

অর্থশাস্ত্রে ট্রিকল ডাউন বা চুইয়ে পড়া নীতি নামে একটি তত্ত্ব আছে—যার মূল কথা হলো, অর্থনীতিতে একটি শ্রেণিকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হতে থাকলে, ওই শ্রেণির আয় বাড়তে বাড়তে এক সময় উপচে পড়বে। আর এই উপচে পড়া আয় সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণি পেয়ে তারা সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। ব্যাংক মার্জিংয়ের সিদ্ধান্ত সম্ভবত ওই ধারণা থেকে উৎসারিত। মার্জিংয়ের পক্ষে যুক্তি দেখানো হয়, সবল ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংক একীভূত করা হলে, দুর্বল ব্যাংকও তার সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারবে সবল ব্যাংকের পারিতোষিকে। গত সরকারের শেষের দিকে কয়েকটি ব্যাংককে মার্জিংয়ের জন্য সবল ব্যাংকগুলোকে তাদের পছন্দ ব্যক্ত করতে বলা হলে, কোনো ব্যাংকই সাড়া দেয়নি। বরং এমন বক্তব্য এসেছিল—ভালো ফলের সঙ্গে পচা ফল রাখলে ভালোটাতেও পচন ধরতে পারে। তবে তখন চমক দেখায় এক্সিম ব্যাংক; তারা পদ্মা ব্যাংককে সঙ্গে নিতে রাজি হয়। শোনা যায়, এক্সিম ব্যাংকও স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ সিদ্ধান্ত নেয়নি—তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রীর চাপে এক্সিম ব্যাংকের তখনকার চেয়ারম্যান অনুরোধে ঢেঁকি গিলেছিলেন। যার প্রমাণ পরবর্তী সময়ে পাওয়া গেল—ওই ব্যাংকের নতুন পরিচালনা পর্ষদ দায়িত্বে আসার সঙ্গে সঙ্গে ঘোষণা দিল, তারা পদ্মাতে অবগাহন করতে চায় না। শেষ পর্যন্ত একটা জিনিস পরিষ্কার হলো যে, দেশে কোনো সবল ব্যাংকই দুর্বল ব্যাংককে মার্জিংয়ের মাধ্যমে অন্তর্ভুক্ত করতে চায় না। অর্থাৎ, মার্জিং ফোবিয়া শুধু আমানতকারীদের মধ্যে নেই, স্বয়ং ব্যাংক মালিকদের মধ্যেও স্থান করে নিয়েছে।
বাংলাদেশের ব্যাংকিংয়ে মার্জিং নতুন কিছু নয়। দেশ স্বাধীনের পরপর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যত ব্যাংক ছিল, সবকটি ব্যাংককে জাতীয়করণ করা হয়; যার মধ্যে বেশিরভাগই হয়েছে মার্জিংয়ের মাধ্যমে। যেমন—ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, ব্যাংক অব বাহাওয়ালপুর লিমিটেড ও প্রিমিয়ার ব্যাংক লিমিটেড মার্জ হয়ে সোনালী ব্যাংক গঠিত হয়। হাবিব ব্যাংক লিমিটেড ও কমার্স ব্যাংক লিমিটেড মার্জ হয়ে অগ্রণী ব্যাংক গঠিত হয়। ইউনাইটেড ব্যাংক লিমিটেড ও ইউনিয়ন ব্যাংক লিমিটেড মার্জ হয়ে জনতা ব্যাংক গঠিত হয় এবং মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেড ও অস্ট্রেলেসিয়া ব্যাংক লিমিটেড মার্জ হয়ে রূপালী ব্যাংক গঠিত হয়।
স্বাধীনের পরপর যেহেতু নতুন ব্যাংকিং সিস্টেম চালু হয়, তা নিয়ে সাধারণ মানুষের আস্থা-অনাস্থার প্রশ্ন ওঠেনি। তা ছাড়া তখন ব্যাংকের সঙ্গে জনসাধারণের অন্তর্ভুক্তি ছিল একেবারেই নগণ্য। এর পরে যত ব্যাংক মার্জিংয়ে গেছে, তা হচ্ছে—সবল ব্যাংক অন্য ব্যাংককে অ্যাকুইজিশনের ইতিহাস। যেমন, ২০০০ সালে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক এএনজেড গ্রিন্ডলেজ ব্যাংককে একীভূত করে। ২০০১ সালে ব্যাংক এশিয়া ব্যাংক অব নোভা স্কশিয়া এবং পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানের মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেডকে (এমসিবি) একীভূত করে তাদের ব্যাংকের পরিধি বাড়িয়েছে।
কিন্তু দুর্বলের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংক মিলে মার্জিংয়ে গেছে সে ইতিহাস দেশেও নেই, বিদেশেও নেই। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষণা দিয়েছে পাঁচটি দুর্বল ইসলামী ব্যাংককে প্রথমেই মার্জিংয়ে নিয়ে আসা হবে। এই দুর্বল ব্যাংকগুলো হচ্ছে—ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক একদিকে ঘোষণা দিয়েছে, এ পাঁচটি ব্যাংক দুর্বল; তাই জনগণের কাছে অনেক প্রশ্ন সামনে এসেছে। যেমন—
ক. দেশে ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে এ পাঁচটি ব্যাংকই কি সবচেয়ে বেশি দুর্বল?
