মোহাম্মদ আবদুল মান্নান
প্রকাশ : ৩০ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ৩০ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:২৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ইসলামী ব্যাংকিং: সংকট ও সম্ভাবনা

ইসলামী ব্যাংকিং: সংকট ও সম্ভাবনা

কয়েক দশক আগেও ইসলামী ব্যাংকিং ছিল তাত্ত্বিক আলোচনার বিষয়। কিন্তু ইসলামী ব্যাংকিং শুরুর মাত্র কয়েক দশকে বিশ্বজনীন স্বীকৃতি পেয়েছে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বহিঃবিচিত্র আর্থসামাজিক পরিবেশে এ ব্যাংক সফলতা পেয়েছে। ফলে দ্রুত এ নতুন ব্যাংকিং মডেলটি সার্বজনীন ও বিশ্বজনীন ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। আধুনিক দুনিয়ায় ইসলামী ব্যাংকিংয়ের গল্পটা খুব বেশি পুরোনো নয়। ১৯৭০-এর দশকে অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশনের (ওআইসি) কয়েকটি সম্মেলনের মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। ওআইসির অর্থমন্ত্রীদের ১৯৭৪ সালে আইডিবি সনদ স্বাক্ষর এবং ১৯৭৫ সালে এর প্রতিষ্ঠার পর ১৯৭৮ সালে ইসলামী পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের ডাকার সম্মেলনে ইসলামী ব্যাংকের সংজ্ঞা অনুমোদিত হয়। এ সময় বিভিন্ন দেশে ইসলামী ব্যাংকিং শুরু হয়।

বিশ শতকের শেষ নাগাদ বিভিন্ন দেশে ইসলামী ব্যাংকের সংখ্যা তিনশ ছাড়িয়ে যায়। সেইসঙ্গে এ সময়ের মধ্যে এই নতুন ব্যাংকিংয়ের পদ্ধতিগত বিপুল উন্নয়ন ঘটে। ইসলামী সম্মেলন সংস্থাভুক্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোর উদ্যোগে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের সর্বসম্মত কাঠামো প্রণয়নে পর্যায়ক্রমে অগ্রগতি অর্জিত হয়। ইসলামী ব্যাংকিং নীতি-পদ্ধতির সমন্বয়, সংযোগ ও সহযোগিতার ক্ষেত্র বিস্তৃত হয়। শরিয়াহবিষয়ক অ্যাকাউন্টিং ও অডিটিং এবং রেগুলেটরি তদারকির আন্তর্জাতিক বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। একাডেমিক গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও লিটারেসির পরিসরও বৃদ্ধি পায়।

ইসলামী ব্যাংকিংয়ের দ্রুত জনপ্রিয়তা ও বাজার সম্প্রসারণের পটভূমিতে সুদভিত্তিক বহু শীর্ষস্থানীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বহুজাতিক ব্যাংকিং গ্রুপ এ সময় তাদের গ্রাহকদের জন্যও ইসলামী প্রোডাক্ট ব্যবহার শুরু করে। তারা এ ক্ষেত্রে নানামুখী সেবা প্রসারের জন্য স্বতন্ত্র বিভাগ চালু করে।

ইসলামী ব্যাংকগুলো তাত্ত্বিক সফলতার পর পদ্ধতিগত উন্নয়নেও অনেকটা সফল হয়েছে। এখন এ ব্যাংকিং পদ্ধতি উদ্দেশ্যগত লক্ষ্য হাসিলে কতটা সফল হয়েছে, সে ব্যাপারে অনেকেই আরও বেশি মনোযোগ দেওয়ার তাগিদ অনুভব করছেন। বিশ্বব্যবস্থাকে অধিকতর মানবিক করতে ইসলামী ব্যাংকিং এ পথেই দিকনির্দেশকের ভূমিকা পালন করতে পারবে।

বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং

সুদমুক্ত ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বাংলাদেশের জনগণের বিপুল আগ্রহের পেছনে বড় ধরনের ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে। এ দেশের কৃষিজীবী জনগণ বহু বছর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ছিল। এ পটভূমিতে এ অঞ্চলের মানুষের অস্থি-মজ্জায় সুদভিত্তিক পদ্ধতির প্রতি একটা অনাগ্রহ জন্মেছে। তার বদলে তারা বিকল্প পদ্ধতির প্রতি বিশেষভাবে আগ্রহী ছিল। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮২ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন উদ্যোগের পাশাপাশি ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ইসলামী ইকোনমিকস রিসার্চ ব্যুরো, বায়তুশ শরফ ইসলামী গবেষণা সংস্থা, ওয়ার্কিং গ্রুপ ফর ইসলামী ব্যাংকিং ইন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইসলামিক ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিবা) প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান ইসলামী ব্যাংকিং বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নানা সহযোগী ভূমিকা পালন করে।

প্রথম ইসলামী ব্যাংকটির সফলতার পথ ধরে দেশে পর্যায়ক্রমে দেশের বেসরকারি ও সরকারি খাতে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত দেশের ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে ১০টি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংকসহ ৪১টি ব্যাংকে ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু হয়েছে। ১০টি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংকের ১ হাজার ৬৯৯টি শাখা ছাড়াও ১৭টি সরকারি ও বেসরকারি কনভেনশনাল ব্যাংক ৪১টি ইসলামী ব্যাংকিং শাখা কাজ করছে। এ ছাড়া ২১টি সরকারি-বেসরকারি কনভেনশনাল ব্যাংক ৯০৫টি ইসলামী ব্যাংকিং উইন্ডো চালু করে ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের জন্য বিদ্যমান ব্যাংকিং আইনে ইসলামী ব্যাংকিং পদ্ধতির কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘ইসলামী ব্যাংকিং গাইড লাইন’ প্রণয়ন করেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকে স্বতন্ত্র ইসলামী ব্যাংকিং বিভাগ চালু করেছে। ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রমের শরিয়াহ পরিপালনের নানা দিক তত্ত্বাবধানের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি শরিয়াহ অ্যাডভাইজরি বোর্ড গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ছাড়া ইসলামী ব্যাংকিং আইনের খসড়াও এরই মধ্যে তৈরি হয়েছে। ফলে এসব ইতিবাচক পদক্ষেপ দেশে ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রমে অধিকতর শৃঙ্খলা ও সুশাসন কায়েম হবে এবং ইসলামী ব্যাংকিংয়ের উদ্দেশ্যগত ও পদ্ধতিগত বিষয়গুলো যথার্থ মানে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে গতিশীলতা আসবে বলে এরই মধ্যে অংশীজনের মধ্যে আশাবাদ তৈরি হয়েছে।

প্রতিকূলতার পথযাত্রা

বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং গত চার দশকের বেশি সময় নানা প্রতিকূলতার পথ বেয়ে সাধারণ মানুষের গভীর আস্থা অর্জন করেছে। দেশের আর্থসামাজিক ও সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নে এ ব্যাংক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ২০১৬ সাল নাগাদ দেশের মোট আমানত, বিনিয়োগ, আমদানি-রপ্তানি, রেমিট্যান্স প্রভৃতি ক্ষেত্রে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ইসলামী ব্যাংকিং পদ্ধতির অধীনে পরিচালিত হয়। দেশের তৈরি পোশাক শিল্পসহ বিভিন্ন ধরনের শিল্প-কারখানা স্থাপন, এসএমই বিনিয়োগ, গ্রামীণ দারিদ্র্য দূরীকরণের নানা উদ্যোগ, সিএসআর, প্রভৃতিসহ দেশের আর্থিক ও সামাজিক খাত উন্নয়নে ইসলামী ব্যাংকগুলো বিস্ময়কর অবদান রাখে।

২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি দেশের বৃহত্তম ইসলামী ব্যাংক বিশেষ প্রক্রিয়ায় দখল করার মধ্য দিয়ে শুধু ইসলামী ব্যাংকিং নয়, দেশের সামগ্রিক ব্যাংক খাতে বড় রকমের দুর্যোগের সূচনা হয়। লন্ডনের ‘দি ইকোনমিস্ট’ ইসলামী ব্যাংক দখলের ঘটনাকে ‘ক্যু’ আখ্যা দিয়েছে। সে বছর অক্টোবর মাসে একই পদ্ধতিতে দখল করা হয় সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক। এভাবে ব্যাংক দখলের দুনিয়ায় নজিরবিহীন। এ ঘটনা আকস্মিক বিষয় ছিল না। ইসলামী ব্যাংকিং ধ্বংসের এ কাজ এক গভীর ছকের অংশ হিসেবে অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। এ নিয়ে দেশি-বিদেশি পত্রপত্রিকায় বিস্তর আলোচনাও হয়েছে। দেশের ব্যাংক খাতে বিপর্যয় সৃষ্টির বিষফল গোটা জাতি এখন ভোগ করছে।

