কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২২ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২২ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:৩০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

জনস্বাস্থ্যের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

ডা. মো. রুহুল ফুরকান সিদ্দিক, পিএইচডি
জনস্বাস্থ্যের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে উৎপাদনক্ষম ব্যক্তিই স্বাস্থ্যবান ব্যক্তি। শুধু রোগের অনুপস্থিতিই নয়, স্বাস্থ্য হলো শারীরিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে ভালো থাকা, যেখানে একজন নাগরিক রাষ্ট্রস্বীকৃত মৌলিক মানব অধিকারসহ পূর্ণ মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে বাঁচতে পারবেন এবং রাষ্ট্রের ক্রিয়া অথবা নিষ্ক্রিয়তার কারণে কোনো অভাব বা ভয় অনুভব করবেন না। রাষ্ট্রের জনগণ লোকভয়, রাজভয়, অপমৃত্যুভয়ে থাকবেন না এবং অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান, কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা, বিশ্রাম ইত্যাদির অভাব বোধ করবেন না। চূড়ান্ত বিচারে স্বাস্থ্য, জনস্বাস্থ্য হলো মানবাধিকার এবং একটি দেশ বা সমাজের উন্নয়নের হাতিয়ার। ১৮৪৮ সালে আধুনিক নিদানশাস্ত্রের জনক রুডলফ ভারকো (১৮২১-১৯০২) বার্লিন কর্তৃপক্ষ দ্বারা সাইলেসিয়াতে টাইফাস মহামারির প্রতিবেদনে, প্রদেশে গণতন্ত্রের অভাব, সামন্ততন্ত্র এবং অনৈতিক ট্যাক্স পলিসির জন্য জনগণের অতিদরিদ্র বসবাস স্থান বা বসবাস প্রণালি, অপর্যপ্ত খাবার এবং অস্বাস্থ্যকর হাইজিনকে টাইফাস মহামারির জন্য দায়ী বলে উল্লেখ করেন।

বাংলাদেশের প্রায় সব মহলেই স্বাস্থ্যবিষয়ক আলোচনা শুরু হয় হাসপাতাল দিয়ে এবং শেষ হয় চিকিৎসকদের নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার মাধ্যমে। অবশ্যই চিকিৎসা ব্যবস্থা স্বাস্থ্যের উল্লেখযোগ্য নিয়ন্ত্রক; কিন্তু একমাত্র নির্ণায়ক নয়। মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থা, জনসংখ্যার গঠন, পরিবেশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রত্যাশার ধরন, জেন্ডার ধারণা, প্রযুক্তির ব্যবহার ইত্যাদিও স্বাস্থ্যের নির্ণায়ক যেখানে রাষ্ট্রের পাবলিক পলিসি এবং স্বাস্থ্য পলিসি স্বাস্থ্য ও জনস্বাস্থ্যের মূল ভিত্তি রচনা করে।

কবে কখন কীভাবে চিকিৎসাবিজ্ঞান প্রতিষেধক এবং আরোগ্যক্ষম চিকিৎসাবিজ্ঞানে ভাগ হয়ে গেল, তা আমাদের জানা না থাকলেও এটা স্পষ্ট এবং পরিষ্কার যে, আরোগ্যক্ষম চিকিৎসাবিজ্ঞান একাডেমিয়া, কর্মক্ষেত্রে ও রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রাধিকার প্রাপ্ত অন্যদিকে প্রতিষেধক চিকিৎসাবিজ্ঞান এরই মধ্যে প্রান্তিকীকৃত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং সাম্প্রতিক সময়ের করোনা অতিমারি দ্রুত এ ধারণার পরিবর্তন এনেছে।

