

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, নদী, পাহাড়, লোকজ ঐতিহ্য এবং প্রাণবন্ত সংস্কৃতি সবই আছে আমাদের বাংলাদেশে। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে গেছে, এত কিছুর পরও কেন আমরা পর্যটনে পিছিয়ে? এর একমাত্র উত্তর হলো, চোখ থাকার পরও না দেখা। বাংলাদেশে পর্যটন যেন একটি অবহেলিত সম্ভাবনার নাম, যাকে বারবার গুরুত্বহীন করে রাখা হয়েছে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে, নীতিতে, পরিকল্পনায় এবং বাস্তবায়নে। কতটা দুর্ভাগ্যজনক, আমরা বিশ্ববাজারে জাহাজ রপ্তানি করি, সমুদ্রজয়ের গল্প শুনি; কিন্তু সেই দেশের পর্যটকরা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করেন সেন্টমার্টিন বা সুন্দরবনে নিয়মিত ও নিরাপদ জাহাজ চলাচলের জন্য! কৌশল, সক্ষমতা আর প্রযুক্তির অভাব নেই; অভাব কেবল সদিচ্ছা, সমন্বয় আর পরিকল্পনার। আমাদের প্রবাল দ্বীপে যেতে অনিয়মিত সার্ভিস, সুন্দরবনে যেতে চাইলে সাধারণ পর্যটকের হাতে কোনো মানসম্পন্ন পরিবহন বা ট্যুর অপশন নেই। এটি শুধু অব্যবস্থাপনার নয়, এক ধরনের আত্মবিরোধিতার ছবি; যেখানে আমরা সমুদ্র দিয়ে স্বপ্ন রপ্তানি করি, অথচ নিজেদেরই সমুদ্রতীর ভ্রমণে পৌঁছাতে পারি না।
সরকার আসে, যায়। উন্নয়নের গল্প বদলে যায়; বাজেটের অঙ্ক ঘোরে অন্যদিকে; কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন খাতটি থেকে যায় পাশ কাটানো একটি অনুচ্ছেদ হয়ে। দীর্ঘ সময় ধরে এই সেক্টরে কোনো রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই না। পর্যটনকে শুধুই বিনোদন হিসেবে দেখা হয়, উন্নয়নের একটি কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে নয়। অথচ টেকসই পর্যটনের মাধ্যমে একটি দেশের অর্থনীতি, সংস্কৃতি, পরিবেশ এবং তরুণদের কর্মসংস্থান, সবই রূপান্তরিত হতে পারে।
আর যারা এই খাতে কাজ করেন, তাদের অবস্থাও একই রকম। অবাক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন, বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড কিংবা বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে পর্যটন এবং হসপিটালিটি বিষয়ে শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন একজন ব্যক্তিও নেই। যারা আছেন, তারা প্রশাসনিক বা আমলাতান্ত্রিক পটভূমি থেকে এসেছেন, ফলে পর্যটনের প্রযুক্তিগত ও মানবিক দিকগুলো প্রায়ই উপেক্ষিত থাকে। এই খাতে কাজ করা কর্মীদের নেই কোনো চাকরির নিশ্চয়তা, নেই পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, ক্যারিয়ার গ্রোথ বা অতিরিক্ত সুবিধা। এই বাস্তবতা তরুণদের জন্য যেমন হতাশাজনক, তেমনি পুরো সেক্টরের জন্যও ক্ষতিকর।
পর্যটন ও হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে দেশের অন্তত ৩০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজার হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। তারা স্বপ্ন দেখে এ খাতেই গড়ে তুলবে নিজেদের ভবিষ্যৎ। কিন্তু পাস করার পরই তারা দেখছে এই সেক্টরে সরকারি চাকরির নেই কোনো কাঠামো, নেই বিসিএস ক্যাডার, নেই বেতন কাঠামোর সম্মানজনক মানদণ্ড। বেসরকারি খাতে তারা পাচ্ছে কম বেতন, দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, সামাজিক স্বীকৃতির অভাব। এভাবে একটি প্রমিজিং খাতকে আমরা নিজেরাই ধ্বংস করে দিচ্ছি। এই দেশে এমন অনেক মানুষ আছেন, যারা