বাংলাদেশে আধুনিক বিশেষায়িত কার্ডিওভাসকুলার চিকিৎসাসেবা ও প্রশিক্ষিত জনশক্তি তৈরি করার লক্ষ্যে ১৯৭৮ সালে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা হয়। এর আগপর্যন্ত মেডিসিন বিশেষজ্ঞরাই হৃদরোগের চিকিৎসা করতেন। প্রয়াত ব্রিগেডিয়ার (অব.) অধ্যাপক আবদুল মালিক স্যারের নেতৃত্বে বাংলাদেশে হৃদরোগের স্বতন্ত্র চিকিৎসাসেবা ও উচ্চতর শিক্ষাব্যবস্থার গোড়াপত্তন। বাংলাদেশের এখন যত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ সারা বাংলাদেশে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন; তার অধিকাংশ জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। দেশের বিভাগীয় শহর ও মেডিকেল কলেজগুলোয় বর্তমানে স্বতন্ত্র হৃদরোগ বিভাগ চালু আছে এবং এর মাধ্যমে দেশের প্রান্তিক মানুষ হৃদরোগের চিকিৎসা পেয়ে আসছেন।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন ১৯৭৯ সালে ব্রিগেডিয়ার (অব.) মালিক ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে বেসরকারিভাবে হৃদরোগ প্রতিষ্ঠান চালু করেন। বর্তমানে সারা দেশে এর বিভিন্ন শাখার মাধ্যমে হৃদরোগের চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছে।
বাংলাদেশ মেডিকেল ইউনিভার্সিটি, ইব্রাহিম কার্ডিয়াক সেন্টারসহ ঢাকায় সিকদার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতাল, ইউনাইটেড হাসপাতাল, স্কয়ার হাসপাতাল, এভারকেয়ার হাসপাতালসহ বিভিন্ন করপোরেট হাসপাতালে ঢাকায় হৃদরোগীদের আধুনিক চিকিৎসাসেবা শুরু করে। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, দিনাজপুর সিরাজগঞ্জ ও ময়মনসিংহ শহরে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালগুলো চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে ১৮ কোটি মানুষের জন্য অভিজ্ঞ ও নবীন বিশেষজ্ঞ আনুমানিক ১২০০ হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ, ২০০ কার্ডিয়াক সার্জন, শিশু হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ৪০, শিশু কার্ডিয়াক সার্জন ১৫, ভাসকুলার সার্জন ৬০ জন কর্মরত আছেন। এ সংখ্যা বিশাল জনগোষ্ঠীর
জন্য অত্যন্ত অপ্রতুল, এর মধ্যে অধিকাংশই ঢাকায় কর্মরত। এ ছাড়া কার্ডিয়াক নার্স, ক্যাথল্যাব টেকনিশিয়ান, পারফিউশনিস্ট, কার্ডিয়াক অ্যানেসথিসিওলজিস্টের সংখ্যা অত্যন্ত অপ্রতুল। চিকিৎসকের পাশাপাশি অভিজ্ঞ সহায়ক শক্তির ভূমিকা হৃদরোগের বিভিন্ন বিভাগে চিকিৎসক সেবার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এত অপ্রতুলতার মধ্যে গত চার দশকে হৃদরোগ চিকিৎসা উন্নতি প্রশংসনীয়। বাংলাদেশ থেকে হৃদরোগ চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যাওয়ার হারও অনেকাংশে কমে এসেছে।
তারপরও বাস্তবে হৃদরোগ চিকিৎসার অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে শুধু করোনারি আর্টারি ডিজিজ ও হার্ট অ্যাটাকে এনজিওগ্রাম ও অ্যানজিওপ্লাস্টির ক্ষেত্রে। বাংলাদেশে ৯১টি ক্যাথল্যাবে প্রায় ২০০ জন ইন্টারভেনশন কার্ডিওলজিস্ট করোনারি এনজিওগ্রাম ও স্ট্যান্টিং করে থাকেন। এর মধ্যে ৬৩টি ক্যাথল্যাব শুধু ঢাকায়। তাই দেশের অধিকাংশ রোগীকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আসতে হচ্ছে। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জে নিয়মিতভাবে এনজিওগ্রাম ও এনজিওপ্লাস্টি চিকিৎসা হচ্ছে। কিন্তু হৃদরোগের অন্যান্য চিকিৎসা যেমন—ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট (রোগীর ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকের পর হার্ট ফেইলিউর ও শকে চলে গেলে বিভিন্ন ডিভাইস প্রতিস্থাপনের পর এনজিওগ্রাম ও এনজিওপ্লাস্টি অথবা বাইপাস সার্জারি), জটিল জন্মগত হার্টে ত্রুটিজনিত রোগ, হার্ট ফেইলিউরজনিত জটিলতার জন্য আধুনিক ডিভাইস প্রতিস্থাপন ইত্যাদি চিকিৎসার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে পড়েছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশে নিয়মিতভাবে এ ধরনের চিকিৎসা হচ্ছে, তাই আমাদের রোগী দেশের বাইরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।
একইভাবে কার্ডিয়াক সার্জারির ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য শুধু বাইপাস সার্জারির ক্ষেত্রে। প্রায় ২০০ জন অভিজ্ঞ ও নবীন বিশেষজ্ঞ সার্জন সারা দেশে প্রায় ৩০টি অপারেশন থিয়েটারে নিয়মিত বাইপাস সার্জারি করে থাকেন। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, সিরাজগঞ্জ, দিনাজপুরে এই কার্ডিয়াক সার্জারি হয়ে থাকে। প্রায় ৯০ শতাংশ বাইপাস সার্জারি ঢাকার ওপর নির্ভরশীল।