খ. এ পাঁচটি ব্যাংককে ২০২৪ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক কি ক্যামেল রেটিংয়ে অসন্তোষজনক বলে ঘোষণা দিয়েছিল?
গ. খেলাপি ঋণের হার এ ব্যাংকগুলোর চেয়ে অন্য কোনো ব্যাংকে কি বেশি নেই?
ঘ. অনেক দুর্বল ব্যাংকের মার্জিংয়ের ফলে সবল ব্যাংকে পরিণত হয়েছে বলে কোনো অতীত অভিজ্ঞতা আছে?
ঙ. সরকার ৩৫ হাজার কোটি টাকা মূলধন দেওয়ার পরও জনগণের আস্থা ফিরে না আসার কারণে যদি প্রস্তাবিত এ বিশাল ব্যাংক দাঁড়াতে না পারে, তার দায় কেউ কি নেবে?
চ. পাঁচটি ব্যাংকে ফরেনসিক অডিট করে ওই পাঁচটি ব্যাংককে মার্জারের আওতায় আনা হলে বাকি ৫৬টি ব্যাংককে ফরেনসিক অডিট করা থেকে সরকার নির্বৃত্ত থাকল কেন? ৬১টি ব্যাংকে ফরেনসিক অডিট করে সবচেয়ে বেশি দুর্বল ব্যাংক কোনটি, তা নিরূপণ করা যুক্তিযুক্ত ছিল না? বাংলাদেশ ব্যাংক সারাক্ষণই বলছে এ পাঁচটি ব্যাংক দুর্বল, তাই জনগণ জানতে চায় বাকি ৫৬টি ব্যাংক কি তাহলে সবল? সবকটি ব্যাংকে ফরেনসিক অডিট করার পর বাংলাদেশ ব্যাংক বলতে পারবে যে, সবচেয়ে দুর্বল এই এই ব্যাংক; কিন্তু তা না করে যে পাঁচটি ব্যাংকে ফরেনসিক অডিট করা হলো, সে পাঁচটিকেই শুধু দুর্বল বলে প্রচার করা হচ্ছে। এটা কি অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত নয়?
সবচেয়ে বেশি দুর্বল ঘোষণা দিয়ে যে পাঁচটি ব্যাংককে মার্জারের আওতায় আনা হচ্ছে, এর উদ্দেশ্য হচ্ছে—একটি শক্তিশালী ব্যাংকে পরিণত করা। কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে, পাঁচটি শূন্য যোগ করলে যে একটি ‘বিগ জিরো’ হতে পারে, তার সম্ভাবনা তো উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এ পাঁচটি ব্যাংক যদি প্রকৃত অর্থেই দুর্বল ব্যাংক হয়, তাহলে দেশে চিহ্নিত সবল ব্যাংকের সঙ্গে এ ব্যাংকগুলোকে মার্জিংয়ে আনা যুক্তিযুক্ত নয় কি? কোন বিবেচনায় শুধু এ ব্যাংকগুলোকে মার্জিংয়ে আনা হচ্ছে, তা বোধগম্য নয়।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণ মনিটরিংয়ের অংশ হিসেবে প্রতিটি ব্যাংকের বড় শাখাগুলো বছরে অন্তত একবার ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা, বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরীক্ষা বিভাগ কর্তৃক নিরীক্ষা এবং এক্সটার্নাল অডিট তথা অনুমোদিত অডিটর (সিএ ফার্ম) কর্তৃক নিরীক্ষা করা হয়, যার মাধ্যমে প্রতি বছরান্তে খেলাপি ঋণের পরিমাণ নির্ধারণকরতঃ ওই ব্যাংকের সঞ্চিতি নির্ধারণপূর্বক নিট মুনাফা হিসাবায়ন করে শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দেওয়া হয়। দেশীয় নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের (বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরীক্ষা বিভাগসহ) ওপর আস্থা(?) রাখতে না পারায়, সরকার বিদেশি প্রতিষ্ঠান দিয়ে ব্যাংকগুলোর অডিট (ফরেনসিক অডিট) করানোর প্রক্রিয়া শুরু করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরীক্ষা বিভাগের দৃষ্টিতে যে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫ শতাংশের নিচে, তা ফরেনসিক অডিটরদের মতে হয়ে যাচ্ছে অস্বাভাবিকভাবে বেশি।
ব্যাংকে খেলাপি নির্ধারণে দুটি পদ্ধতি রয়েছে—একটি মেয়াদোত্তীর্ণের ভিত্তিতে, অন্যটি গুণগত মানের ভিত্তিতে। যেমন—একটি ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে এক বছর আগে। সেটি মেয়াদোত্তীর্ণের ভিত্তিতে মন্দ ঋণ হিসেবে শ্রেণীকরণ যোগ্য। একটি ঋণের মেয়াদ অতিক্রান্ত হয়নি; কিন্তু ঋণগ্রহীতা মৃত্যুবরণ করেছেন। ঋণটি ফেরত আসার সম্ভাবনা কম বিধায় সেটি গুণগত মানে শ্রেণীকরণ যোগ্য। গুণগত মানে শ্রেণীকরণ করতে চাইলে ছুতানাতা ধরে যে কোনো ঋণকে খেলাপি হিসেবে শ্রেণীকরণ করা যায়, এতদিন কোনো নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান করেনি। বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে যখন এসেছে, তারা গুণগত শ্রেণীকরণ এড়িয়ে যায়নি। যেমন—স্টক রিপোর্টে স্টকের ভ্যালু কম, তিন বছরের অডিটেড ব্যালান্স শিট নেই, অ্যাকাউন্টে টার্নওভার কম, সিকিউরিটি ভ্যালু ঋণের পরিমাণের চেয়ে কম, মর্টগেজ রেজিস্টার্ড নয়, ঋণের টাকা গ্রাহকের অন্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, ক্রেডিট রেটিং করানো হয়নি, ইন্টারনাল ক্রেডিট রিস্ক গ্রেডিং সিস্টেমে স্কোর কম ইত্যাদি কারণগুলো এতদিন খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি, যা বিবেচনায় নেওয়ায় বিদেশি নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে গুণগত মানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যায় অস্বাভাবিক হারে।
বাংলাদেশ থেকে পাচারকৃত অর্থের হিসাব সুইস ব্যাংক থেকে শতচেষ্টার পরও কোনো সরকারই নিতে পারেনি। কারণ, ওই ব্যাংক তাদের গোপন তথ্য প্রকাশ করবে না। আর আমাদের পুরো ব্যাংকিং সিস্টেমের তথ্য বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দিলাম, যে তথ্য বিশ্ববাসীর কাছে হয়তো চলে যেতে পারে। বিষয়টি কোনদিক থেকে প্রণিধানযোগ্য, তা বোধগম্য নয়।
ব্যাংকের ঋণ শ্রেণীকরণের পরিমাণ হঠাৎ করে অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়ে দিয়ে আমানতকারীদের ফোবিয়াও অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ফরেনসিক অডিট দিয়ে সুবিধা আহরণের চেয়ে অসুবিধাকেই বেশি আহ্বান করা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।
কোন কোন ব্যাংক দুর্বল ও কোন কোনটি সবল, তা জনগণ যেন বুঝতে পারে তার মাপকাঠি হচ্ছে ক্যামেলস রেটিং। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি বছর সব ব্যাংকের রেটিং প্রকাশ করে। ২০২৪ সালের জুনভিত্তিক CAMELS (Capital Adequacy, Asset Quality, Management, Earnings. Liquidity and Sensitivity to Market Risk) রেটিং প্রকাশ করে। ওই তালিকায় স্ট্রং (সবল) বা ‘এ’ শ্রেণির কোনো ব্যাংক এ দেশে পাওয়া যায়নি। সন্তোষজনক বা ‘বি’ শ্রেণিতে ৪০টি ব্যাংকের নাম রয়েছে তার মধ্যে এক্সিম ব্যাংক ছিল দ্বিতীয় নম্বরে। আরও মজার ব্যাপার হলো, এ ৪০টি ব্যাংকের মধ্যে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকও রয়েছে। পরবর্তী গ্রেড অর্থাৎ ফেয়ার ব্যাংক বা ‘সি’ শ্রেণিতে আছে আটটি ব্যাংক, যেখানে আছে উত্তরা ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, এনআরবিসি ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, এবি ব্যাংক ও অগ্রণী ব্যাংক। এর পরবর্তী গ্রেড অর্থাৎ মার্জিনাল ব্যাংক বা ‘ডি’ শ্রেণিতে আছে বেসিক ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক ও জনতা ব্যাংক। আর সবচেয়ে দুর্বল শ্রেণি তথা অসন্তোষজনক বা ‘ই’ শ্রেণিতে আছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক।
আমাদের বোধগম্য নয় যে, CAMELS রেটিংয়ে ‘ই’ শ্রেণি ও ‘ডি’ শ্রেণির ব্যাংকগুলোকে সর্বাগ্রে মার্জিংয়ের আওতায় আনা যেখানে যুক্তিযুক্ত, সেখানে ‘বি’ শ্রেণির ব্যাংক নিয়ে এত টানাটানি কেন? তবে হ্যাঁ, একটি ব্যাংক যে শ্রেণিতে থাকুক না কেন, সে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ যদি চায় যে, তারা মার্জিংয়ে যেতে চায়, সে স্বাধীনতা তো তাদের আছে।
