

বাংলাদেশে সিরামিক শিল্পের সম্ভাবনা কেমন? ভবিষ্যতে সিরামিকস ও টাইলস খাতে কী ধরনের বড় পরিবর্তন আসতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
এম এ রহিম: সিরামিক শিল্পে বাংলাদেশের সম্ভাবনা দিনদিন বাড়ছে। গুণগত মান বজায় রাখতে পারলে এবং প্রয়োজনীয় রাষ্ট্রীয় সহায়তা পেলে এই শিল্পটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা রাখতে পারবে। আগামী ৫ থেকে ১০ বছরে টাইলস ও সিরামিকস খাতে যে পরিবর্তন আসবে, সেটি মূলত তিনটি বড় দিককে কেন্দ্র করে হবে—প্রযুক্তিগত রূপান্তর, গ্রিন ম্যানুফ্যাকচারিং ও ডিজাইন।
প্রথমত, শিল্পে প্রযুক্তির ব্যবহার ভবিষ্যতকে পুরোপুরি বদলে দেবে। অটোমেশন, উন্নত ডিজিটাল প্রিন্টিং, রোবোটিক হ্যান্ডলিং এবং উন্নতমানের প্রোডাকশন লাইনের মাধ্যমে উৎপাদন আরও দ্রুত, নির্ভুল এবং খরচ সাশ্রয়ী হবে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী স্মার্ট টাইলস এবং সেন্সর ইন্টিগ্রেটেড পণ্যের জনপ্রিয়তা বাড়ছে, ভবিষ্যতে বাংলাদেশের বাজারেও এর প্রভাব পড়বে। দ্বিতীয়ত, পরিবেশবান্ধব উৎপাদন পদ্ধতি ভবিষ্যতের শিল্পের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং বৈশ্বিক রেগুলেশনগুলো বিবেচনায় এখন গ্রিন ম্যানুফ্যাকচারিং আর ‘অপশন’ নয়, এটি একটি ‘স্ট্যান্ডার্ড’। ভবিষ্যতে কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমানো, ওয়েস্ট হিট রিকভারি, জিরো ওয়েস্ট নীতি এবং পানির পুনর্ব্যবহার বাধ্যতামূলক হয়ে উঠবে। তৃতীয়ত, ক্রেতাদের আচরণেও বড় পরিবর্তন আসবে। আজকের ক্রেতা শুধু দাম দেখে সিদ্ধান্ত নেন না; তারা পণ্যের মান, নান্দনিকতা, টেকসই বৈশিষ্ট্য এবং ব্র্যান্ড ভ্যালু—সব কিছুর ওপর গুরুত্ব দেন। ডিজাইন ইনোভেশন, ডিফারেনশিয়েশন এবং কাস্টমার এক্সপেরিয়েন্স হবে ভবিষ্যতের মূল প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র।
ডিবিএল সিরামিকস কীভাবে এই ভবিষ্যৎ পরিবর্তনের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করছে?
এম এ রহিম: ডিবিএল সিরামিকস ভবিষ্যতের এই পরিবর্তনের জন্য এরই মধ্যে একটি শক্তিশালী রোডম্যাপ তৈরি করেছে। আমরা বিশ্বাস করি ইনোভেশন এবং সাসটেইনেবিলিটি আমাদের আগামী দিনের সবচেয়ে বড় চালিকাশক্তি।
উৎপাদনে আমরা ইতালিয়ান সর্বাধুনিক মেশিনারি ও প্রযুক্তি ব্যবহার করছি, যা আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। শুধু প্রোডাকশনেই নয়, আমরা ডিজাইন ও পণ্যের বৈচিত্র্যের দিকেও জোর দিচ্ছি। sTiles-এর মতো উদ্ভাবন আমাদের ইনোভেশন কালচারের একটি বাস্তব উদাহরণ, যেখানে উৎপাদনের সময় তৈরি হওয়া ফাইন ডাস্ট পুনর্ব্যবহার করে আমরা একটি সম্পূর্ণ নতুন পণ্যশ্রেণি তৈরি করেছি। একই সঙ্গে আমরা আমাদের উৎপাদন প্রক্রিয়াকে পরিবেশবান্ধব করার জন্য একাধিক উদ্যোগ নিয়েছি। এর মধ্যে আছে জিরো ওয়েস্ট পলিসি, ১০০ শতাংশ পানি পুনর্ব্যবহার, ওয়েস্ট হিট রিকভারি সিস্টেম এবং কো-জেনারেশন। এর মাধ্যমে আমরা শুধু পরিবেশ রক্ষা করছি না, শক্তি খরচও কমাচ্ছি এবং উৎপাদন দক্ষতাও বাড়াচ্ছি। আমরা বুঝি, ভবিষ্যতের প্রতিযোগিতা শুধু দামে হবে না; হবে মান, প্রযুক্তি এবং টেকসই মূল্যবোধে। সেই কারণেই ডিবিএল সিরামিকস এখন থেকেই ভবিষ্যতের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
ডিবিএল সিরামিকস বাংলাদেশের সিরামিক শিল্পে কীভাবে নিজেকে আলাদা করেছে?
এম এ রহিম: ডিবিএল সিরামিকস সব সময়ই বিশ্বাস করে যে, একটি শক্তিশালী ব্র্যান্ড তৈরি হয় শুধু পণ্য বিক্রির মাধ্যমে নয়; বরং মান, নকশা, প্রযুক্তি ও ভিশনের সমন্বয়ে। আমরা বাংলাদেশের সিরামিক শিল্পে নিজেদের আলাদা করেছি মূলত উচ্চমানের পণ্যের গুণগত নিশ্চয়তা, আন্তর্জাতিক মানের উৎপাদন প্রযুক্তি এবং গ্রাহককেন্দ্রিক ব্র্যান্ড ভিশনের মাধ্যমে।
আমাদের কারখানায় অত্যাধুনিক automated production system ব্যবহৃত হচ্ছে, যা পণ্যের মানের ধারাবাহিকতা ও নির্ভুলতা নিশ্চিত করে। পাশাপাশি আমাদের একটি দক্ষ ও প্রশিক্ষিত কর্মী বাহিনী রয়েছে; যারা শুধু উৎপাদন নয়, মান নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে প্রতিটি ধাপে নিখুঁত মনোযোগ দেয়। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিস্তৃত distribution network আমাদের দ্রুত ও কার্যকরভাবে ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দেয়, যা প্রতিযোগীদের থেকে একটি বড় পার্থক্য তৈরি করে। আমরা শুধু টাইলস বা সিরামিক প্রোডাক্ট বিক্রি করি না, আমরা এমন একটি lifestyle brand তৈরি করছি, যা নান্দনিকতা, আধুনিকতা ও টেকসই মানকে একসঙ্গে তুলে ধরে।
প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ডিবিএল সিরামিকসের সবচেয়ে বড় শক্তি কী বলে মনে করেন?
এম এ রহিম: আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো উদ্ভাবনী চিন্তাধারা এবং টেকসই উৎপাদনের সক্ষমতা। আজকের প্রতিযোগিতামূলক বাজারে যেখানে অনেক ব্র্যান্ড মূলত দাম ও পণ্যের প্রাপ্যতার ওপর নির্ভর করছে, আমরা সেখানে আলাদা করছি নিজেদের পণ্যের গুণগত মান, ডিজাইনের বৈচিত্র্য, পরিবেশবান্ধব উৎপাদন প্রক্রিয়া ও ব্র্যান্ড ভ্যালুর মাধ্যমে। আমাদের sTiles কালেকশন শুধু একটি প্রোডাক্ট নয়, এটি আমাদের উদ্ভাবনী দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন, যেখানে আমরা শিল্পের বাইপ্রোডাক্টকে কাজে লাগিয়ে নতুন মাত্রা যোগ করেছি। এ ছাড়া আমাদের উৎপাদন অবকাঠামো ইতালিয়ান টেকনোলজির ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, যা পণ্যের মানকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে গেছে। সবশেষে বলব, আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি শুধু কারখানায় নয়, আমাদের চিন্তায়। আমরা শুধু বাজারে টিকে থাকতে চাই না, বরং বাজারকে নেতৃত্ব দিতে চাই।
বর্তমানে সিরামিক শিল্পে যে কাঁচামাল ও জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, তা মোকাবিলায় ডিবিএল সিরামিকস কী ধরনের কৌশল নিচ্ছে?