প্রাচীন গ্রিক সভ্যতা মানুষকে কোনো ঘটনার বিশ্লেষণে ‘কেন এবং কীভাবে’ এটা ভাবতে শিখিয়েছিল। গ্রিক মেডিসিনের একজন পথিকৃৎ এসকুলাপিয়াস (১২০০ খ্রিষ্টপূর্ব)। এসকুলাপিয়াসের দুই মেয়ে, মতান্তরে দুই সহচারী অথবা দুই সহযোগী হাইজিয়া ও প্যানাসিয়া, এই দুজন যথাক্রমে প্রতিষেধক ও আরোগ্যক্ষম চিকিৎসাবিজ্ঞানের ধারার জন্ম দেয় বলে জানা যায়। এই দুজন মানুষের সুস্থতা ও চিকিৎসার জন্য দুধরনের দর্শনের জন্ম দেন এবং নিজ নিজ ক্ষেত্রে দেবীরূপে পূজনীয় হয়ে ওঠেন। হাইজিয়া জ্ঞানালোকপ্রাপ্ত। তিনি বিনামূল্যে সুস্থ মানুষকে পরামর্শ দিতেন কীভাবে সুস্থ থাকা যাবে, রোগ প্রতিরোধ করা যাবে। তাই প্রতিরোধ বা প্রতিষেধক বিজ্ঞানকে আজও হাইজিন হিসেবে সম্বোধন করা হয়। অন্যদিকে প্যানাসিয়া অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসা দিতেন অর্থের বিনিময়ে। জনস্বাস্থ্যের ধারণা প্রতিষেধক চিকিৎসাবিজ্ঞানকেই অনেকটা নির্দেশ করে। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক গ্রিস চিকিৎসক হিপোক্রেটাসের (৪৬০-৩৭০ খ্রিষ্টপূর্ব) লেখা বই ‘বাতাস, পানি এবং স্থান’ প্রতিষেধক বিজ্ঞান বা হাইজিনের জন্য দিকনির্দেশনামূলক প্রবন্ধ।

দ্রৌপদী বিশ্বজুড়ে হাইজিয়া মনোরম পরিবেশকে যৌক্তিকভাবে সুস্থ জীবনের উৎকর্ষ হিসেবে চিত্রায়িত করেন। Men’s Sana in Corpore Sano-সুস্থ দেহে সুস্থ মন ফলস্বরূপ গ্রিসে তাকে মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে নিবিড়ভাবে চিহ্নিত করা হয় এবং রোমে তিনি SALUS—কুশল বা সুস্থতার দেবী হিসেবে সাধারণভাবে চিত্রিত হন; কিন্তু সত্যিকার অর্থে হাইজিয়া প্রাচীনকালের পৃথিবী অভিমুখে কোনো দেবতা বা দেবী ছিলেন না। স্বাস্থ্যকে নির্দেশ করে এমন বিমূর্ত শব্দ থেকে তার নাম উঠে আসে।

স্থান-কাল-পাত্র ভেদে স্বাস্থ্যের প্রেক্ষাপট নানাভাবে রচিত হয়। স্বাস্থ্য ধারণা সব কালে, সব দেশে, সব জাতি সমাজে এক নয়। সাংস্কৃতিক নির্মাণ যেমন স্বাস্থ্যকে রূপায়িত করে তেমনই এটা স্বাস্থ্য প্রত্যাশার ধরনকেও তৈরি করে। যত উন্নত এবং আধুনিকই হোক না কেন, পশ্চিমের জ্ঞান দ্বারা পূর্বের স্বাস্থ্যকে পরিপূর্ণভাবে সমাধান করা অসম্ভব কারণ সব প্রক্রিয়ার সঙ্গে সমাজ কাঠামো এবং সাংস্কৃতিক নির্মাণ জড়িত। তবে মনে রাখা প্রয়োজন, শুধু দেশজ পরিকল্পনা দ্বারা স্বাস্থ্য-জনস্বাস্থ্য সুব্যবস্থা অসম্ভব কারণ স্বাস্থ্যের একটি বৈশ্বিক রূপ আছে, যেখানে বাণিজ্য, মানুষের যোগাযোগ, আত্মীয়তা ও দেশের প্রাণী, বায়ু ইত্যাদির প্রবহমানতা দেশের সীমারেখা দ্বারা যেমন নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, তদ্রূপ রোগ-রোগের বিস্তার নিয়ন্ত্রণকে আঞ্চলিক এবং বৈশিক সংহতি ছাড়া অসম্ভব, যেখানে যুথবদ্ধ জ্ঞান, পরিবেশ-সংক্রান্ত ধারণা ভূমিকা রাখে।

১৯৭৮ সালে রাশিয়ার আলমা আটা সম্মেলনে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধানের উপস্থিতিতে বিশ্ববাসীর সুস্থ জীবনের জন্য ‘প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা’র ধারণা আজও অম্লান, প্রাসঙ্গিক এবং অর্থবহ যেখানে সুপেয় পানি ও পয়ঃব্যবস্থা, খাদ্য ও পুষ্টি, স্বাস্থ্য শিক্ষা, টীকাদান কর্মসূচি, মা ও শিশু স্বাস্থ্যে নির্ভর পরিবার পরিকল্পনা, স্বল্পমারি বা আঞ্চলিক রোগ নিয়ন্ত্রণ, ছোটখাটো রোগবালাইয়ের চিকিৎসা এবং অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের প্রাপ্যতাকে নিশ্চিত করার পরামর্শ দেওয়া হয়। সব রাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্য এটি প্রত্যাশিত স্বাস্থ্যের নিশ্চয়তা দেয়। বায়ুদূষণ, আবহাওয়া পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ, বয়স্কদের সেবা, ক্রিটিক্যাল কেয়ার, পেলিয়াটিভ কেয়ার ইত্যাদিসহ প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার ধারণা আজও অত্যাবশ্যকীয় এবং নতুনভাবে উপস্থাপিত। বাংলাদেশে শতাব্দী উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা আশানুরূপ অর্জন শেষে আমরা টেকসই উন্নয়নের সব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বদ্ধপরিকর।

জনস্বাস্থ্য হলো ব্যক্তি নয় দেশ, জনগণ এবং সমাজের সুস্থতা নিয়ে ভাবনা, একটা সুস্থ মানুষকে সুস্থ রাখার কলাকৌশল। Great Sanitary Awakening-এর মাধ্যমে ১৮৪০ সালের দিকে জনস্বাস্থ্য কথাটি সাধারণভাবে ব্যবহৃত হলেও ১৮৪৮ সালে ইংল্যান্ডে Public Health Act in England নামে একটি আইনের মাধ্যমে এটা উদ্ভাসিত হয়। সমাজের স্বাস্থ্যসুরক্ষা, স্বাস্থ্যের উন্নয়নের মাধ্যমে জনগণের স্বাস্থ্যকে পুনরুদ্ধারের কথা বলা হয়েছে, এই অ্যাক্টে। ১৯২০ সালে CEO Winslow এটাকে জনগণের সুসংগঠিত অংশগ্রহণে রোগের প্রতিরোধ, স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং স্বাস্থ্যের উন্নয়নের কলা এবং প্রযুক্তিকে নির্দেশ করেছেন। জ্ঞান ও প্রযুক্তির শীর্ষে তালিকায় থাকা দেশের অন্যতম কানাডা আজ তাদের স্বাস্থ্যের জন্য সামাজিক উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করেছে—১. আদিবাসী অবস্থা, ২. প্রারম্ভিক জীবন, ৩. শিক্ষা, ৪. কর্মসংস্থান এবং কর্মক্ষেত্রের অবস্থা, ৫. খাদ্য নিরাপত্তা, ৬. স্বাস্থ্য পরিষেবা, ৭. বাসস্থান, ৮. আয় এবং বিতরণ, ৯. সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী, ১০. সামাজিক বর্জন, ১১. বেকারত্ব এবং কর্মসংস্থান নিরাপত্তা। সমাজে জেন্ডার ধারণা এবং এর নির্মাণকেও স্বাস্থ্যের নির্ণায়ক হিসেবে কানাডায় দেখা হয়।

পাক-ভারত উপমহাদেশে ইংরেজ যুগের আগে অধিকাংশ অঞ্চলে আয়ুর্বেদিক মেডিসিন এবং ইউনানি-টিবস, কিছু কিছু নগর এবং শহরে মানুষের স্বাস্থ্য ও রোগ নিরাময়ে ভূমিকা রেখেছিল। বাণিজ্যের লোভে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির আগমনের আগে স্বাস্থ্য ও জনস্বাস্থ্যের অবস্থার সুনির্দিষ্ট কোনো রূপরেখার উল্লেখ না থাকলেও নানা ধরনের প্রাকৃতিক এবং অতি প্রাকৃতিক চিন্তা চেতনা থেকে গাছ-ভেষজ উদ্ভিদ নির্ভর কবিরাজি, ঝাড়ফুঁক, তাবিজ-কবজসহ নানা ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি চালু ছিল এটা নিশ্চিত।

১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধ শেষে ভারতবর্ষে ঔপনিবেশিক শাসন শুরু হয়। এটা সত্য কলোনি শাসন যুগে যুগে দেশে দেশে যেভাবেই আসুক না কেন, সেখানে স্বাস্থ্যব্যবস্থার দৃশ্যমান উন্নয়নের সবটুকুই এসেছে শাসকশ্রেণির সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা এবং কলোনিয়াল ব্যবস্থার পাকাপোক্ত করার প্রয়োজনে। সেখান থেকে চুইয়ে আসা ছিটেফোঁটা সেবা নিশ্চয়ই কলোনাইজড জনগণ পেয়েছে। আবার এটাও ঠিক ইউরোপে শিল্পবিপ্লবের পর চটকল, তাঁতকল মেকানাইজ হওয়ার ফলে সেখানে গ্রাম থেকে আসা শ্রমিকরা বা শহরের দরিদ্র বস্তিবাসী হয়ে যায়—ইউরোপের শহরগুলো হয়ে ওঠে নোংরা অস্বাস্থ্যকর। তা ছাড়া ইংল্যান্ড, ফ্রান্স তথা ইউরোপ কলেরা, যক্ষ্মা, বসন্ত, টাইফাস এবং প্লেগ মহামারিতে পর্যুদস্ত হয়ে পরে। অ্যান্টিবায়োটিক্স শূন্য দুনিয়ায় তখনো চিকিৎসা বিজ্ঞানে উন্নয়নের হাওয়া লাগেনি। ইউরোপ থেকে বয়ে আনা সিফিলিস, যক্ষ্মা, হাম ইত্যাদিতে কলোনাইজড, জনপুঞ্জ বিশেষ করে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীরা মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখাতে থাকে, প্রাথমিকভাবে সংক্রামিত হওয়ার কারণে।

ওই সময় শুধু ভারতবর্ষ কেন ইংল্যান্ডে জনস্বাস্থ্যের অবস্থা মোটেই সন্তোষজনক ছিল না। বিশেষ করে এডউইন চ্যাডউইক ১৮৪২ সালে, লর্ড সিমন ১৮৫৮ সালে এবং অন্যান্য সমাজবিজ্ঞানীরা ইংল্যান্ডে জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। কলেরা, টাইফাস, প্লেগ এবং গুটিবসন্তজনিত মহামারিতে মৃত্যুহার এবং অসুস্থতা কমাতে তাদের শ্রম মেধা ছিল উল্লেখযোগ্য। ভারতবর্ষে আসা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর স্বাস্থ্যজনিত চরম অসন্তোষজনক পরিস্থিতি এবং মৃত্যুহার কমানোর লক্ষ্যেই ১৮৫৯ সালে রয়েল কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয়। তারা ভারতের প্রত্যেক প্রেসিডেন্সিতে পাবলিক হেলথ কমিশন গঠন, সুপেয় পানি, ড্রেন গঠন এবং মহামারি প্রতিরোধকে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর রক্ষাকবজ মনে করেন এবং সে মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দেন। জন স্নো ১৮৪৮ থেকে ১৮৫৪ সাল পর্যন্ত লন্ডনের কলেরা নিয়ে অধ্যয়ন করেন। ইংরেজ এই ইপিডেমিওলজিস্ট দূষিত পানিকে কলেরা বিস্তারের জন্য দায়ী বলে চিহ্নিত করেন।

অবিভক্ত বাংলায় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ১৯২৭ সালে Health Circle Scheme চালু করেন যেখানে প্রতি পুলিশ স্টেশনের (থানা) জন্য একজন সেনিটারি ইন্সপেক্টর এবং প্রত্যেক জেলার জন্য একজন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা রাখা হয়। এ অঞ্চলে এটা স্বাস্থ্য ও জনস্বাস্থ্যের মাইলফলক।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ১৯৪৩ সালে বাংলার মন্বন্তর, ভারত ছাড় আন্দোলন এবং পাকিস্তান-ভারত ভাগ ইত্যাদির জন্য বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ সময়জুড়ে এ অঞ্চলে জনস্বাস্থ্য ধারণা কিংবা জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা মুখ থুবড়ে পড়ে। ব্রিটিশ-ইন্ডিয়া সরকার স্যার জোসেফ বোর সাহেবকে প্রধান করে একটি হেলথ সার্ভে এবং উন্নয়ন কমিটি গঠন করেন ১৯৪৩ সালে, যেটা বোর কমিটি নামে অধিক পরিচিত। এ কমিটির সঙ্গে প্রশাসক, চিকিৎসক, শৈল্য চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং ইঞ্জিনিয়ারদের সম্পৃক্ত করা হয়। বোর কমিটি দেশের জনগণের স্বাস্থ্যের পুনর্মূল্যায়ন করেন জনস্বাস্থ্যে, মেডিকেল রিলিফ, পেশাজীবীদের শিক্ষা, চিকিৎসা গবেষণা এবং আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য (International Health) এসব বিষয়ের আলোকে। যেখানে একত্রীভূত প্রতিষেধক এবং কিউরেটিভ সেবা, দ্বিস্তর বিশিষ্ট প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং তিন মাসের প্রতিষেধক এবং সামাজিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রশিক্ষণসহ চিকিৎসা শিক্ষা সুপারিশ করা হয়েছিল।

১৯৪৭ সালে লাহোরে প্রথম All Pakistan Health Conference অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে বোর কমিটির সুপারিশকেই গ্রহণ করা হয়। ১৯৫১ সালে দ্বিতীয় All Pakistan Health Conference-এ ছয় বছরের স্বাস্থ্য পরিকল্পনা হয়, যেখানে হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা ও গ্রামের মানুষের চিকিৎসার জন্য ডিসপেন্সারির সংখ্যা বৃদ্ধি, নতুন চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় এবং হাইজিন ও প্রতিষেধক প্রতিষ্ঠান স্থাপনের কথা উল্লেখ ছিল। মেডিকেল স্কুলকে নতুন মেডিকেল কলেজে রূপান্তর করা হয়। Drug Testing Lab এই আমলে প্রতিষ্ঠিত হয়।

বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতিতে জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতা সন্নিবেশিত হয়। উপজেলা স্বাস্থ্য প্রকল্প, পল্লি চিকিৎসক প্রশিক্ষণ, টীকাদান কর্মসূচি, ম্যালেরিয়া-পোলিও নির্মূল কর্মসূচি। কমিউনিটি ক্লিনিক, চিকিৎসায় বহুমাত্রিকতাসহ Alternative Medical Care চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ের সংখ্যাবৃদ্ধি ও অনেক স্পেশালাইজ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়। স্নাতকোত্তর মেডিকেল শিক্ষা, ডাইরেক্টর অব নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কাউন্সিল প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময়ে জনস্বাস্থ্যের অনুকূলে অনেক অর্ডিন্যান্স, আইন পাস হয়। বিভিন্ন অপারেশনাল প্ল্যানের মাধ্যমে স্বাস্থ্য পরিবার পরিকল্পনা ও নার্সিং কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। শিশুমৃত্যু, মাতৃমৃত্যু অনেক কমে আসে। যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি সফলতার দিকে ধাবমান। পোলিও নির্মূলসহ অনেক সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রিত হলেও পরিবেশ, জীবনযাত্রা, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি কারণে অসংক্রামক রোগ আজ বাংলাদেশে সমস্যা হয়ে উপস্থিত।

