলো জরুরিভিত্তিতে মেরামত করতে হবে। এ ছাড়া টিনশেড স্টল, আরসিসি ড্রেন এবং রাস্তা নির্মাণ কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারকে কালো তালিকাভুক্ত করতে হবে।
আলোচ্য প্রকল্পটির প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন বর্তমান এলজিইডির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মমিন মজিবুল হক সমাজী। অনিয়মের বিষয়ে জানতে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তার হোয়াটসঅ্যাপে বক্তব্যের বিষয় উল্লেখ করে মেসেজ দিলেও কোনো সাড়া মেলেনি।
জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) প্রধান প্রকৌশলী মো. আলি আখতার হোসেন কালবেলাকে বলেন, এ বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। তবে কোনো অভিযোগ পেলে অবশ্যই তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন কালবেলার চরফ্যাসন (ভোলা) প্রতিনিধি মাইনউদ্দিন জমাদার।