‘ডি’ ও ‘ই’ শ্রেণির ব্যাংক ব্যতিরেকে অন্য শ্রেণির ব্যাংককে মার্জিংয়ে আসার জন্য বাধ্য করা দেশের আর্থিক খাতে একটি খারাপ নজির হয়ে থাকবে বলে মনে হয়। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, যে পদ্মা ব্যাংক নিয়ে মার্জিংয়ের প্রসঙ্গের অবতারণা, সে পদ্মা ব্যাংক আলোচনাতেই নেই। CAMELS রেটিংয়ে অসন্তোষজনক (দুর্বল) হিসেবে চিহ্নিত কোনো ব্যাংক নিয়েই বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো মাথাব্যথা আছে বলে প্রতীয়মান হয়নি। তা ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের CAMELS রেটিং দেখে যারা ভালো ব্যাংক বলে বিবেচনায় নিয়ে (যেমন ‘বি’ শ্রেণি) তাদের বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, এক বছরের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক যদি ওই ব্যাংককে সবচেয়ে দুর্বল ব্যাংক ঘোষণা দিয়ে মার্জিংয়ে আনতে চায়, তাহলে গ্রাহকরা প্রকারান্তরে ওই রেটিং দ্বারা নেতিবাচক-প্রভাবিত হয়নি?
মার্চ ২০২৫-এর হিসাব অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ জনতা ব্যাংকে ৭৪ দশমিক ৭৮ শতাংশ, অগ্রণী ব্যাংকে ৪১ দশমিক ৩৫ শতাংশ, রূপালী ব্যাংকে ৩৫ দশমিক ৬২ শতাংশ, বেসিক ব্যাংকে ৬৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে ৪৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ, সোনালী ব্যাংকে ২১ দশমিক ১১ শতাংশ ছিল। এ ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের ভারে জর্জরিত হওয়ার পরও এই ব্যাংকগুলোর মার্জিংয়ের প্রশ্ন উঠছে না এবং ফরেনসিক অডিট করারও প্রয়োজন অনুভব করছে না সরকার। বিষয়টি রহস্যজনক বটে।
দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণের দিক থেকে শীর্ষে ১০ ব্যাংক হলো জনতা ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, ইসলামিক ব্যাংক, এবি ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক ও ওয়ান ব্যাংক। মজার ব্যাপার হলো, মার্জিংয়ের জন্য বিবেচিত একটি ব্যাংকও এ ১০টির মধ্যে নেই।
দেশে ব্যাংক খাতে নতুন সংকটের নাম হচ্ছে মার্জিং ফোবিয়া। একটি ব্যাংকের আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক সেদিন বললেন—ভাই, প্রতিদিন অন্তত দুইশ ফোনকল পাই, যাদের জিজ্ঞাস্য হলো মার্জিংয়ের আগে তাদের টাকাটা দেওয়া যাবে কি না। এ থেকে বোঝা যায়, মার্জিং ফোবিয়া কোন স্তরে গিয়ে ঠেকেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বারবার বলছে, মার্জিংয়ের পর আমানতকারীদের কোনো সমস্যা হবে না। তাহলে কি ধরে নেওয়া হচ্ছে যে, সরকার মার্জিংয়ের জন্য যে ৩৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিচ্ছে, তা থেকে দুর্বল ব্যাংকের সব আমানতকারীর অর্থ ফেরত দিয়ে দেওয়া হবে? আর যদি তা-ই হয়, আমানতকারীরা যদি তাদের আমানত তুলে নিতে পারে বা তুলে নিয়ে যায়, তাহলে আমানত শূন্য হয়ে ওই বিরাট (?) ব্যাংক কি বিরাট থাকতে পারবে? তার নমুনা এরই মধ্যে দেখা যাচ্ছে ওই পাঁচটি ব্যাংকে যেসব করপোরেট ডিপোজিট আছে, ওইসব করপোরেট প্রতিষ্ঠান তাদের স্থায়ী আমানত ভাঙানোর জন্য চিঠি দিয়ে রেখেছে যে, আমানত তোলার জন্য তারা দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি সরকারি প্রায় প্রতিষ্ঠান তাদের আমানত হিসাব বন্ধ করার জন্য পত্র দিচ্ছে। মার্জিংয়ের পর যদি ওইসব প্রতিষ্ঠানের আমানত ফেরত দিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে ব্যাংকগুলো কীসের ওপর দাঁড়াবে?
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কর্মকর্তারা আমানতের জন্য গ্রাহকের দ্বারে দ্বারে ঘোরেন না। বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তারা তার ব্যতিক্রম; সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে নিজেদের আত্মীয়স্বজনকে অনুপ্রাণিত ও প্রভাবিত করে আমানত সংগ্রহ করেন তারা। মার্জিংয়ের পর ওইসব কর্মকর্তা যে আগের স্পিডে আমানত সংগ্রহ করবেন, তার নিশ্চয়তা আছে কি? বরং উল্টো নিজেদের আত্মীয়স্বজন থেকে আনা আমানত ফেরত দিয়ে নিজেদের দায়মুক্ত করার চেষ্টা চালাবেন বলে প্রতীয়মান হয়।
যে মার্জিং ফোবিয়া আমানতকারীরা বয়ে চলেছেন, তা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া সম্ভব নয়। বরং মার্জিংয়ের ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে পরিত্রাণের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা হাতে নেওয়া জরুরি, যাতে আমানতকারীদের আস্থার সংকট না হয়। মার্জিং জোর-জবরদস্তির ব্যাপার নয়। জোর-জবরদস্তির মাধ্যমে মার্জিং হলে মালিকপক্ষের মধ্যে যেমন আন্তঃসংযোগ-সংকট থাকবে, তেমনি কর্মকর্তাদের মধ্যেও আন্তরিকতা বা ফেলো ফিলিংসের অভাবে ব্যাংকের ব্যবসা ত্বরান্বিত না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। সর্বোপরি মার্জকৃত ব্যাংকগুলো একটি অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে এগোবে বলে প্রতীয়মান হয়। যে ব্যাংক দুর্বল থেকে দুর্বলতর হতে থাকবে, তাকে দেউলিয়া আদালতে যাওয়ার ব্যবস্থা করাই সমীচীন নয় কি? মার্কিন মুলুকে যা আমরা হরহামেশাই দেখতে পাই। তবে এটা মনে রাখা দরকার যে, কোনো ব্যাংক সম্পর্কে সরকারি কর্মকর্তারা ‘দুর্বল’, ‘দেউলিয়া’, ‘অচল’ ইত্যাদি বিশেষণে-বিশেষায়িত করলে আমানতকারীদের ফোবিয়া নতুন মাত্রা পায়। এ মাত্রাজ্ঞান অনেক সরকারি কর্মকর্তার নেই বলে প্রতীয়মান হয়েছে। কথিত দুর্বল ওই ব্যাংকগুলো দিন দিন দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে শুধু ফোবিয়া সৃষ্টির কারণে। এর দায় কি ওই সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর বর্তায় না!
পাঁচটি ব্যাংক ছাড়াও অনেক ব্যাংককে মার্জিংয়ের আওতায় নিয়ে আসার খবর আমানতকারীদের মধ্যে মার্জিং ফোবিয়ার জন্ম দিয়েছে, যে কারণে অনেক ব্যাংকে আমানত প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক হচ্ছে, অর্থনীতির জন্য যা সুখকর সংবাদ নয়। এ পরিস্থিতি থেকে আমানতকারী ও ব্যাংক খাত রক্ষা করা সময়ের দাবি।
প্রাক্তন ব্যাংকার, অর্থনীতি সমিতি-চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের ভাইস প্রেসিডেন্ট
মন্তব্য করুন