পর্যটনকে শুধু পেশা নয়; বরং জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছেন। কেউ তিন দশক, কেউ চার দশক ধরে অন্ধকারের মধ্যেও আলো জ্বালিয়ে চলেছেন। তারা কখনো ট্যুর গাইড, কখনো উদ্যোক্তা, কখনো হোটেল ব্যবস্থাপক, আবার কখনো গবেষণা ও নীতির জন্য নিরলসভাবে কাজ করেছেন; কিন্তু দুঃখজনকভাবে, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির আলো কখনো তাদের গায়ে পড়েনি। আমাদের দেশে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার আছে, সাহিত্যের জন্য একুশে পদক আছে, ক্রীড়ার জন্য পুরস্কার আছে; কিন্তু পর্যটনে আজও কোনো জাতীয় পুরস্কার নেই। যাদের ঘাম আর শ্রমে একটি সম্ভাবনাময় খাত দাঁড়িয়ে আছে, তাদের জন্য নেই কোনো সম্মান, নেই কোনো প্ল্যাটফর্ম। এটি কেবল অবহেলার নয়, এটি আমাদের মূল্যবোধের এক ভয়াবহ ফাঁক।
দুঃখের বিষয় হলো, আমরা আজও পর্যটনে একটি পূর্ণাঙ্গ মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করতে পারিনি। পর্যটন উন্নয়নের কোনো নির্ভরযোগ্য রোডম্যাপ নেই। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারদের মধ্যে নেই সমন্বয়, নেই দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়ার মানসিকতা। পরিকল্পনা যতটুকু হয়, তা বেশিরভাগই কেন্দ্রভিত্তিক, ঢাকাকেন্দ্রিক এবং বাস্তবায়ন থেকে বহু দূরে। সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা সম্ভাবনাগুলো প্রশাসনিক গ্যাপে পড়ে যায় বিস্মৃতির খাতায়।
একটি দেশব্যাপী পর্যটন কাঠামো গড়তে চাইলে আমাদের প্রয়োজন ন্যূনতম নীতিগত সাহস। বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার প্রতিটিতে জেলা প্রশাসকের অধীনে একজন ‘পর্যটন কর্মকর্তা’ পদ সৃষ্টি করা হোক, যিনি স্থানীয় পর্যায়ে পর্যটনের তথ্য সংগ্রহ, গবেষণা ও যোগাযোগের দায়িত্ব পালন করবেন। এটি হবে বিকেন্দ্রীকরণভিত্তিক পর্যটন উন্নয়নের বাস্তব ও কার্যকর সূচনা।
একই সঙ্গে আমাদের দরকার নির্ভুল, সময়োপযোগী ও বিভাগভিত্তিক পর্যটন তথ্য। আজ পর্যন্ত আমরা জানি না বিদেশ থেকে যে পর্যটকরা বাংলাদেশে এসেছেন, তাদের কতজন শুধু ভ্রমণের উদ্দেশ্যে এসেছেন। নেই তাদের ভ্রমণসংক্রান্ত উদ্দেশ্য, ব্যয়, অবস্থানকাল, কিংবা গন্তব্য বিশ্লেষণ। পর্যটনের মাধ্যমে দেশের প্রকৃত আয় কত, তা জানার জন্যও আমাদের কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্যভিত্তিক ব্যবস্থা নেই। অথচ তথ্যহীন পরিকল্পনা মানেই দৃষ্টিহীন গন্তব্য। এমন তথ্যবিহীন নীতিমালা কখনোই সফল হতে পারে না। প্রতিটি উন্নত পর্যটন দেশের প্রথম হাতিয়ার হয় তথ্য, আমরা সে অস্ত্রটাই তৈরি করিনি।
সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হলো, আমাদের পর্যটন উন্নয়নের আলোচনাগুলোও হয় শুধু কক্সবাজার, সুন্দরবন কিংবা সেন্টমার্টিন ঘিরে। অথচ পুরো দেশটাই পর্যটন পণ্য। উত্তরবঙ্গের কৃষি ঐতিহ্য, বরিশালের নদী জীবন, সিলেটের চা বাগান, পার্বত্য চট্টগ্রামের সংস্কৃতি—সবই এক-একটি অনন্য প্যাকেজ হতে পারত যদি আমরা পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে যেতাম।