বাইপাস সার্জারির বাইরে হার্টের অন্যান্য অপারেশনে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে। যেমন: জটিল ভালভের অপারেশন, জটিল শিশুদের জন্মগত হার্টের ত্রুটির অপারেশন, অ্যাওর্টিক সার্জারি (বুকের ভেতর বড় নালির সমস্যাজনিত), কার্ডিয়াক ট্রান্সপ্লান্টেশন ইত্যাদি। এ ধরনের চিকিৎসার জন্য প্রচুর রোগী এখনো দেশের বাইরে যাচ্ছেন।
আপনারা জানেন, হৃদরোগ অত্যন্ত জটিল রোগ। এ রোগে আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ রোগী মৃত্যুবরণ করেন। যারা বেঁচে থাকেন তাদের জটিলতার মধ্যে যেতে হয়; তাই আজীবন মেডিসিন খেতে হয়। হৃদরোগজনিত চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল; কিন্তু বাংলাদেশে হেলথ ইন্স্যুরেন্স চালু নেই বিধায় রোগীদের পুরো চিকিৎসা ব্যয় নিজেদের করতে হয়। তাই বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাই হওয়া উচিত চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রধান আলোচ্য বিষয়। (Preventiom is better than Cure); কিন্তু দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যবস্থায় এটা অত্যন্ত অবহেলিত।
হার্ট অ্যাটাক ও হার্টের রক্তনালির রোগ বাংলাদেশে ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে। আমরা যারা ২৫ বছর ধরে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করে যাচ্ছি, তারা অবাক বিস্ময়ে হতাশা নিয়ে পরিস্থিতির জটিলতা অনুভব করছি। দুই দশক আগেও হার্ট অ্যাটাক ৬০ বছর বয়সে বেশি পরিলক্ষিত হতো। কিন্তু এখন আর বয়স মানছে না এই রোগ, ৩০ থেকে ৪০ বছরের যুবকদের মধ্যে ইদানীং হার্ট অ্যাটাকের প্রবণতা বাড়ছে।
নাসির উদ্দিন, বয়স ৪০ বছর। বুকে ব্যথা নিয়ে আমার চেম্বারে এলে এনজিওগ্রাম করে তার রক্তনালিতে বড় ধরনের ব্লক দেখতে পাই। বড় দুটি নালিতে ১০০ শতাংশ ব্লক (LAD & LCX 100%) আরেকটি রক্তনালিতে ৯৯ শতাংশ ব্লক (LCX 99%) দেখতে পাই। এই অল্প বয়সে এ ধরনের ব্লক চিকিৎসা বিজ্ঞানের জন্য অবাক বিস্ময় এবং বেঁচে থাকাটাও তার চেয়ে বিস্ময়কর।
তরুণ ও যুবকদের অল্প বয়সে এ ধরনের জটিল ব্লকের কারণ খোঁজার জন্য বড় ধরনের গবেষণা কর্মের প্রয়োজন। শুধু খাবারদাবার, লাইফ স্টাইল, ধূমপান, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, অতি কোলেস্টেরল—এসব সাধারণ কারণ দিয়ে Premature Ischemic Heart Disease ব্যাখ্যা করা যাবে না। এ ধরনের জেনেটিক্সধর্মী গবেষণার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। তাই সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে। রোগের কারণ না জানলে এর প্রতিরোধ ও প্রতিকার করা অসম্ভব।
হৃদরোগ প্রতিরোধের (Cardiac Diseases Prevention & Control) পাশাপাশি হৃদরোগে আক্রান্ত রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে এলে তাকে পূর্ণ সুস্থ করে কর্মক্ষেত্রে ফিরিয়ে আনা এবং ফের এ রোগে আক্রান্ত না হওয়ার চিকিৎসা ব্যবস্থাকে কার্ডিয়াক রিহেবিলিটেশন (Cardiac Rehabilitation) বলা হয়। বাংলাদেশের এ চিকিৎসা ব্যবস্থা শূন্যের কোঠায়। এ চিকিৎসা ব্যবস্থায় রোগীরা ফের কাজে ফিরে গিয়ে পরিবার ও দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখতে সহায়ক করবে। এ ছাড়া রোগীদের ফের অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যু রোধ করতে সহায়ক হবে।
২০২৫ সালের বিশ্ব হার্ট দিবসের স্লোগান ‘Don’t miss a beat’ মানে ‘প্রতিটি হৃৎস্পন্দনের গুরুত্ব দিন’। বাংলাদেশে হৃদরোগের ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে হলে হৃদরোগের প্রতিটি বিভাগের চিকিৎসা উন্নয়নকল্পে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ানসহ সব সহযোগী শক্তিদের সংখ্যা বৃদ্ধিসহ তাদের পেশাগত জ্ঞান আন্তর্জাতিকমানের করার ব্যবস্থা নিতে হবে। হৃদরোগ চিকিৎসা যন্ত্রপাতি ও ডিভাইসগুলোকে জীবনরক্ষাকারী হিসেবে দেখিয়ে ট্যাক্স ফ্রি করতে হবে। এসব যন্ত্রপাতি বাংলাদেশে আমদানি ক্ষেত্রেও জটিলতা কমাতে হবে। প্রয়োজনে দেশে প্রস্তুত করার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়ন করা প্রয়োজন। সর্বোপরি, রোগ প্রতিরোধের জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে সব পেশাজীবী ও সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তাহলেই আমরা সবাই আমাদের প্রতিটি হৃৎস্পন্দনের যত্ন নিতে পারব।
ডা. মহসীন আহমদ
অধ্যাপক, হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ
মন্তব্য করুন