বর্তমানে বিভিন্ন ইসলামী ব্যাংকের গভীর সংকট ইসলামী ব্যাংকিং সিস্টেমের কোনো দুর্বলতার ফল নয়। কিংবা সাধারণভাবে ব্যবসায়িক মন্দার কারণেও এ পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। রাজনৈতিক প্রভাব ও বলপ্রয়োগের মাধ্যমে এবং সুশাসন ধ্বংস ও পরিকল্পিত লুটপাটের মাধ্যমে এ ব্যাংকগুলোকে গোষ্ঠীবিশেষের তহবিল সংগ্রহের উৎস হিসেবে ব্যবহার করার মাধ্যমে এ পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে।

সংকট থেকে সম্ভাবনা আলো দেখা

বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের এ সময়ের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো পাঁচটি ‘দুর্বল’ শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংককে একীভূত করে একটি নতুন রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ইসলামী ব্যাংক গঠন। এজন্য ৩৫ হাজার ২০০ কোটি টাকার মূলধনের জোগান দেওয়ার ফলে এ ব্যাংকটি সর্বোচ্চ মূলধনি ব্যাংকরূপে দেশের সবচেয়ে বেশি শাখা নিয়ে এ ইসলামী ব্যাংকটি গণমানুষের মৌলিক চাহিদাকে অগ্রাধিকার দিয়ে এসএমই ধারায় পরিচালিত হওয়ার কথা রয়েছে। বিশেষভাবে এ ব্যাংকের প্রতিটি শাখার আমানতসংশ্লিষ্ট শাখার কমান্ড এরিয়ায় বিনিয়োগের বিষয় গুরুত্ব দেওয়া হবে। ফলে স্থানীয়ভাবে উদ্যোক্তা তৈরিতে এ ব্যাংক সক্রিয় ভূমিকা রাখার বিরাট সুযোগ তৈরি হবে। এর ফলে জনগণের সম্পদ ঢাকা-চট্টগ্রামের মুষ্টিমেয় লোকের হাতে পুঞ্জীভূত হওয়ার ট্র্যাডিশন থেকে মুক্ত হয়ে এ বড় ইসলামী ব্যাংকটির মাধ্যমে দীর্ঘ অবহেলিত গ্রামকেন্দ্রিক আর্থিক উন্নয়ন নতুন গতি ও প্রেরণা পাবে বলে আশা করা যায়। এ নীতি ইসলামী ব্যাংকিংয়ের বণ্টনমূলক সুবিচার নিশ্চিত করার জন্য অত্যাবশ্যক।

সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইসলামী ব্যাংক, বর্তমানে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

চলচ্চিত্রে অবদানের স্বীকৃতি পেলেন পরিচালক এইচ আর হাবিব

গণঅভ্যুত্থানের গণআকাঙ্ক্ষাই হলো সুষ্ঠু নির্বাচন : মাসুদ সাঈদী

হাসপাতালে মালাইকা অরোরা

সুন্দরবনে দস্যু বাহিনীর অস্ত্র সরবরাহকারী রহিম আটক

এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বিষয়ে নতুন সিদ্ধান্ত জানালেন শিক্ষা উপদেষ্টা

তানজিদের ব্যাটে নতুন ইতিহাস

শত বছরের ‘হাইত’ উৎসবে মাছ শিকারিদের ঢল

বেস্ট ওয়েস্টার্ন প্লাস বেহিলস হোটেলের সফট ওপেনিং ১৫ নভেম্বর

ঘরের সাধারণ এই ৬ খাবারই দূর করবে আপনার অনিদ্রা

মেডিকেল ট্যুরিজমে চমক এনেছে সুহা ট্র্যাভেলস থাইল্যান্ড

১০

সুদান / এল ফাশেরে ১৪ হাজারের বেশি বেসামরিক নিহত

১১

কারোর চাহিদা বিবেচনায় শাপলা কলি যুক্ত করা হয়নি : ইসি সচিব

১২

বসুন্ধরার আই ব্লকে উদ্বোধন করা হলো ‘হেরিটেজ সুইটস’র ২য় শাখা

১৩

সরকারি অফিসে শেখ মুজিবের ছবি টাঙানোর বিধান ইস্যুতে বিএনপির ক্ষোভ

১৪

চকরিয়ার ৮০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক নেই

১৫

এসএসসির ফরম পূরণের তারিখ ঘোষণা

১৬

জকসুতে নতুন ১০ পদ সংযোজনের দাবি ছাত্রদলের

১৭

চট্টগ্রাম চেম্বারের নির্বাচন স্থগিত করলেন আদালত

১৮

বিইউএফটিতে ‘ভয়েসেস ফর প্যালেস্টাইন : এ সলিডারিটি ইভেন্ট’ অনুষ্ঠিত 

১৯

বিশ্ববাজারে আবার বাড়ল স্বর্ণের দাম

২০
X