এম এ রহিম: সাম্প্রতিক সময়ে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি এবং কাঁচামাল ও জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে সিরামিক শিল্প বড় ধরনের চাপের মুখে রয়েছে। তবে ডিবিএল সিরামিকস এই চ্যালেঞ্জকে শুধু সমস্যা হিসেবে না দেখে একটি কৌশলগত সুযোগ হিসেবে নিচ্ছে।
আমরা cost optimization ও energy efficiency-এর ওপর বিশেষ জোর দিয়েছি। উৎপাদন প্রক্রিয়ায় আমরা waste heat recovery system ব্যবহার করছি, যা উৎপাদনের সময় বের হওয়া তাপ পুনর্ব্যবহার করে শক্তি সাশ্রয় করে। এর ফলে আমাদের গ্যাস ও বিদ্যুৎ ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাচ্ছে। আমরা বিকল্প শক্তির উৎস ব্যবহারের দিকেও এগোচ্ছি, যাতে প্রথাগত জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা ধীরে ধীরে কমানো যায়। এই সবকিছু মিলিয়ে আমরা শুধু খরচ কমাচ্ছি না, উৎপাদন প্রক্রিয়াকে আরও টেকসই ও স্থিতিশীল করে তুলছি, যাতে বাজারের অস্থিরতা সত্ত্বেও গ্রাহকদের কাছে সাশ্রয়ী মূল্যে সেরা মানের পণ্য পৌঁছে দিতে পারি।
ডিজাইন ইনোভেশন ভবিষ্যতে কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে বলে মনে করেন?
এম এ রহিম: ডিজাইন ইনোভেশন আগামী দিনের বাজারে game changer হতে চলেছে। আজকের ভোক্তা পণ্যের দাম বা টেকসইয়ের পাশাপাশি এর চেহারা, ফিনিশিং, রঙের বৈচিত্র্য ও নান্দনিক দিকেও সমান গুরুত্ব দেন। আগামী দিনে এই চাহিদা আরও বহুগুণে বাড়বে। কারণ, গৃহনির্মাণ এখন আর শুধু কাঠামোগত বিষয় নয়, এটি লাইফস্টাইলের প্রতিফলন।
ডিবিএল সিরামিকস এই প্রবণতাকে আগে থেকেই গুরুত্ব দিচ্ছে। আমাদের প্রতিটি কালেকশনে ডিজাইন টিম স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক ট্রেন্ড বিশ্লেষণ করে নতুন নতুন প্যাটার্ন ও রঙের সংযোজন করছে। উদাহরণ হিসেবে sTiles কালেকশনটি বলা যায় এটি শুধু ডিজাইনে নয়, পণ্যের দৃষ্টিকোণ থেকেও একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন। আমরা এমন প্রোডাক্ট দিচ্ছি, যা শুধু একটি ঘর সাজায় না, বরং সেই ঘরকে একটি আলাদা পরিচয় দেয়। ডিজাইন ইনোভেশন আমাদের জন্য শুধু পণ্যের বৈশিষ্ট্য নয়, এটি আমাদের ব্র্যান্ড আইডেন্টিটি।
ডিবিএল সিরামিকস ভবিষ্যতে নিজেদের কোথায় দেখতে চায়?
এম এ রহিম: আমাদের লক্ষ্য খুব স্পষ্ট, ডিবিএল সিরামিকসকে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে শুধু বাংলাদেশের শীর্ষ সিরামিকস ব্র্যান্ড না রেখে একটি গ্লোবাল ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা।
এই লক্ষ্যে আমরা ধাপে ধাপে এগোচ্ছি। প্রথমত, রপ্তানি সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য নতুন ফ্যাক্টরি স্থাপন করছি শ্রীহট্ট ইকোনমিক জোনে। এই ফ্যাক্টরিটি হবে সম্পূর্ণ গ্রিন ম্যানুফ্যাকচারিং মডেলে তৈরি, যেখানে টেকসই উৎপাদনের সব উপাদান অন্তর্ভুক্ত থাকবে। দ্বিতীয়ত, আমরা ডিজাইন ও পণ্য উদ্ভাবনে নিয়মিত বিনিয়োগ করছি, যেন আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পণ্য তৈরি করতে পারি।
তৃতীয়ত, আমরা চাই ডিবিএল সিরামিকস একটি এমন ব্র্যান্ডে পরিণত হোক, যা শুধু পণ্যের মানেই নয়, বরং টেকসই ভাবনা ও উদ্ভাবনের জন্য বিশ্বে পরিচিত হবে। আমরা চাই বাংলাদেশকে গ্লোবাল সিরামিকস মানচিত্রে আরও শক্তিশালীভাবে উপস্থাপন করতে।
সবশেষে আমাদের ভিশন হচ্ছে, ‘To build a sustainable future through innovative and responsible ceramic solutions.’
আমরা শুধু পণ্য তৈরি করছি না, আমরা ভবিষ্যতের একটি সংস্কৃতি তৈরি করছি।
ভাইস চেয়ারম্যান, ডিবিএল গ্রুপ
মন্তব্য করুন