জনস্বাস্থ্য বা প্রতিরোধ চিকিৎসাবিজ্ঞান ভাবনা আদি থেকে বিশৃঙ্খল, অসংগঠিত, সমন্বয়হীন গতিপথ অতিক্রম করে আসছে। মানুষের স্বাস্থ্য হয়েছে গৌণ, রোগ এবং রোগের চিকিৎসা হয়েছে মুখ্য এবং অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত। চিন্তা জগতে আদিকাল থেকে এই ধারা চলমান। জনস্বাস্থ্যের মূল চিন্তার সন্ধান প্রাচীন গ্রিক দর্শনে পাওয়া গেলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে ১৯৪৮ সালে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সংবিধানে ‘জনস্বাস্থ্য’ উচ্চ স্বরে উচ্চারিত হয় এবং ১৯৭৮ সালে আলমাআটা কনফারেন্সের প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার ধারণার মাধ্যমে বাস্তবমুখী সমন্বিত প্রচেষ্টা দৃশ্যমান হয়।

জনস্বাস্থ্যের চশমা পরে স্বাস্থ্য ভাবনাকে দেখলে স্পষ্টত কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি লক্ষ্য করা যায়। এই বিচ্যুতির কেন্দ্রে আছে (ক) স্বাস্থ্যের পরিবর্তে রোগের প্রাধান্য অর্থাৎ পুরো জনপুঞ্জকে বাদ দিয়ে শুধু একজন রোগী নিয়ে ভাবনা। সুস্থ জনগোষ্ঠীকে সুস্থ রাখার প্রচেষ্টাকে প্রাধান্য না দিয়ে শুধু নিরাময় চিকিৎসা শাস্ত্রকে প্রাধিকার প্রাপ্ত করা। (খ) মানুষকে শুধু জীববৈজ্ঞানিক সত্তা অর্থাৎ শুধু তার দেহকে চিন্তার কেন্দ্রে এনে রোগকে শারীরিক বিপর্যয় হিসেবে দেখা। মানুষের সামাজিক, মানসিক সত্তাকে বুঝতে না পারা। এই প্রক্রিয়া মানবসত্তা তার ভিত্তি থেকে নিচে পড়ে শুধু একটি জীব সত্তা হয়ে যায় এবং পরিবেশের ও সমাজের সঙ্গে তার নিত্য মিথস্ক্রিয়া স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের চিন্তার বাইরে চলে যায়। (গ) জিনের গঠনের পরিবর্তন অতিধীরে হয় অর্থাৎ বিবর্তন (Evolution) অতিধীর প্রক্রিয়া আর মানুষের পরিবেশ প্রতিবেশ দ্রুত পরিবর্তনশীল (Revolution), এই দুইয়ের মধ্যে সমন্বয়হীনতায় অভিযোজন অক্ষমতা। (ঘ) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে বিশেষ করে পাশ্চাত্যে জনস্বাস্থ্যের প্রয়োজনীয়তা এবং এর ভাবনায় ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়; কিন্তু পাশ্চাত্যে তাদের চিন্তায় প্রাচ্যের উন্নয়নশীল দেশগুলোর সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আনতে সক্ষম ছিল কি না, প্রশ্ন থেকে যায়। শরীর, মন, সমাজ এবং সংস্কৃতির পিলারের ওপর বসা মানবসত্তাকে শুধু শারীরিক সত্তা বা অর্গানিক সত্তা ভেবে তার স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা বা তার কুশল নির্মাণ করা অসম্ভব।

বর্তমানে বাংলাদেশের গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবার গুণগত মান বৃদ্ধি ও সমন্বয়, নগর স্বাস্থ্যের দিকে দৃষ্টি, পুষ্টির ফাঁকগুলোর মাঝে সংযোগ, হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় উন্নয়ন, প্রকৃতির সঙ্গে বসবাস এবং বেড়ে ওঠা, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, চিকিৎসাকেন্দ্র (Sanatorium) থেকে স্বাস্থ্যসম্মত বসবাসের (Sanitarium) দিকে যাত্রা, আঞ্চলিক সংহতি, জনস্বাস্থ্যের অগ্রাধিকার এবং বাংলাদেশের সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির ১৮(১) অনুচ্ছেদের বাস্তবায়ন আমাদের জনগণের স্বাস্থ্য এবং সুখের সন্ধান দিতে পারে। স্বাস্থ্য যদি চাতক ধারার তৃষ্ণা হয়, তবে জনস্বাস্থ্য মূর্ত অমীয় বৃষ্টি। জ্ঞানকাণ্ডের সুনির্দিষ্ট শাখা হিসেবে এটা বিটপীলতার মতো আশা ও আলোর দিকে আমাদের টানে। এই প্রক্রিয়া চলমান। জনস্বাস্থ্য মানুষের শরীর-মন, পরিবেশ প্রতিবেশ, সমাজ-সংস্কৃতি, তথ্য প্রযুক্তি এবং স্থান-কাল-পাত্রকে বিবেচনায় আনে এবং বিশ্লেষণ করে। জনস্বাস্থ্যকে বাদ দিয়ে শুধু অগণিত রোগের চিকিৎসায় মহাবিষ্টতা কখনো প্রত্যাশিত ফল দেবে না বিধায় স্বাস্থ্য পরিষেবা ও রোগ-চিকিৎসার মাঝে সমন্বয় জরুরি।

ডা. মো. রুহুল ফুরকান সিদ্দিক, পিএইচডি

অধ্যাপক, ডিন, ফ্যাকাল্টি অব হেলথ সায়েন্সেস, আনোয়ার খান মডার্ন ইউনিভার্সিটি

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বৃত্তির আবেদনের সময় বাড়াল জবি প্রশাসন

ভাবিকে হত্যার অভিযোগে দেবর গ্রেপ্তার

‘আমার ক্যারিয়ারে এমন কালো, অদ্ভুত ফাটা উইকেট দেখিনি’

ভারতের রাষ্ট্রপতি মুর্মুর হেলিকপ্টারে দুর্ঘটনা, ভিডিও প্রকাশ

সালমান শাহর হত্যা মামলার যত নম্বর আসামি ডন

ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে হাতির আক্রমণে দুই মাহুত আহত

ট্রাকের ধাক্কায় প্রাণ গেল পুলিশ সদস্যের

গাজীপুরে গৃহবধূর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার

তানজিন তিশাকে লিগ্যাল নোটিশ দিলেন নারী উদ্যোক্তা

এ সরকারের অধীনে সততা-নিষ্ঠা দেখানোর সুযোগ: ইসি আনোয়ারুল

১০

ড্রাইভিং লাইসেন্স নেওয়ার পদ্ধতি জানালেন পরিবহন উপদেষ্টা

১১

ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকে বিজ্ঞাপন বিষয়ক সেমিনার অনুষ্ঠিত

১২

পাড়ে পড়ে ছিল জুতা-মোবাইল, পুকুরে ভাসছিল মরদেহ

১৩

আসল বন্দুককে খেলনা ভেবে গুলি, পঙ্গু হলেন প্রবাসী

১৪

ব্রহ্মপুত্র খননের আড়ালে কৃষিজমি ধ্বংস

১৫

বর্তমান সরকার নিরপেক্ষ ভূমিকা নিয়েই কাজ করছে : আইন উপদেষ্টা

১৬

ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির নতুন প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর হলেন প্রফেসর আরশাদ মাহমুদ চৌধুরী

১৭

মোবাইলে ডেটা খরচ কমানোর ১০ সেরা টিপস ও ট্রিকস

১৮

সাগরে সুস্পষ্ট লঘুচাপ, বৃষ্টি নিয়ে নতুন বার্তা

১৯

প্রবাসীদের জন্য নির্বাচনী অ্যাপ উন্মুক্তের তারিখ জানালেন ইসি

২০
X