পর্যটন উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে জরুরি যে বিষয়টি, তা হলো সচেতনতা। পর্যটন নিয়ে সচেতনতা তৈরির জন্য স্কুল-কলেজ স্তরে পর্যটনশিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা অত্যন্ত জরুরি, যাতে আগামী প্রজন্ম ভ্রমণকে দায়িত্ব হিসেবে দেখার মানসিকতা গড়ে তোলে। মানুষকে বোঝাতে হবে, পর্যটন মানে শুধু কিছু পর্যটক নয়; বরং এটি একেকটি অঞ্চলের অর্থনৈতিক মুক্তির পথ। চাই বৃহৎ বিনিয়োগ, প্রশিক্ষিত জনবল, গবেষণা এবং স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ। একই সঙ্গে চাই তরুণদের কর্মসংস্থানের সুযোগ, সরকারি চাকরির কাঠামোতে পর্যটন শিক্ষার্থীদের অন্তর্ভুক্তি এবং পর্যটনকে একটি মর্যাদাপূর্ণ পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য সমাজে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির চর্চা। পর্যটন উদ্যোক্তাদের জন্য পৃথক ভেঞ্চার ক্যাপিটাল, প্রশিক্ষণ এবং ইনকিউবেশন সেন্টার চালু করা দরকার, যাতে তরুণরা নিজ নিজ অঞ্চলে কাজ শুরু করতে পারেন।
আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পর্যটন নিয়ে নানা ধরনের গবেষণা ও চিন্তাশীল বিশ্লেষণ চলছে, যা পর্যটনের সম্ভাবনাকে নতুনভাবে দেখার পথ তৈরি করছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, এই গবেষণাগুলোর বেশিরভাগই থেকে যাচ্ছে আলমারির ভেতরে ধূলি-ধূসরিত হয়ে। সেগুলোর ফলাফল ব্যবহার হচ্ছে না কোনো নীতিনির্ধারণে, পরিকল্পনায় বা বাস্তব পর্যটন উন্নয়নে। তাই এখন সময় হয়েছে একটি জাতীয় পর্যায়ের ‘পর্যটন জ্ঞানকেন্দ্র’ গড়ে তোলার, যা গবেষণা, উদ্ভাবন ও নীতিনির্ধারণের মধ্যে একটি কার্যকর সেতুবন্ধ গড়ে তুলবে। এ হাব হতে পারে পর্যটনশিক্ষা, শিল্প এবং রাষ্ট্রের মধ্যে সংযোগের অন্যতম প্রধান বাহন। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়ানো, রুয়ান্ডা, মালদ্বীপ, থাইল্যান্ডের মতো দেশগুলোর উদাহরণ থেকে শিক্ষা নেওয়াও এখন সময়ের দাবি।
বৈশ্বিক মহামারি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা রাজনৈতিক অস্থিরতার মতো পরিস্থিতিতে পর্যটন খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অথচ এসব সংকট মোকাবিলার জন্য আমাদের নেই কোনো আলাদা প্রস্তুতি বা দুর্যোগকালীন পরিকল্পনা। পর্যটন শিল্পকে রক্ষায় একটি স্বতন্ত্র দুর্যোগ-ব্যবস্থাপনা কৌশল থাকা অত্যন্ত জরুরি, যাতে প্রতিকূল সময়েও এই খাত সম্পূর্ণভাবে বিপর্যস্ত না হয়; বরং ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতা অর্জন করে।
আজ যদি আমরা এই অবহেলার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে না আসি, তবে কাল হয়তো হারাব সেন্টমার্টিনের শেষ প্রবাল, কিংবা পাথরে বাঁধানো লোকসাহিত্য। পর্যটন কেবলই একটি সেক্টর নয়, এটি একটি জাতির পরিচয়, সংস্কৃতি, সম্ভাবনা ও দায়িত্ব। পরিবর্তনের সময় এখন। দরকার কেবল সাহস, পরিকল্পনা, স্বপ্ন আর বাস্তবায়নের সদিচ্ছা। আমি এই কথা আগেও লিখেছি। আবারও লিখছি। জেনেবুঝেই লিখছি—এই লেখাও হয়তো অনেকের কাছে গুরুত্ব পাবে না। কর্তৃপক্ষ হয়তো চোখ বুলিয়ে এগিয়ে যাবেন অন্য কোনো চমকপ্রদ শিরোনামের দিকে। তবুও লিখছি, কারণ আমি বিশ্বাস করি, শব্দের একটি নিজস্ব শক্তি আছে। আমি চাই, কেউ একজন এই লেখা পড়ে থমকে দাঁড়াক এবং ভাবুক আমরা কি পর্যটনের এই সম্ভাবনাকে অবহেলাই করে চলেছি? আমি আশাবাদী, কেউ না কেউ উপলব্ধি করবেন যে—পর্যটন কেবল ভ্রমণ নয়, এটি একটি দেশের মর্যাদা, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা। তাই আমি আবারও লিখছি। কারণ আশা কখনো মরে না।
বিভাগীয় প্রধান, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন